ইন্দ্রের চর কুক্করি সরমা, যমের চর সারমেয়, বরুণের শত সহস্র চরচক্ষু, এই সব উপমা বেশ পরিচিত। এই উপমা থেকে বোঝা যায় বৈদিক যুগে গুপ্তচর ব্যবস্থা কোনভাবেই অপরিচিত ছিল না। বৈদিক যুগেই গুপ্তচর ব্যবস্থার প্রচলন এবং প্রবর্তন শুরু হয়।
ঐতিহাসিকরা বলেন ঋকবেদের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগে সংগঠিত রাজতন্ত্রের প্রকাশ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই শত্রুর গতিবিধি নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দাবি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে গুপ্তচর ব্যবস্থার প্রয়োজন অস্বীকার করতে পারেনি কেউই। নিরাপত্তার তাগিদেই গুপ্তচরবৃত্তি একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেখান থেকে এই ব্যবস্থা বিবর্তিত হতে হতে গুপ্তচর বা স্পাই আমাদের দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা গ্রহণ করে।
ঋকবেদে গুপ্তচরবৃত্তির আভাস পাওয়া গেলেও এর পরিণতি প্রাপ্তি ঘটেছিল প্রাচীন ভারতে এর পরবর্তীকালে। গুপ্তচরব্যবস্থার গঠনতন্ত্র, কার্যপ্রণালী, এবং তার নির্দিষ্ট ভাগ সমেত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছিল কৌটিল্যের রচিত অর্থশাস্ত্রে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাজতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এই গুপ্তচররীতিকে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে গেলে গুপ্তচর থাকা বাঞ্ছনীয়। ঐতিহাসিকরা বলেন প্রাচীন ভারতীয় গুপ্তচর ব্যবস্থার নিদর্শনে এমন প্রামাণ্যগ্রন্থ পরবর্তীকালেও সেভাবে পাওয়া যায়নি।
তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। বেদে বর্ণিত গুপ্তচরদের সঙ্গে রাজনীতি বিষয়ে ইতিহাসের গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত গুপ্তচরদের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ঋকবেদের গুপ্তচররা অনেক বেশী দৈবিক গুণের অধিকারী। এর একটা সামাজিক ভিত্তি থাকলেও প্রেক্ষাপটগত পার্থক্য বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে।
গুপ্তচর ব্যবস্থার উপস্থিতির প্রভাব ঋকবেদের যুগ থেকে থাকলেও অর্থশাস্ত্র বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও ঐক্য সাধন করে গুপ্তচর ব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যকে পূর্ণরূপ দিয়েছে। অর্থশাস্ত্রে রাজতন্ত্র সর্বদা প্রাধান্য পেয়েছে। রাজতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রের রক্ষা ও প্রতিপালন মূল উদ্দেশ্য। বাস্তবে রূপায়ণ করার জন্য আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দুই দিক থেকেই শক্তিশালী ও নিরাপদ থাকা রাজার জন্য খুব প্রয়োজন। নিরাপত্তার কারণেই গুপ্তচর নিয়োগের কথা বলা হয়েছে অর্থশাস্ত্রে। অর্থশাস্ত্রের মোট ১৫ টি অধিকরণের ১৫০টি অধ্যায়ের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটিতেই গুপ্তচরদের উপস্থিতির কথা বলা আছে।
গুপ্তচরের উপস্থিতির কথাই বলা নেই তাদের যোগ্যতা, কার্যপ্রণালী ছদ্মবেশ কথা বলার ধরন শিক্ষাপ্রদানের ভঙ্গি কোন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত এই প্রত্যেকটি জিনিস এখানে অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্ণনা করা হয়েছে।
গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্রে আলোচিত প্রত্যেকটা পদ্ধতি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত এবং যথেষ্ট মস্তিষ্কপ্রসূত। অর্থশাস্ত্রের সকল তথ্য সেই সময়কার শক্তিশালী গুপ্তচর ব্যবস্থার উপস্থিতির আভাস দেয়।
অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা যেই হোক না কেন রাজনীতি বিষয়ে এমন আদর্শ নির্দেশক গ্রন্থের রচনার জন্য যে ধরনের উচ্চমানের বাস্তব গবেষণার প্রয়োজন তা গুপ্তচর ব্যবস্থার পর্যালোচনা করলেই যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে অর্থশাস্ত্র ছাড়াও একেবারে ব্রাহ্মণ্য, ঐতিহ্যবাহী আচারসর্বস্ব ধর্মশাস্ত্র সাহিত্য সূত্রেও গুপ্তচরদের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য রচিত ধর্মশাস্ত্রে গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে এবং সমাজের সুরক্ষার প্রয়োজনে গুপ্তচরের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে।
তবে গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে আজও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকেই মূল বই হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।