সাপ বঙ্গে বহুকাল ধরেই পূজিত হয়ে আসছে। তবে কেবল বিষহরি মা মনসা নয়, বাংলা এক অঞ্চলে বিশেষভাবে পূজিত হন মা। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেবী জ্ঞানে বিষধর কেউটে সাপের পুজো করা হয়। মঙ্গলকোটের মুসারু, পলসোনা ও ছোট পোষলা, এবং ভাতারের বড় পোষলা গ্রামে বিষধর সাপ ঝঙ্কেশ্বরী মায়ের পুজো হয়। আবার কারও কাছে তিনি 'ঝাঁকলাই' নামেও পরিচিত। আগে সাতটি গ্রাম মিলিয়ে পুজো হলেও, বংশ পরম্পরায় প্রতি বছর পুজো করে আসছেন পূর্ব বর্ধমানের ভাতার ও মঙ্গলকোটের চারটি গ্রামের বাসিন্দারা। পুজোর দিনে মঙ্গলকোটের মুসারু, পলসোনা ও ছোট পোষলা, এবং ভাতারের বড় পোষলা গ্রামে মায়ের দেখা মেলে। প্রায় ৫০০ বছর ধরে মায়ের পুজো চলে আসছে।
লোকমুখে শোনা যায়, এখানকার কোন এক রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে খুনগড়ের মাঠে প্রথম পুজো শুরু করেন। এই দেবীকে নিয়েও নানা জনশ্রুতি রয়েছে। অনেকেই বলেন কৃষ্ণ যে কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন সেই নাগই এই 'ঝঙ্কেশ্বরী'। আবার কেউ কেউ বলেন, মনসামঙ্গল কাব্যে লখিন্দরকে যে কালনাগিনী দংশন করেছিল বেহুলার অভিশাপে সেই কালনাগিনীই বিষহীন অবস্থায় বংশবিস্তার করে এই গ্রামগুলিতে বিচরণ করছে। আবার অনেকের মতে, ঝঙ্কার করে গঙ্গা নেমে আসে। সেই ঝঙ্কারিনী শব্দ থেকেই দেবী ঝঙ্কেশ্বরী।
গ্রামবাসীরা বলেন, সারাবছরই দেবী ঝঙ্কেশ্বরী গ্রামবাসীদের অবাধ বিচরণ করেন। কাউকে দংশন করে না। দংশন করলেও তা দেবীর প্রসাদ হিসেবে মনে করা হয়। ঝাঁকলাই কামড়ালে ঝঙ্কেশ্বরী মন্দিরের মাটি ক্ষতস্থানে দিয়ে দিলেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। পুজোর দিন ঝঙ্কেশ্বরী মন্দিরে আসেন স্বয়ং ঝাঁকলাই পুজো নেন পুরোহিতদের হাতে। প্রথমেই একটি সাপকে দুধ, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। সেই পুজো দেখতে সমবেত হন গ্রামবাসীরা।
গ্রামের রান্নাঘর, গোয়ালঘর, স্নানের ঘর, শোওয়ার ঘর, বাগান, রাস্তায় অবাধে ঘুরে বেড়ায় তারা। কিন্তু গ্রামবাসীদের কোন ভয় নেই। বর্ধমান স্টেশন বা গোলাপবাগ থেকে কাটোয়া লাইনের বাস ধরে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের রাস্তা পেরলেই মুসারু গ্রামের স্টপেজ পড়বে। মুসারু লোকমুখে মুসুরিতে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে টোটোতে মিনিট দশেক দূরে পলসোনা গ্রাম। এখানকার চারটি গ্রামের সবচেয়ে বড় উৎসব হল ঝঙ্কেশ্বরীদেবীর পুজো। এখানে কেউ নাগপঞ্চমী তিথি পালন করেন না।
জনৈক বিমান সামন্ত পয়ার ছন্দে লিখে গিয়েছেন,
'জরৎকারু মুনী জায়া ঝঙ্কেশ্বরী নাম
বাসুকী ভগ্নি আস্তিক মাতা করি প্রণাম'।
ঝঙ্কেশ্বরী নামের সঙ্গে জাঙ্গুলি দেবীর নামের ভাষাতাত্ত্বিক মিলের কথাও শোনা যায়। বৌদ্ধধর্মের এই দেবীও সাপেদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ঝঙ্কেশ্বরী পুজোর সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। লোকমুখে প্রচলিত পাঁচালিতে বলা হয়েছে,
'ন শো এগারো সনে কৃষ্ণা প্রতিপদে
প্রথম বরিখা কালে পড়িয়া বিপদে
আগমন হন দেবী খুনগড় ডাঙ্গায়'।
সেই হিসাব অনুযায়ী এই পুজো প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন। এই গ্রামে সাপকে ঝাঁকলাই বলে ডাকা হয়। এই নিয়েও নানা মত রয়েছে।
