প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা, টাকির জমিদার রায়চৌধুরি পরিবারের হাত ধরেই টাকির কুলেশ্বরী কালীবাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল। সেই থেকে আজও একইভাবে কুলেশ্বরী মায়ের পুজো চলে আসছে। আনুমানিক ১৬৪০-৪৫ সালের মধ্যে টাকির তদানিন্তন জমিদাররা এই কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, ইছামতী নদীর তীরে জেলেদের জালে দেবীঘট উঠে এসেছিল। তারপরই জমিদার নদী তীরে পাওয়া ঘট নিয়ে দেবীর মুর্তি প্রতিষ্ঠা স্বপ্নাদেশ পান। ইছামতীর পাড়ে সেই ঘট ও কালীমায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার। নদীর কূলে পাওয়া ঘট থেকে মন্দির সৃষ্টি এবং নদীর কূলেই মন্দির অবস্থিত, তাই মন্দিরটি কূলেশ্বরী কালীবাড়ি নামেই পরিচিতি পেয়েছিল। এই মন্দিরে কালীপুজো খুব জাঁকজমক সহকারে হয়, ওই দিন বহু দূর থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন কূলেস্বরী কালীবাড়ির পুজো দেখতে। মন্দিরে বলি প্রথা আজও রয়েছে, শোনা যায় এককালে কালীপুজোর রাতে শতাধিক পাঁঠা বলি হয়। যদিও এখন ৫০-৬০টি পাঁঠা বলি হয়ে থাকে।
জনশ্রুতি রয়েছে, বাংলার বার ভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম যশোরের ভূঁইয়াধিপতি রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলে কুলেশ্বরী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে আকবরের সেনাপতি মানসিংহের একবার যুদ্ধও হয়েছিলো। তবে তথ্য-প্রমাণ বলে, রায়চৌধুরী পরিবারের হাতেই কুলেশ্বরী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রায়চৌধুরী বাড়ির কর্তারা মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েই হাসনাবাদের রোজিপুরের কালীতলায় মায়ের পুজো করেন। কালীতলায় বিসর্জন দেওয়া পুজোর ঘট কূলে ভেসে আসে, সেই ঘটই কূলেশ্বরী কালীবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এই নদীর নামকরণও হয় কূলেশ্বরী নদী। একদম প্রথমে খড় ও গোলপাতার ছাওয়া এবং মাটির দিয়ে ছোট্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে তা সংস্কার করা হয়। আবার অন্য এক কিংবদন্তি অনুযায়ী, টাকি ঘুরতে গিয়ে নদীর কূলে প্রথম কালীপুজো করেছিলেন মানসিংহ। এরপর সেই পুজোর ঘট নদীর জলে ভাসতে ভাসতে এক জায়গায় পৌঁছয়। তার দূরত্ব খুব জোর ৫০ মিটার। সেখানেই গড়ে উঠেছে কালীমন্দির।
আবার কেউ কেউ বলেন, কোন সাধক ইছামতীর পাড়ে মা কালীর সাধনা করেন এবং সেই ঘট নদীর পাড়ে পড়েছিল। এরপর টাকির জমিদারকে দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়ে ওই ঘট প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তখনই টাকির জমিদার কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেওয়া হয় কুলেশ্বরী কালীমন্দির। কারণ, নদীর কুলেই এই মন্দিরের ঘট পাওয়া গিয়েছিল।
