জহুরা কালী বলতেই আমাদের উত্তরবঙ্গের কথা মনে পড়ে, কিন্তু বাংলার দক্ষিণ প্রান্তেও রয়েছে একই নামের কালী মন্দির। হাওড়া শিবপুর অঞ্চলের বিখ্যাত কালী মন্দিরগুলির মধ্যে একটি হল, শ্রী শ্রী জহুরা কালী মন্দির। অপ্রকাশ মুখার্জী লেনে মন্দিরটি অবস্থিত। ১৯৭০ সালে স্থানীয় কালী সাধক শ্রী তঙ্কুরাম ভট্টাচার্য একটি দর্মার বেড়া দেওয়া ঘরে জহুরা কালীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ভক্তরা তা সংস্কার করেছেন। পাকা মন্দির হয়েছে। অধুনা যে মন্দির রয়েছে, সেখানে মায়ের যে মূর্তিটি বর্তমানে পূজিত হচ্ছে তা তঙ্কুরাম ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠিত মূল মূর্তি নয়। মূল মূর্তিটি গর্ভগৃহের তলায় মাটির নীচে প্রথিত রয়েছে। এখনকার মূর্তিটি সিমেন্ট নির্মিত। মূর্তির সামনে অবস্থিত ঘটের নীচেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে মূল দেবী মূর্তিটি।
রক্তবর্ণ, লোলজিহ্বা, ত্রিনেত্রা, বরাহ দন্তিকা রূপেই বিরাজ করেন জহুরা কালী। মালদায় সেই রূপ এক মাটির মুখোশ নির্মাতার সাহায্যে প্রস্তুত করেন এবং তার প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করেন সেই সাধক। এই মুখোশ মালদায় মুখা নামেও পরিচিত। হাওড়ার জহুরা কালী মন্দিরে প্রতিদিন দুবেলা মায়ের নিত্য পুজো হয়। প্রতি অমাবস্যায় যজ্ঞ হয়। কালীপুজোর দিনে মায়ের বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। অমাবস্যার দিনগুলিতে মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়। মায়ের প্রধান ভোগ হলো মান। ভোগে খিচুড়ি বা লুচির ব্যবস্থা থাকলেও, মানকচু ভোগ অবশ্যই দেওয়া হয়। প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারি মায়ের বাৎসরিক উৎসব উদযাপিত হয়। যজ্ঞের পাশাপাশি চণ্ডীপাঠের আয়োজনও করা হয় দিনটিতে। বাৎসরিক পুজোর দিন মাগুর মাছ বলি দেওয়া হয়। পয়লা জানয়ারিতে জহুরা কালীর মন্দিরে বহু ভক্তদের সমাগম হয়। বলা হয়, সতী পীঠ মরুতীর্থ হিংলাজের হিঙ্গলা মা অর্থাৎ দেবী হিঙ্গলা কালিকার আদলেই জহুরা মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। গবেষকরা, বাংলার দুই প্রান্তের দুই জহুরা কালীকে হিংলাজের দেবীর প্রতিচ্ছবি বলেছেন।
মালদায় রয়েছে তিনশো বছরের প্রাচীন জহুরা কালী। স্থানীয়দের এবং ভক্তদের বিশ্বাস দেবী মনোবাঞ্ছার কৃপাকল্পতরু। দেবীর কাছে যে মনোবাসনা নিবেদন করা হয়, তিনি তাই পূরণ করেন। এই বিশ্বাস থেকেই দেবীর মন্দিরে ভিড় উপচে পড়ে। কাতারে কাতারে মানুষ আসেন পুজো দিতে। শোনা যায়, দেবীর স্বপ্নাদেশেই মন্দিরের জন্ম হয়েছিল। কথিত আছে, ৩০০ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের এক সাধক স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবী জহুরা কালীর আরাধনা শুরু করেছিলেন। ওই সাধকের আরাধনার স্থানেই গড়ে উঠেছে আজকের জহুর কালী মন্দির। মালদার ইংরেজবাজারের রায়পুর গ্রামে আমবাগানের মধ্যে এই মন্দির অবস্থিত। একটা সময় অবধি এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা, দুই জায়গা থেকেই এই মন্দিরে ভক্তরা পুজো দিতে আসতেন। এখন রাজ্যের বাইরে বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকেও মানুষ পুজো দিতে আসেন।
