কালীকথা: বর্ধমানের মা কঙ্কালেশ্বরী

মা কঙ্কালেশ্বরী, এই বাংলা জুড়ে বিদ্যমান কালী মায়ের নানা বিচিত্র রূপের মধ্যে এও এক রূপ। দক্ষিণবঙ্গের প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম এই কঙ্কালেশ্বরী কালী মন্দির। প্রায় সারা বছর ধরেই এখানে ভক্ত সমাগম লেগে রয়েছে। কালীপুজোর সময় দীপান্বিতা অমাবস্যার সময় তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত থাকে না। এছাড়াও চলে নিত্য পুজো।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কাঞ্চননগর এলাকায় মা কঙ্কালেশ্বরীর মন্দির অবস্থিত। মা কালী এই কঙ্কালসার রূপ নিয়েই এখানে বিরাজমান। কয়েক শতাব্দীরও বেশি সময় যাবৎ এই মন্দিরেই দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন।

দেবীর পদতলে শিব, অষ্টভুজা দেবীর চামুন্ডা মূর্তিকেই কঙ্কালেশ্বরী মা রূপে পুজো করা হয়। এই মন্দিরের বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি। এই মন্দিরে পাঁচটি চূড়া রয়েছে। পুরো পঞ্চরত্ন মন্দিরটি জুড়ে অপূর্ব টেরাকোটার কারুকার্য লক্ষ্য করা যায়। এক বিরল স্থাপত্যরীতির অনন্য নিদর্শন হল মা কঙ্কালেশ্বরী মন্দির। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, এই মূর্তি বৌদ্ধ বা পাল যুগের। দেখে অনুমান করা যায় এই মূর্তি দু-হাজার বছরের বেশি প্রাচীন। আবার ঐতিহাসিকদের একাংশের মত, মূর্তিটি জৈন আমলে তৈরি হয়েছিল। মূর্তিতে স্পষ্টত বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাবও লক্ষ্য করেন। তবে বহুল প্রচলিত মত অনুযায়ী, কঙ্কালসার মূর্তিটি প্রাক আর্য যক্ষিণী মূর্তি।

 

kankaleshwari1

 

৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কালো ব্যাসাল্ট পাথরে নিপুণ ও নিখুঁত ভাবে খোদা করা রয়েছে কালী মূর্তিটি। প্রতিমার মাথার উপরে হস্তী ও পায়ের নিচে শায়িত শিব, উপরের ডান হাতে ত্রিশূল, নিচে দুপাশে দুটি শেয়াল। মূর্তির গলায় রয়েছে মুণ্ডমালা। সে এক বিধ্বংসী রূপ মা কালীর। সচরসাচর এমন রূপের দেবীমূর্তি বাংলায় অন্তত দেখা যায় না। মায়ের এক্কেবারে কঙ্কালসার চেহারা।

যদিও মন্দিরটি খুব প্রাচীন নয় আড়াইশো বছর কী আর এমন! বাংলার অধিকাংশ কালী মন্দিরই অমন আড়াইশো তিনশো বছর আগে গড়ে উঠেছিল। আসলে ঐ সময়ে বাংলায় কালী মন্দির স্থাপনের এক জোয়ার এসেছিল। রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে ডাকাত, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জমিদার সকলেই কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন।

কিন্তু মন্দিরে নয়, কঙ্কালেশ্বরীর বিশেষত্ত্ব মায়ের মূর্তিতে, মূর্তিটি অন্তত এক সহস্র বছর পুরোনো। এটি পাল-সেনযুগের রুদ্রচর্চিকা মূর্তি। পালযুগ ও সেনযুগ দুই বংশের রাজত্বকালেই রুদ্রচর্চিকা উপাস্য ছিলেন। নয়পালের বাণগড় প্রশস্তি যেমন চর্চিকার বন্দনা করে শুরু হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ চর্চিকাস্তবও রয়েছে, ঠিক একইভাবে সেনযুগে সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলনে উমাপতিধরের লেখা একটি চর্চিকাস্তব আছে।

 

kankaleshwari2

 