প্রথমে সাপের এমন অবাধ বিচরণ দেখা যেত পলসোনা, মুসুরি, বড় পোষলা, ছোটপোষলা, শিকত্তর, ময়দান এবং নিগন— মোট পাঁচটি গ্রামে। কিন্তু হাল আমলে নানা কারণে কয়েকটি গ্রামে সাপের সংখ্যা কমেছে। এখনও পলসোনা, মুসুরি, দুই পোষলা গ্রামেই ঝঙ্কেশ্বরীর মন্দির ও সাপের অবাধ বিচরণ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দিরটি আছে মুসুরি গ্রামে। সেখানে বাৎসরিক উৎসবে মেলা হয়। বছরে এক দিনের উৎসবে সকাল থেকেই আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। প্রথমে একটি সাপকে দুধ, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। সেই পুজো দেখতে গ্রামবাসীদের ঢল নামে। এর পরে গ্রামের সকল বর্ণের মানুষ নৈবেদ্য নিয়ে আসেন। কিন্তু সবার পুজো এক সঙ্গে হয় না। কারণ, এখানে বর্ণভেদ রয়েছে। পুজোর শেষে বলি হয়। বলির পরে যজ্ঞ হয়। তার পরে সন্ধ্যায় চার গ্রামের চার জন পুরোহিত ক্ষীর কলসি নিয়ে যান খুনগড়ের মাঠে। সেখানে কলসিতে কলসিতে ঠোকাঠুকি করে মন্দির ফিরে আসা হয়। মন্দিরের সামনে সেই কলসি ভাঙা হয়। গ্রামবাসীরা কলসির ভাঙা টুকরো বাড়িতে রেখে দেন। জনশ্রুতি রয়েছে ভাঙা টুকরো বাড়িতে রাখলে কোন বিষাক্ত সাপ আসে না।
পোষলার দেবীমন্দিরে আছে কষ্টি পাথরের শিলা, ওটাই ঝঙ্কেশ্বরী দেবী। পলসোনা মন্দিরের ভিতর রয়েছে লৌকিক নারীর শিলা মূর্তি, তাঁর এক চোখ কানা। অথচ মনসাদেবীর সঙ্গে তুলনা করা হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামের বিস্তারের সময়ে প্রান্তবাসী হিন্দুরা গৌণ দেবদেবীদের প্রতিষ্ঠা করছেন। লৌকিক দেবদেবীরাই ধীরে ধীরে তা মূল ধর্মের মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে। এই গ্রামে সাপ মারা হয় না। সাপ মারা গেলে তাকে কলসিতে ভরে রেখে দেওয়া হয়। সাত দিনের মাথায় তা গঙ্গাতে ভাসিয়ে দিয়ে আসা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে সাপের পুজো এবং মনসা পুজোর চল আছে৷ কিন্তু কোথাও সাপের সঙ্গে মানুষের এমন সহাবস্থান দেখা যায় না৷ পোষলা গ্রাম এবং পোষলার ঝঙ্কেশ্বরীর মেলা বিখ্যাত৷ ঝাংলাইচণ্ডীর মন্দিরের মেলা, এক ডাকে সবাই চেনেন। আষাঢ় বা শ্রাবণের গুরু পূর্ণিমার পরে প্রতিপদে মেলা বসে৷ মেলার সময় গ্রামে সাপ অর্থাৎ ঝাংলাই মা বের হয়৷ পথেঘাটে দেখা দেন৷ পোষলার দেবী মন্দিরে রয়েছে কষ্টি পাথরের কালো শিলা, তাই ঝঙ্কেশ্বরী দেবী৷ মা নিত্য পূজিতা৷ মুসারু বা মুসুরি গ্রাম থেকে ব্রাহ্মণ এসে নিত্য পুজো করেন এখানে৷ শোনা যায়, শিলা দীর্ঘকাল নিমগাছের তলায় পড়েছিল। প্রথমে স্বপ্নাদেশ পেয়ে সাতকড়ি দে ছোট্ট মন্দির করে ওই শিলা
প্রতিষ্ঠা করেন৷ কালে কালে বিশাল মন্দির, নিত্য ভোগ-পূজা এবং বছরের বিশেষ দিনে জাঁকিয়ে মেলা৷
দুধ, গাছের প্রথম ফল, খেতের সবজি, থালায় নৈবেদ্য সাজিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা। মা ঝঙ্কেশ্বরীর নিত্যভোগে আসে গৃহস্থের গাছের প্রথম ফল, কলা, বাতাবি লেবু, খেতের সবজি৷ আগে ঠাকুরের জন্য নিবেদন৷ ব্রাহ্মণের হাত ঘুরে -ফিরে আসে সংসারের গৃহকোণে৷ প্রথম বাচ্চা হওয়া গাভীর ২১ দিন পরের প্রথম দুধ, তাও নিবেদিন করার রেয়াজ৷
বিজ্ঞান বলে, কেউটে সাপেরই একটি উপপ্রজাতি ঝঙ্কেশ্বরী। মাথার পিছনের চক্র থাকে যা সাধারণ কেউটে সাপের ঘাড়ের কাছে থাকে এবং আকারে বড় হয়। ঝঙ্কেশ্বরীর চক্র ছোট এবং তা একেবারে ফণার মাঝে অবস্থিত। এর বিষ সাধারণ কেউটে সাপের চেয়েও তীব্র। শোনা যায়, সাপ কখনও কাউকে কামড়ায় তাহলে মুসারু গ্রামের বিষ পুস্করিণীর জলে স্নান করলেই বিষমুক্তি ঘটে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এই সাপ মানুষকে কাটে না। শুধু বছরে একটিবার পুজো পেলেই সন্তুষ্ট দেবী ঝঙ্কেশ্বরী। আজ পাঁচ শতাব্দী ধরে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের কৃষ্ণা-প্রতিপদ তিথিতে পাঁচটি গ্রামে পূজিতা হন দেবী ঝঙ্কেশ্বরী।