তিন শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গুহ্যকালীমন্দির

আজ কালী কথায় আমরা কালী সাধনার পবিত্র ক্ষেত্র বীরভূমে যাবো। তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান বীরভূমের রামপুরহাট থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং নলহাটি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ভদ্রপুর গ্রামে দেবী গুহ্যকালিকা বা গোপন কালীর মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের বয়স প্রায় তিনশো বছর। ১১৭৮ সনে রটন্তী কালী পুজোর দিন ব্রাহ্মনী নদীর তীরে, ভদ্রপূর গ্রামের রাজা নন্দন কুমার রায় প্রতিষ্ঠা করেন গুহ্যকালি। সাধক বামাখ্যাপা কালী মাকে বেদের বেটি বলতেন।  
 
পবিত্র গঙ্গার উপনদী ব্রাহ্মণী নদী। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুধুয়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে, বীরভূমের নারায়ণপুরের কাছে বাংলায় প্রবেশ করেছে ব্রাহ্মনী। নদী বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদী তীরে, বীরভূমের নলহাটির ভদ্রপুর গ্রামের পশ্চিমে আকালিপুর গ্রামেই রয়েছে মহারাজ নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালী মন্দির। আকালির গুহ্যকালির মাহাত্ম্য প্রচার হয় এই নদীকে কেন্দ্র করে। শোনা যায়, এখানে নরবলি হিসেবে একটি শিশুকে বলি দেওয়া হয়েছিল এবং শিশুটির মা যখন গুহ্যকালির কাছে প্রার্থনা করে তখন ব্রাহ্মণীর নদীর জল তার প্রান ফিরিয়ে দেয়।
 
নন্দকুমার ১৭৭৫ সালে মায়ের এই মূর্তিকে তন্ত্র সম্মতভাবে বেদীমূলে স্থাপন করেন। গুহ্য কথার অর্থ গোপন। এই মাতৃমূর্তি ও তাই গৃহীদের কাছে অপ্রকাশ্য, একমাত্র সাধকদেরই আরাধ্যা দেবী তিনি। সচরাচর কালীমূর্তি যেমন হয় গুহ্যকালী মূর্তি সে রকম নয়।
 
Gujyakali1
 
 
আকালী গুহ্যকালী, হিন্দু দেবী কালীকার বিশেষ রূপ। এই অষ্টকোনাকৃতি মন্দিরে স্থাপত্য শৈলী মন্দিরের নিরাপত্তা কথা স্মরণে রেখেই তৈরি হয়েছে। দেবী মূর্তিটিকে মন্দির থেকে বের করে নেওয়া অসম্ভব। মায়ের অষ্টকোণাকৃতি মন্দির সাধকের যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত‍্যাহার, ধারণা, ধ‍্যান ও সমাধি- এই অষ্টাঙ্গিক যোগের সাক্ষ্য বহন করে। 
 
এখানে দেবীকে দেখা যায় পা মুড়িয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহের পঞ্চমুন্ডির আসনের উপর সর্পের বেদীতে দেবী পা মুড়িয়ে বসে আছেন। কষ্টি পাথরের তৈরি দেবী মূর্তি আজকের নয়। এই মূর্তির এক বিশাল ইতিহাস রয়েছে। যে ইতিহাসের শুরু মগধরাজ জরাসন্ধের সময়কাল থেকে, মগধরাজ জরাসন্ধ দুই হাত সর্পাসিনী, নর মুণ্ড মল্লিনী দেবী পুজো করতেন। দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, তিনি মহাশক্তি দেবী শতাক্ষীর শরীর থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। গুহ্যকালী কালীর ভয়ংকরী রূপ ভূ-ভারতে কোথায়ও দেখতে পাবেন না। গুহ্যকালীর রূপ ভয়ংকর। গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণীয়।
 
তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র, স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত, মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র, কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার, হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা। দেবীর বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ, বামে বৎসরূপী শিব, তিনি নবরত্নভূষিতা, নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন, তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।
 
তবে কালীমূর্তির বিশেষত্ব হল আকালীপুরের দেবী গুহ‍্যকালীর পদতলে শিব নেই। সাধারণত আমরা কালীদেবীর পায়ের তলায় শিবকেই দেখতেই আমরা অভ‍্যস্ত। কিন্তু সাধক রামপ্রসাদ বলছেন, শিব নয়, মায়ের পদতলে পড়ে থাকেন শব এবং শিব হবার আশায়। মা কালী করেছেন অসুর নিধন। তাই কালী শিবারূঢ়া নন, তিনি শবারূঢ়া। তাই মায়ের পায়ের তলায় শিব নয়, পড়ে আছেন শব অর্থাৎ নিহত দৈত্যের দেহ বা মৃতদেহ।
 
রামপ্রসাদ লিখে গিয়েছেন-
 
"শিব নয় মায়ের পদতলে।
ওটা মিথ্যা লোকে বলে।।
দৈত‍্য বেটা ভূমে পড়ে।
মা দাঁড়াবে তাহার উপরে।।
মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ।
শিবরূপ হয় রণস্থলে।।"
 
এবার মন্দির প্রতিষ্ঠার গপ্পো বলি, মহাভারত অনুযায়ী, মগধরাজ জরাসন্ধ পাতালে মন্দির তৈরি করে গোপনে এই গুহ‍্যকালীর আরাধনা করতেন। এরপর মগধের রাজা ভীমের হাতে নিহত হন। দেবী থেকে যান পাতলেই। আনুমানিক ২৩৫ বছর আগে রানী অহল্যা বাঈ স্বপ্নে একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পান। স্বপ্নে পাওয়া এই শিবলিঙ্গ অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি বিভিন্নস্থানে খনন কার্য শুরু করেন। তখনই তিনি মায়ের এই গুহ্যকালী মূর্তি পান। কিন্তু রাণী যেহেতু শিবলিঙ্গ খুঁজছিলেন, তাই রানী অহল্যা বাঈ মায়ের এই মূর্তি কাশীরাজ চৈত সিংকে দান করেন। তবে কেউ কেউ বলেন, কাশীর রাজা চৈত সিংয়ের এই মূর্তিটি খুঁজে পেয়ে পুজো করা শুরু করে রাজ প্রাসাদে।
 