মা এখানে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে জ্বলন্ত অগ্নিরাশির মত চক্ষুবিশিষ্ট, অগস্ত্য মুনির দ্বারা বারিহীন সমুদ্রের মত তাঁর পাতালগত উদর। ওই সংকলনেই সেনযুগের একজন অনামা কবির লেখা চর্চিকাস্তবে এই মাতৃকা “নির্মাংসা প্রকটাস্থিজাল” বলে আখ্যা পেয়েছেন। অর্থাৎ মায়ের মূর্তিতে মা মাংসহীন, তাঁর মূর্তিতে অস্থিজাল প্রকট। কঙ্কালেশ্বরী মায়ের মূর্তিটিও ঠিক তাই। এই মূর্তির অস্থি ও শিরা নিখুঁতভাবে বোঝা যায়।

এই মূর্তিটি যে রুদ্রচর্চিকা, বা রুদ্রচামুণ্ডার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইনি অষ্টভুজা। এর অনুরূপ মূর্তি দশভুজা হলে তাকে সিদ্ধচর্চিকা বা সিদ্ধচামুণ্ডা বলা হয়। মায়ের ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী, ইনি ডমরু ও নরমুণ্ড ধারণ করেন হাতে, এঁকে "তেন সা রুদ্রচামুণ্ডা নাটেশ্বর্য্যথ নৃত্যতী" অর্থাৎ নৃত্যেশ্বরী নৃত্যরতা রুদ্রচামুণ্ডা বলা হয় । বাঙালির নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার নৃত্যগীতনাট্যশালায় উপাস্য মাতৃকা যে তিঁনিই ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কাঞ্চননগরে কালীর যে রূপ দেখা যায়, তেমনটা অন্য কোথাও দেখা যায় না। এখানে কালী যেন একেবারে কঙ্কালসার চেহারায়। শরীরের শিরা ধমনী অস্থি স্পষ্ট এই কালী মূর্তির। কষ্ঠিপাথরে খোদিত কালীমূর্তির এই রূপের জন্যই মাতৃ মূর্তির নাম 'কঙ্কালেশ্বরী কালী'। কঙ্কালেশ্বরী মায়ের আটটি হাতের মধ্যে ডানদিকের হাতে তরবারি, ডমরু, শূল ও কপাল-পাত্র। বাঁদিকের হাতে একটি ফসল কাটার অস্ত্র, ঘন্টা, নরমুণ্ড ও ভক্ষণমুদ্রা। মায়ের দুদিকে দুই সহচরী আছেন, পদতলে শবশিব-দলন করেন।

 

kankaleshwari3

 

কথিত আছে, ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল বাংলায়। দামোদর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সম্পূর্ণ এলাকা।  বন্যার জল নামার পর দামোদরের গর্ভ থেকেই উদ্ধার হয় কষ্ঠিপাথরের এই দেবীমূর্তি। তারপরেই সাধারণ মানুষ ওই মূর্তির আরাধনা করতে শুরু করেন। তখন থেকেই দেবীর আরাধনা হয়ে আসছে। শোনা যায়, শ্রীচৈতন্যের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের সঙ্গী গোবিন্দ দাস-এর জন্মভিটে রয়েছে এই কাঞ্চননগরে। তাঁর জন্মভিটের কাছেই রয়েছে পঞ্চরত্ন বিষ্ণুমন্দির। সেখানেই অধিষ্ঠিত হয়েছেন কঙ্কালেশ্বরী কালী।​

অন্য একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৩২০ বঙ্গাব্দে দামোদর নদের বন্যায় চৌধুরীদহে ভেসে এসে উপুড় অবস্থায় পড়েছিল। ফলে এটি কেবল এক প্রস্তরখণ্ড হিসেবেই প্রতীত হয় এবং ধোপারা এই ছয় ফুট ব্যাসল্ট পাথরের মূর্তির পেছনের দিকটা কাপড় কাচার জন্য ব্যবহার করতেন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে এক ভূমিকম্পে চৌধুরীদহে ফাটল তৈরি হলে পাথরটি উল্টে গিয়ে সম্মুখভাগ বেরিয়ে আসে এবং এ মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয়। বর্ধমানের রাজার উদ্যোগে ওই বছরই একটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে এ মূর্তি স্থাপিত হয়।

শোনা যায় বন্যায় ভেসে আসা কষ্ঠিপাথরের এই দেবীমূর্তি দামোদর গর্ভ থেকে উদ্ধার করার পর তা বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগরের একটি পঞ্চরত্ন বিষ্ণুমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তারপর থেকেই এই মন্দিরে মা কঙ্কালেশ্বরী কালীর আরাধনা হয়ে আসছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...