একটা ফুটফুটে মেয়ে। সদ্য যুবতী। এক বিরাট পুলিশ পরিবারের বউ হয়ে এসেছে মেয়েটি। জন্ম কাশ্মীরে হলেও মেয়েটি সব রকম আদব-কায়দায় বেশ অভ্যস্ত। তবে মাঝে মাঝেই বাড়ির কাজকর্ম করতে করতে উধাও হয়ে যায় মেয়েটা। বাথরুমে বা রান্না ঘরের কোনও কোণায় এমনকী নিজের শোয়ার ঘরের একটা ছোট্ট কোণায় সে একটা গোপন যন্ত্র খুলে বসে। সেখান থেকে কাকে যেন বিভিন্ন বার্তা পাঠায় মেয়েটা। সারাদিন উদাসী, ঝিম মেরে থাকা মেয়েটা এই বার্তাগুলো পাঠিয়ে হঠাৎ করে চনমনে হয়ে ওঠে। তারপর প্রতিবার্তা পাওয়ার জন্য মেয়েটার অপেক্ষা চলে। এভাবেই মেয়েটার সারাদিন কাটে।
পাকিস্তানের পরিবারে এসেও মেয়েটা ভোলে না তার নিজের দেশকে। মাঝে মাঝেই নিজের দেশের সঙ্গীত শোনে, দেশের পতাকা ছুঁয়ে দেখে সে। ভেতর ভেতর একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। সেই অনুভূতিটা জমিয়ে রাখে মেয়েটা। সে জানে নিজের দেশকে সে কখনোই ভুলবে না। কোনও ভাবেই বঞ্চিত করবে না নিজের মাতৃভূমিকে। বলা ভালো মাতৃভূমির জন্যই মেয়েটা পাকিস্তানের এই পরিবারটায় বিয়ে করে এসেছে। আসলে ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করছে পাকিস্তানে।
১৯৭১-এর যুদ্ধের আগে এই মেয়েটা এভাবেই ভারতবর্ষকে পাকিস্তানের গোপন খবর পৌঁছে দিত। রান্নার আদা-হলুদ-মশলা, সংসারের যাবতীয় দায়িত্বের মাঝে সে আসলে দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করত। গল্পটা চেনা লাগছে! ২০০৮ সালে আলিয়া ভাট অভিনীত ‘রাজি’ সিনেমার গল্পের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়! কিন্তু এটা আসলে গল্প নয়। লড়াই, যন্ত্রণা আর রক্ত মাখানো বাস্তব।
সেহমত খান নামে ভারতীয় এই গুপ্তচরের কথাই বর্ণনা করা হয়েছিল রাজি সিনেমার মাধ্যমে। সেহমত খান কাশ্মীরের বাসিন্দা ছিলেন। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। ছোট থেকেই সাহসী, ডাকাবুকো ছিলেন সেহমত। তবে গুপ্তচরবৃত্তির কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। নিজেকে একেবারে ওলটপালট করে গড়ে-পিঠে নেন সেহমত। তারপর বিবাহসূত্রে পাড়ি দিয়েছিলেন পাকিস্তানে। সেখানে তিনি ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। পাকিস্তানের এক সেনা আধিকারিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু মূলত গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্যেই ওই পরিবারের তিনি বিয়ে করেন। ওখান থেকে পাকিস্তানের নানা গোপন তথ্য তিনি ভারতকে পাঠাতেন।
১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যূদ্ধের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এমন একজন গুপ্তচরের প্রয়োজন ছিল, যে পাকিস্তান থেকে শত্রুর গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারে। এর জন্য একজন কাশ্মিরী ব্যবসায়ী তাঁর মেয়ে সেহমতকে সেখানে গিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে রাজি করান।
তিনি, তাঁর বাবা এবং দেশের স্বার্থে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন। সেহমতের বুদ্ধিমত্তার জন্যেই ভারত তার অনেক অভিযান সম্পন্ন করতে পেরেছিল।
সেহমত খানকে নিয়েই হরিন্দর সিক্কা তার বই লিখেছিলেন "কলিং সেহমত"। সেহমত খান তাঁর কাজ শেষ করে যখন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন, তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর সন্তানও পরবর্তী সময়ে সেনা আধিকারিকের পদেই যোগ দান করেছিলেন। এই সন্তানের কথা শুনেই হরিন্দর সিক্কা 'কলিং সেহমত' বইটি রচনা করেছিলেন। ভারতের মহিলা গুপ্তচরদের মধ্যে অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিলেন সেহমত খান।