 
Gujyakali2
 
 
এরপর ব্রিটিশ আমলে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কাশী থাকার সময় এই মূর্তিটিকে দেখতে পান এবং তিনি এটিকে ইংল‍্যাণ্ডে নিয়ে গিয়ে সেখানকার যাদুঘরে রাখার পরিকল্পনা করেন। যখন হেস্টিংস রাজা চৈত সিংয়ের প্রাসাদ লুট করেন তখন সম্পত্তির সাথে মূর্তিটি লুট করেন। অন্য একটি কিংবদন্তি মতে, চৈত সিং মায়ের মূর্তির পুজো শুরু করেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের নজর পড়ে মায়ের এই অপরূপ মূর্তির উপর। হেস্টিংস সেই সময় কাশীতেই ছিলেন, মায়ের কারুকার্যমন্ডিত মূর্তি দেখে তার লোভ হয়।
 
তিনি মায়ের এই মূর্তিটিকে ইংল্যান্ডের মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। তার এই গোপন পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে যান চৈত সিং। তিনি তখন মায়ের মূর্তিটিকে গঙ্গাবক্ষে লুকিয়ে রাখেন। আর তিনি রটিয়ে দেন যে মূর্তি চুরি গিয়েছে। মায়ের বিগ্রহ রক্ষার কোনো উপায় না পেয়েই সেটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছিলেন চৈত সিংহ।
 
এরপর স্বপ্নে মা স্বয়ং মহারাজা নন্দকুমারকে তাঁর বাসভূমির কাছে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার আদেশ দেন। তিনি চৈত সিংকে সব খুলে বলেন। চৈত সিং সব শুনে তো হাতের কাছে চাঁদ পেলেন। এরপর কাশীরাজের সহায়তায় মহারাজা নন্দকুমার কাশীর গঙ্গা থেকে মাতৃবিগ্রহ তুলে নৌকো করে দ্বারকা নদী এবং দ্বারকা থেকে এলেন ব্রাহ্মণী নদীপথে এই আকালীপুরে।
 
নন্দকুমারের ভিটে ভদ্রপুরের কাছে নৌকোর গতি নিয়ন্ত্রণে এলো না, নৌকো এসে থামল আকালীপুরে। বীরভূমের নলহাটি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরেই মহারাজা নন্দকুমারের ভিটে আকালীপুরে অবস্থিত। গ্রামের এক বটবৃক্ষের নিচে এই দেবীর পুজো শুরু করেন নন্দকুমার এবং মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হল মাতৃবিগ্রহ। ব্রাহ্মণী নদীতটে শ্মশানধারে মায়ের সেই পাথরের তৈরি প্রতিষ্ঠাবেদি এখনও রয়েছে। এখানেই ব্রাহ্মণী নদীর তীরে পুরোদমে চলছিল গুহ‍্যকালী মন্দির তৈরির কাজ।
 
এরপর ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস চক্রান্ত করে ১৭৭৫ সালের ৫ই আগস্ট বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ান মহারাজা নন্দকুমারকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে কলকাতার কলুটোলায় ফাঁসি দিলে, মাঝপথেই থেমে গেল মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজ। পরে পুত্র গুরুদাস অসম্পূর্ণ মন্দিরেই কষ্টিপাথরে তৈরি সর্পভূষণা মাতৃবিগ্রহ গুহ‍্যকালীর প্রতিষ্ঠা করছিলেন। তিনি পুত্র গুরুদাসকে মাতৃবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েই গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণী নদী তীরে শ্মশানের পাশে নিরিবিলি স্থানে মায়ের আটকোনা ইটের মন্দির, সর্বসাধারণের কাছে এই মন্দিরের নির্মাণ বড় সাদামাটা মনে হলেও, আদপে তন্ত্রসম্মতভাবে সাধনার উপযোগী স্থানেই এই মন্দির নির্মিত হয়েছে। আজও নন্দকুমারের বংশধররা মায়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে বহাল রয়েছেন।​​
 
মকর সংক্রান্তির পূন্য তিথিতে এখানকার ব্রাহ্মণী নদীতে পুণ্যস্নান আয়োজিত হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই প্রায় ২৫০ বছর আগে থেকেই মকর সংক্রান্তির দিন নদীতে স্নানকে কেন্দ্র করে এখানে মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই মেলা হয়। একসময় বিশাল এলাকা জুড়ে এই মেলা হত। পরবর্তীকালে জায়গা কমে যাওয়ার কারণে মেলা কিছুটা হলেও ছোট হয়েছে। 
 
দেবীর শরীরে সাপ জড়িয়ে রয়েছে। এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে মায়ের পুজো হয়। রাতে এখানে মায়ের কোনও পুজো হয় না। গুহ‍্যকালীর মন্দিরে রাতে কেউ থাকে না, পুজো-পাঠ-দর্শন সেরে সন্ধ্যার আগেই ফিরে যান সবাই। কথিত আছে, আকালিপুরের গুহ্যকালী নিশি রাতে এখানকার শ্মশানে লীলা করেন। সন্ধ্যার পরেই মা নাকি মন্দির থেকে বেরিয়ে ভয়ংকর মূর্তি ধরে এখানকার শ্মশান এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তাই রাত নামার আগেই এলাকা ছাড়তে হয় সবাইকেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...