গোটা দেশের লাইফলাইন হল ট্রেন, আর মহানগর কলকাতার লাইফলাইন হল মেট্রো রেল। এ শহরে ট্রামও চলে, আবার ঘোড়ার গাড়িও চলে, একই সঙ্গে মেট্রোও ছোটে। ১৯৮৪ সালে কলকাতা মেট্রো চালু হয়েছিল। ভারতের প্রথম মেট্রো রেল চালু হয় এখানেই। প্রাথমিকভাবে উনবিংশ শতকের বিশের দশকে মেট্রোর পরিকল্পনা করা হলেও সত্তরের দশকে নির্মাণকাজ শুরু হয়৷ ১৯৮৪-এ ভবানীপুর অর্থাৎ আজকের নেতাজি ভবন থেকে এসপ্ল্যানেড অবধি মেট্রো চালু হয়েছিল। আজ প্রায় ছয়টি রুটে মেট্রো চালানোর কাজ চলছে।
ভূগর্ভস্থ ও উড়াল, উভয় প্রকার ষ্টেশন রয়েছে কলকাতা মেট্রোর। প্যারিস মেট্রোর মতো কলকাতা মেট্রোতেও দেশের বিভিন্ন মণীষী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে স্টেশনের নামকরণ করা হয়ে থাকে। পার্ক স্ট্রিটের মেট্রো ভবনে কলকাতা মেট্রোর সদর কার্যালয় অবস্থিত।
কলকাতা মেট্রোর প্রথম রুটটি, অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণ লাইনটি উত্তরে দক্ষিণেশ্বর থেকে দক্ষিণে কবি সুভাষ অর্থাৎ নিউ গড়িয়া পর্যন্ত ৩১.৩৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও এই রুটে মোট স্টেশনের সংখ্যা ২৬ টি। নোয়াপাড়া, বরাহনগর হয়ে লাইনটি দক্ষিণেশ্বর অবধি সম্প্রসারিত হয়েছিল ২০২১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি।
১৯৪৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের তদনীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় কলকাতার ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের জন্যে কলকাতায় একটি ভূগর্ভস্থ রেলপথ নির্মাণের কথা ভাবতে শুরু করেন। একটি ফরাসি বিশেষজ্ঞ দলকে দিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়। এর প্রায় দু-দশক পর ১৯৬৯ সালে কলকাতার ট্রাফিক সমস্যা সমাধানে মেট্রোপলিটান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট রেলওয়ে নামক এক প্রকল্প নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা মাস্টার প্ল্যান দেন, কলকাতার জন্য মোট ৯৭.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাঁচটি মেট্রো লাইনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পাঁচটির মধ্যে তিনটিকে বেছে নেওয়া হয়৷ দমদম-টালিগঞ্জ, দক্ষিণেশ্বর-ঠাকুরপুকুর এবং বিধাননগর-রামরাজাতলা। ১৯৭২ সালের ১ জুন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ১৯৯১ সালের মধ্যে তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর তদানিন্তন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়।
১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসপ্ল্যানেড-ভবানীপুর ৩.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে ভারতের প্রথম তথা এশিয়ার পঞ্চম মেট্রো পরিষেবা কলকাতা মেট্রোর উদ্বোধন করেন। সেদিন তপন কুমার নাথ এবং সঞ্জয় শীল মেট্রো চালানোর দায়িত্বে ছিলেন। ওই বছরই ১২ নভেম্বর চালু হয় দমদম-বেলগাছিয়া রুটটি। ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল টালিগঞ্জ অবধি মেট্রো সম্পসারিত হয়। ২২ নভেম্বর ১৯৯২-এ দমদম-বেলগাছিয়া অংশটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুবছর ১৯৯৪ সালের পর ১৩ আগস্ট দমদম-বেলগাছিয়া শাখাটিকে শ্যামবাজার অবধি সম্প্রসারিত করা হয়। ওই বছর ২ অক্টোবর এসপ্ল্যানেড-চাঁদনি চক অংশ চালু হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে শ্যামবাজার-শোভাবাজার-গিরিশ পার্ক ও চাঁদনি চক-সেন্ট্রাল অংশ দুটি চালু হয়। গিরিশ পার্ক থেকে সেন্ট্রাল অবধি মেট্রো চলাচল শুরু হয় সেই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বরে। ২০০৯ সালে টালিগঞ্জ, মহানায়ক উত্তমকুমার) থেকে গড়িয়া পর্যন্ত নতুন মেট্রোপথের সূচনা করা হয়। ২০১৩ সালে দমদম থেকে নোয়াপাড়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত নতুন মেট্রোপথের চালু করা হয়। ২০২২ সালে শিয়ালদা সেক্টর ফাইভ মেট্রো চালু হয়েছে। জোকা মেট্রোর ট্রায়াল রানও শুরু হয়েছে। এখন গঙ্গার নীচ দিয়ে মেট্রো চলাচলের প্রস্তুতিও প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে। গত বছর নন এসি রেক বিদায় নিয়েছিল।
তবে আজকের কলকাতা মেট্রোর নেপথ্যে রয়েছে ইতিহাস। ১৯১৯ সালে কলকাতায় প্রথম মেট্রোর ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ আমলে এই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর প্রথম প্রস্তাব ওঠে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯২৩ সালে তহবিলের অভাবে সেটি সম্ভব হয়নি। সব ঠিক থাকলে ১৯২১ সালেই কলকাতা পেতে পারত দেশের প্রথম মেট্রো। সাহেবদের দৌলতে কলকাতা হয়ে উঠেছিল প্রাচ্যের 'লন্ডন'। ১৮৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে পৃথিবী প্রথম ভূ-গর্ভস্থ ট্রেন দেখল।
১৯২১ সালে গঙ্গার পশ্চিমে হাওড়ার সঙ্গে পুবের ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের যোগাযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। সেই সময়ই লন্ডনের মতো টিউব রেল বা মেট্রোর প্রস্তাব। এপারে বাগমারি থেকে ওপারে হাওড়ার শালকিয়া পর্যন্ত ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা হল। টিউব রেলের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার হার্লে হিউ ডালরিম্পল হেকে দায়িত্ব দেওয়া হল। কাজের প্রস্তুতি, মাটি পরখ চলছে, ক্যালকাটা কমিউনিকেশন কমিটির রিপোর্টকে মান্যতা দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রেল দপ্তর। বাজেটও করা হয়েছিল, ৩৫ লক্ষ ২৬ হাজার ১৫৪ পাউন্ড ইউরো। সাড়ে চার বছরে কাজটা শেষ করার পরিকল্পনা করা হল। টিকিটের দাম ধরা হয়েছিল তিন আনা। কিন্তু ভাঁড়ারে টান পড়ল, ১৯২৩ সালে কাজ থেমে গেল। বন্ধ হয়ে গেল ব্রিটিশ ভারতের ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প। ডালরিম্পল সাহেবও ফিরে গেলেন লন্ডন। কিন্তু কালের নিয়মে কলকাতা মেট্রো পেল। গঙ্গার তলা দিয়েও মেট্রো ছুটবে কদিন পর থেকে।