মন্দিরে পুজো করার জন্য বাংলাদেশ থেকে ব্রাহ্মণ নিয়ে আসা হয়। বাংলার যশোহরের বার ভুঁইয়াধিপতি প্রতাপাদিত্য বরেন্দ্রভূমির ব্রাহ্মণ মৈত্র উপাধিপ্রাপ্ত অনন্ত চক্রবর্তীকে পূজার্চনা ও দেব সেবার ভার দেন। এই মৈত্ররা ছিলেন তদানিন্তন সমাজ চক্রের অগ্রণী। তাই চক্রবর্তী বলেই তারা পরিচিত ছিলেন। বাংলার ৪৭০ সনে কান্যকুব্জ থেকে একশ ঘর মল্লিক ব্রাহ্মণ বরেন্দ্র ভূমিতে চলে আসেন, পরবর্তীতে তারাই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বলে খ্যাত হন। নির্দিষ্ট করে কূলের আদি কোন সাল না থাকায় প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে অনেক মতবিরোধ আছে। রাজা প্রতাপাদিত্যের সময় ব্রাহ্মণ অনন্ত চক্রবর্তী থেকে আজ পর্যন্ত ওই বংশ প্রায় চোদ্দপুরুষ ধরে এই পূজার্চনা করে চলছে।মন্দিরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মা কুলেশ্বরী সেবাশ্রম সংঘ ও ত্রিশক্তি মন্দির।
মা বগলা, মা চন্ডীকা, এবং মা তারা অধিষ্ঠিত রয়েছেন ত্রিশক্তি মন্দিরে। এই কুলেশ্বরী কালী মায়ের চারটি হাত রুপোর তৈরি। সকালে মঙ্গলারতি, দুপুরে ভোগ এবং সন্ধ্যায় আরতি মিলিয়ে দিনে তিনবার করে মায়ের পুজো হয়। এছাড়া বিশেষ দিনে বিশেষ পুজো হয়। সারা বছর ধরে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলাহারী পূজা, চৈত্রে গাজন উৎসব, ধুনুচি নাচ ও নীল উৎসব ইত্যাদি পুজো হয়। কার্তিক মাসে কালীপুজোর আগে আদি কালীবাড়িতে বিশেষ পুজোর পর এখানে পুজো শুরু হয়। অমাবস্যা শুরু হওয়ার পর এবং শেষ হওয়ার আগে এখানে কালীপুজো সম্পূর্ণ করা হয়। পুজোর দিনে মাকে নানান রকম গহনাও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। পুজোয় পাঠা বলি ও কুমড়ো বলি হয়। বলিদান প্রথার প্রচলন রয়েছে আজও। বলি শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় ভোগ বিতরণ। সারারাত ভক্তদের ভিড় থাকে মন্দির চত্বরে। পুজোর পরের দিন মায়ের ভোগের জন্যে খিচুড়ি, পাঁচ রকম সবজি ও পাঁচ রকম মশলা দিয়ে পাকান্ন, পোলাও, ভাত রান্না হয়। এছাড়াও এই পুজোয় আমিষ ভোগেরও ব্যবস্থা থাকে। মায়ের ভক্তদের পরিবেশনের জন্য থাকে মায়ের ভোগসহ মাছ, মাংসের বিভিন্ন রকমারি পদ। ঐতিহ্যশালী এই কালীমন্দিরে কালীপুজোয় আগে কামান দাগা হত। যদিও বর্তমানে তা হয় না। মন্দিরে মায়ের যে মূর্তি আছে প্রথম থেকে সেটিই পূজিত হচ্ছে। কালী পুজোর আগে প্রত্যেক বছর কৃষ্ণ একাদশীতে অঙ্গরাগ করা হয় অর্থাৎ মায়ের মূর্তিতে রং করা হয়। জানা গিয়েছে, মন্দিরে এখনও সেই মাটির ঘটই রয়েছে, যেটিকে কেন্দ্র করে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্যামা পুজোর ভোর ৫.৩০ নাগাদ দেবীকে জাগানো হয়। তারপর তাঁকে মুখ হাত-পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। সন্ধেয় মাকে নতুন পোশাক পরানো হয়। এরপর ফুলের মালা ও সোনার অলংকারে সাজানো হয় দেবীকে। একইসঙ্গে সাজানো হয় মহাদেবকেও। সন্ধেবেলা আরতি দেখতে ভিড় করেন ভক্তরা। পুজোর দিন মায়ের জন্য থাকে বিশেষ ভোগের আয়োজন। যেমন, মাছ ভাজা, বলির পাঁঠার মাংস, পোলাও, মিষ্টি, ফল ইত্যাদি।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, এটা মায়ের মন্দির নয়, মায়ের বাড়ি। জনশ্রুতি রয়েছে, রাতে মা মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়াতেন। মন্দিরের পাশের পুকুর পাড়ে একটি পুরোনো বকুল গাছ রয়েছে। অনেকেই মাকে ওই গাছ থেকে পা ঝুলিয়ে রাতে পুকুর পাড়ে বসে থাকতে দেখেছেন। বিশ্বাস আর ভক্তিতে ভর করেই আজ চার শতাব্দী ধরে পূজিত হচ্ছেন মা কুলেশ্বরী।