বছরভর মন্দিরে পুজো চলে। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল, এখানে পুজো হয় দিনের বেলায়। কালীকে এখানে দেবী চণ্ডীরূপে আরাধনা করা হয়। সপ্তাহে কেবল শনি ও মঙ্গলবার বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। বৈশাখ মাসের শনি ও মঙ্গলবার বিশেষ পুজোর আয়োজন থাকে। বৈশাখ মাসে এখানে মেলাও বসে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এই মন্দির তিনশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। বরং, আরও অনেক আগের থেকে চালু আছে। বলা হয়, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন মালদায় অনেকগুলো মন্দির তৈরি করেছিলেন। তারই অন্যতম জহুরা কালীর মন্দির। সে সময় এই অঞ্চলে ছিল ঘন জঙ্গল ঢাকা। ডাকাতরাই দেবীর পুজো করত। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধন, সম্পদ, রত্ন, হীরে লুঠ করে এনে, এখানেই মাটির নীচে পুঁতে রাখত। সেই ধনরত্ন, হীরে, জওহর থেকেই দেবীর নাম হয়েছে জহুরা কালী। কালীর রূপ দেবীচণ্ডী। তাঁরই আরাধনা হয় এখানে।
মন্দিরের গায়ের পাথরের ফলক থেকে অনুমান করা যায়, ৩০০ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের এক সাধক দেবী জহরা চণ্ডীর বেদি স্থাপন করেছিলেন। তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। ১২১৩ বঙ্গাব্দ থেকে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল। কথিত আছে, ছল্ল তিওয়ারি নামে উত্তরপ্রদেশের এক মাতৃ সাধক দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। স্বপ্নাদেশে রায়পুর গ্রামের এই আমবাগানে দেবী জহরা চণ্ডীর বেদী স্থাপন করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে হীরারাম তিওয়ারি নামের এক সাধক দিব্যদর্শনে দেবীর রূপ প্রত্যক্ষ করেন। সেই অনুযায়ী, তিনি মূর্তির রূপলেখা তৈরি করেন বৈশাখ মাসে। যদিও তা প্রচলিত দেবী মূর্তির মতো নয়। লাল রঙের ঢিবির ওপর রয়েছে এক মুখোশ। ঢিবির দু’পাশে আরও দু’টি মুখোশ দেখা যায়। এছাড়া গর্ভগৃহে আছে শিব আর গণেশের মূর্তি। বৈশাখ মাসে দেবী জহরার পুজো এভাবেই প্রচলিত হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, বহু বছর আগে দেবী জহরার পূর্ণাবয়ব মূর্তি ছিল এই মন্দিরে, তা পূজিতও হত। বিধর্মীদের হাত থেকে দেবী মূর্তিকে রক্ষা করার জন্য পুরোহিতরা সেই মূর্তিকে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিলেন।
এখন অর্থাৎ বৈশাখ জহুরা দেবীর প্রতিষ্ঠা মাস, সেই উপলক্ষ্যে বড় মেলা বসে। মূল মন্দিরটি পঞ্চরত্ন। আর পাঁচটা সাধারণ কালী মন্দিরের মতো দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে পুজো রাতে হয় না এখানে। দিনের আলোয় দেবী জহরার আরাধনা চলে। বংশপরম্পরায় তেওয়ারিরাই এখানে পুজো করেন। দিনের আলোতেই পুজো হয়। সন্ধ্যার পর আর পুজো হয় না। শুকনো বাতাসা, সন্দেশ ভোগ হয়। মন্দিরে ছাগবলির প্রচলন রয়েছে।