কষা মাংস-লুচি, কষা মাংস-গরম ভাত-শুনলে জিভে জল আসে না এমন বাঙালি নেই। নিখাদ বাঙালি এই খানা আজ বলে নয়, বঙ্গবাসীর খুব পুরনো অভ্যাস। শক-হুন-মোগল-ইংরেজদের সঙ্গে মিশে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটলেও একই থেকে গিয়েছে মাংস-ভাতের অভ্যাস।
ব্রিটিশরা প্রেমে পড়েছিল বাঙালি তথা ভারতীয় ‘চিকেন কারী’র, কিন্তু তাদের বিলিতি জিভ দেশি খাবারে লঙ্কার ঝাল সহ্য করতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে ইংরেজ হেঁশেলের রাঁধুনিকে খুঁজতে হয়েছিল অন্য উপায়। উপায় খুঁজে তাঁরা পেয়েছিলেন। উপায় মিলেছিল ‘রেলওয়ে মাটন কারি’তে। কীভাবে? তার একটি গল্প আছে।
সালটা ১৯০০। দেশে তখন সবে সবে রেল ছুটতে শুরু করেছে। যাত্রী থেকে বিদেশি রেল সাহেব ব্যস্ততার অন্ত নেই। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব কর্মীদের কর, খাজনা আদায় আর কোম্পানির কাজে ছুটতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। রেলপথই একমাত্র উপায়। দীর্ঘ পথে ‘লাঞ্চ’ ‘ডিনার’ সবই করতে হয়। ট্রেনের কুক রেঁধে বেড়ে দেন।
প্রথম শ্রেণির কামরায় ভাত কিংবা ‘রুটি’র সঙ্গে দেওয়া হত দেশি ঘরানার পাঁঠার ঝোলও। দিনে দিনে সাহেবদের মুখে রেলের রসুইখানায় রান্না করা সেই দিশি মাংসের ঝোলের নাম হয়ে যায় ‘রেলওয়ে মাটন কারি’।
অনেকে বলেন, বাংলার বিখ্যাত ‘পাঁঠার মাংসের ঝোল’ আর ওয়াজেদ আলি শাহর ‘মাটন কোর্মা’ মিলেমিশে হয়েছিল ‘রেলওয়ে মাটন কারি’
ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান-রেল ভারতে যাত্রা শুরু করে ১৮৫৭ সালে। তারপর বহু বদল ঘটে তার। একটি সূত্র বলে ব্রিটিশ জমানায় বম্বে-কলকাতা রেলপথে ‘ব্লু ট্রেনে’ প্রথম শুরু হয় রেলওয়ে চিকেন কারি। বোম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমেও। আর একটি মত বলে, ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের ফ্রন্টিয়ার মেলে প্রথম পরিবেশন করা হয় রেলওয়ে ক্যান্টিনে রাঁধা রেলওয়ে মাটন কারি।
শুধু মাত্র ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের ফ্রন্টিয়ার মেল ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত ট্রেন। বোম্বাই থেকে পেশোয়ারের পথে চলত। নীল রক্ত আর সাদা চামড়ার এলিট গোরা সাহেবদের জন্য রান্না, আন্দাজ করা যায় কী পরিমান দক্ষতার সঙ্গে এই ‘কারি’ রান্না করতেন রাঁধিয়েরা। একচুল এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। মনে রাখতে হবে তখন ট্রেন চলত কয়লার ইঞ্জিনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই ট্রেনের নাম হয়ে যায় গোল্ডেন টেম্পল মেল।
যাইহোক, রেলওয়ে মাটন কারি নিয়ে নানারকম গল্প শোনা যায়। সেরকমই একটি কাহিনি বলে, একবার ব্রিটিশ সেনাদের একটি দল সফর করছিল ফ্রন্টিয়ারে। সেই দলের এক সদস্য রাতের দিকে টহল দিতে যায় প্যান্ট্রিতে। করিডোর থেকে নাকে আসে রান্নার খুশবু। খানসামাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করতে তারা তাদের খাবার থেকে একবাটি মাংসের ঝোল তাকে খেতে দেয়। কিন্তু সেই সাহেব খাবে কী! ঝালে জিভ পুড়ে যায় তার। হু-হাতে চিৎকার জুড়তে যাবে সাহেব, ঠিক সেই সময় চালাক খানসামা তাতে মিশিয়ে দেয় নারকেল দুধ, কারুর কারুর মতে অবশ্য দই ছিল।
যাইহোক, ঝালের চোটে খেতে না পারলেও মাংসের ঝোলের স্বাদটি কিন্তু মুখে লেগে থাকে গোরা সাহেবের। পরের বার সফরের সময় সাহেব ফের খোঁজ করে সেই ঝাল মাংসের ঝোলের , কিন্তু নাম কিছুতেই মনে পড়ে না। ট্রেনে খাওয়া মাংসের ঝোলটিকে বলেন ‘রেলওয়ের কারি’। সেই নামই নাকি ছড়িয়ে যায় রাঁধুনি-খানসামাদের মুখে মুখে। পরবর্তী সময়ে রেলে অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান কর্মীদের মধ্যেও খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভিনিগার আর তেঁতুলের ব্যবহার এই রান্নার সিগনেচার। সেহেব মুখে ঝাল কমানোর জন্য যা ব্যবহার করা হত।
কীভাবে রান্না হত রেলওয়ে মাটন কারি?
পাঁঠার মাংসকে সামান্য হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নেওয়া হত। তারপর জল আর মাংস আলাদা করা হত। লোহার কড়া গরম হলে তাতে সর্ষের তেল দিয়ে সব ধরনের গোটা গরমমশলা, তেজপাতা, গোল মরিচ আর শুকনো লঙ্কা দেওয়া হত। মশলা থেকে গন্ধ বেরতে শুরু করলে তাতে টমেটো, রসুনবাটা, আদাবাটা, জিরে বাটা, ধনে বাটা, লঙ্কা বাটা আর নুন দিয়ে মশলা কষাতে হবে।
মশলা থেকে তেল বেরিয়ে এলে সেদ্ধ মাংস আর মাংসের জল দিয়ে ঢাকা দিতে হবে। কইয়েক মিনিট পর নারকেল দুধ, ভিনিগার বা তেঁতুলের ক্কাথ দিতে হবে। ফুটে উঠলে রান্না শেষ। এই মাংসের ঝোল মশলাদার হলেও একেবারেই ঝাল থাকে না।
রেলওয়ে মাটনকারী আজও ভারতীয় রান্নায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রেলপথ কীভাবে বদলে দিয়েছিল ভারতীয় জীবন তার সঙ্গে জিভের স্বাদেও বদল এনেছিল কীভাবে রেলওয়ে মাটন কারি তার এক উদাহরণ। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও চল আছে এই রান্নার।