দৌড়ে পালাচ্ছেন দুই তরুণী। পুরুষের পোশাক তাঁদের পরনে। সেটা ছদ্মবেশ। একজন নাবালিকা, অন্যজন মধ্যবয়স্কা। চারিদিকে শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ। নাবালিকা মেয়েটি হঠাৎ মাটিতে পড়ে যায়। ব্রিটিশ ক্যাম্প থেকে ছুটে আসা একটা গুলি বিদ্ধ করেছে তাঁর পা। ক্ষতবিক্ষত পা নিয়েও সে থামে না। সে থামতে জানে না। রক্তঝরা পা নিয়ে সে দৌড়তে থাকে। দেশ তখন পরাধীন। তাঁরা জানত যে একবার দৌড় থামালে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার প্রবল সম্ভবনা। কারণ ইংরেজদের হাতে ধরা পড়া মানে অবধারিত মৃত্যু অথবা গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। এদিকে পা নিয়ে একেবারেই চলা যাচ্ছে না।
সেই সাহসী দুটি মেয়ে সামনে থাকা একটা গাছ বেয়ে উঠে পড়ে তাতে। সন্ধ্যের অন্ধকারে আর পালানো হয় না তাঁদের। সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। প্রায় দুদিন গুলিবিদ্ধ, অভুক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে সেই গাছে আশ্রয় নিয়েছিল মেয়ে দুটি। তারা জানতো ইংরেজরা প্রায় প্রত্যেক বিপ্লবীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দুজন মহিলা বিপ্লবী খোঁজার জন্যে তাঁরা খুব একটা সময় ব্যয় করবে না। দুদিন গাছে অপেক্ষা করে তারা নেমে আসে গাছ থেকে। ততদিনে তাঁদের খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ইংরেজ পুলিশ। এরপর ওই মেয়ে দুটি আট ঘন্টা বাসের দীর্ঘ সফল অতিক্রম করে পৌঁছন আইএনএ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বেস ক্যাম্পে। এই সাহসী মহিলারা ছিলেন দুর্গা এবং সরস্বতী রাজামণি। সরস্বতী রাজামণিকে পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম গুপ্তচর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে এই আখ্যা দিয়েছিলেন।
১৯২৭ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মায়ানমারে জন্ম তাঁর। স্বাধীনতাসংগ্রামী বাবার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন সরস্বতী। তাঁর বাবা জীবনের প্রথম দিক থেকে নানা বৈপ্লবিক কাজে যুক্ত থাকার পর ব্রিটিশদের সংস্পর্শ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে পরবর্তীকালে রেঙ্গুনে বসবাস স্থাপন করেন এবং সেখানে নিজের কাজ করতেন। তারপর স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত না থাকলেও বিপ্লব এবং স্বাধীনতার প্রতি মানুষের ভালোবাসা সম্মান এবং স্পৃহাকে শ্রদ্ধা করতেন তিনি।
১৯৩৭ সালে মহাত্মা গান্ধী নিজে রাজামণির বাড়িতে দেখা করতে এসেছিলেন। রাজামণি তখন বাড়িতে ছিল না। বাবা চাইছেন মেয়ের দেখা হোক জাতির জনকের সঙ্গে। খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েটি বাগানের বন্দুক নিয়ে খেলা করছে। মহাত্মা গান্ধীর প্রশ্নের উত্তরে দৃঢ় গলায় রাজামণি উত্তর দেন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে যেভাবে লুণ্ঠন চালাচ্ছে তার প্রতিবাদে সে একজন ব্রিটিশকে গুলি করতে চায়। ছোট্ট মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর শুনে সকলেই অবাক হয়। সেই সময় থেকেই রাজামণির ভেতর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছের চারাগাছ বড় হতে শুরু করতে থাকে।
তিনি কম বয়সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর আন্দোলনে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সরস্বতী রাজামণি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় চরমে উঠেছে তখন স্বয়ং নেতাজি রেঙ্গুনে এসেছিলেন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে তহবিল গড়ে তুলতে। ইতিমধ্যে আই এন এ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠিত হয়েছে। রাজামণি নেতাজির এই তহবিলের আন্দোলনের জন্য সমস্ত সোনা এবং হীরের গয়না দান করেন। দেশের প্রতি সরস্বতী রাজামণির গভীর মমত্ববোধ নেতাজিকে স্পর্শ করেছিল। নেতাজির উদ্যোগে তিনি আইএনএতে যোগদান করেন। এদিকে মূলত আহত সৈন্যদের সেবা করতেন সরস্বতী রাজামণি।
রাজামণির মন কিছুতেই ভরে না। রোগীর সেবা নয় তিনি সরাসরি যুদ্ধ করতে চাইবেন দেশের জন্য। একবার আই.এন.এ-র কিছু সদস্য টাকার বিনিময়ে ইংরেজদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করেছিল। উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে সরস্বতী রাজামণি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নেতাজীকে তা জানান, নেতাজি তখন রেঙ্গুন থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে এক বেসক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। তাঁর এই দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজামণিকে আইএনএ-র রানী ঝাঁসি রেজিমেন্টে যুক্ত করেন এবং তিনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেগালের নেতৃত্বে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে মিলিটারি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে শুরু করেন। নেতাজির নির্দেশে রাজামণি আইএনএর প্রথম মহিলা গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। এখানেই তার আলাপ হয় দুর্গার সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে গুপ্তচর ভিত্তিতে সরস্বতী রাজামণির সহচরী ছিলেন। সরস্বতী রাজামণি এবং দুর্গা।
রাজামণিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহের মূল দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা মূলত পুরুষ মিলিটারি পোশাকে অফিসারদের বাড়িতে খুঁটিনাটি কাজ করার বাহানায় প্রবেশ করে বিভিন্ন গোপন তথ্য সংগ্রহ করতেন। কিছু ফাইল এবং অস্ত্রশস্ত্র সংযোগ করেছিলেন তাঁরা। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি আইএন-এর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। পরবর্তীকালে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে রাজামণি মায়ানমারের এক প্রচলিত নর্তকীর ছদ্মবেশ ধারণ করে পুলিশদের থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন। জেলরক্ষীরা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত রাজামণি তাঁর সহচরী দুর্গাকে উদ্ধার করে জেল থেকে পালিয়ে যান। পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানেও থেমে থাকেননি। নিজের কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন আহত অবস্থাতেও। ২০১৮ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি মারা যান। ইতিহাসের পাতায় এই গুপ্তচারের কথা সেভাবে উল্লিখিত না থাকলেও দেশের স্বাধীন বাতাসে রাজামণির মত এমন অনেক সাহসী লড়াকু নারীদের কথা আজও উড়ে বেড়ায়।