বীরাষ্টমী ব্রত কথা

দুর্গাপুজোকে আন্দোলনের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন স্বাধানতী সংগ্রামীরা। সেইসময়ই বিভিন্ন বিপ্লবী আখড়ায়, কুস্তির ঠেকে দেবী আরাধনা শুরু হয়। অষ্টমী তিথিতে কুস্তি প্রদর্শন হত, একইসঙ্গে বীরদের সম্মান জানানোরও রেওয়াজ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়তেও উত্তর কলকাতার একাধিক পুজোয় এই রীতি চলে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম বাগবাজার সার্বজনীন। পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা হয়, অষ্টমী তিথি অসুরবিনাশী শুদ্ধসত্তার আবির্ভাব তিথি। এদিন দেবী মহালক্ষ্মীরূপা বৈষ্ণবী শক্তি। দেবী রাজরাজেশ্বরী, তিনি ভক্তদের দুই হাতে বর দেন। তাই এদিনই বীর সন্তান লাভের জন্য বীরাষ্টমী ব্রত পালন করেন মহিলারা। আশ্বিনমাসের শুক্লা অষ্টমীতে এই ব্রত রাখা হয়। একবার করলে এই ব্রত আট বছর পালন করতে হয়। বীরাষ্টমী ব্রত ও প্রতাপাদিত্য উৎসব চালু করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে সরলাদেবী চৌধুরাণী। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ১৯০৩ সালে প্রতাপাদিত্য উৎসব ও বীরাষ্টমী ব্রত পালন করেছিলেন।

মারাঠিদের 'শিবাজী উৎসব' এর অনুকরণে তিনি কলকাতায় 'প্রতাপাদিত্য উৎসব' আরম্ভ করেছিলেন। মণিলাল গাঙ্গুলী একদিন তাঁর সাহিত্য-সমিতির সাংবৎসরিক উৎসবে সরলা দেবীকে সভানেত্রী হতে আমন্ত্রণ জানালেন। সরলা দেবী রাজী হলেন, কিন্তু একটি শর্ত দিলেন। শর্ত হল পয়লা বৈশাখ উৎসব করতে হবে এবং সেখানে 'প্রতাপাদিত্য উৎসব' অনুষ্ঠিত করতে হবে। সভায় কোনও বক্তৃতা রাখা হবে না। কেবলমাত্র প্রতাপাদিত্যের জীবনী পাঠ করা হবে। এই প্রতাপাদিত্য উৎসবের জন্য খুঁজে বের করতে হবে বাঙালি কুস্তিগীর, তলোয়ারধারী, বক্সিং এবং লাঠি বীরদের। সেই উৎসবে তাদেরই খেলার প্রদর্শনী হবে। প্রতাপাদিত্য উৎসব আলোড়ন তুললো গোটা অভিভক্ত বাংলায়। বিপিনচন্দ্র পাল, তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়াতে লিখেছিলেন - "As necessity is the mother of invention, Sarala Devi is the mother of Pratapaditya to meet the necessity of a hero for Bengal"সরলা দেবী ছোট ছোট বই আকারে বঙ্গের বীর সিরিজ প্রকাশ করলেন। এরপর প্রতাপাদিত্যের ছেলে উদয়াদিত্যের স্মরণে উদয়াদিত্য উৎসব আয়োজিত হল। মঞ্চের উপর একটা তরোয়াল রেখে সবাই বীর উদয়াদিত্যকে স্মরণ করে তাতে দেবে পুষ্পাঞ্জলি। এই উৎসবও তদানিন্তন যুব সমাজে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

আজও মহাআড়ম্বরে বীরাষ্টমী পালিত হয়। উত্তর কলকাতার অন্যতম সাবেক পুজো হল বাগবাজার সর্বজনীন। নেবুবাগানে ১৯১৯ সালে এই পুজো শুরু হয়। সে সময় পুজোর নাম ছিল নেবুবাগান বারোয়ারী। ১৯২৬ সালে নেবুবাগান বারোয়ারী নাম পাল্টে হয় বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব। এখানে মহাষ্টমীর পুজো দেখতে বহু মানুষ সমবেত হন। পরাধীন ভারতে বাগবাজারের এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেক বিপ্লবী। সেই সময় থেকেই অষ্টমীর দিন শরীরচর্চা, লাঠিখেলা থেকে শুরু করে নানা শারীরিক কসর‍তের মাধ্যমে দেবীকে অঞ্জলি দেওয়া হত। বাগবাজার সর্বজনীনে এই বীরাষ্টমী আজও মাতৃ আরাধনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কথিত আছে, সুভাষচন্দ্র বসু বীরাষ্টমী উৎসব চালু করেন। সেকালের প্রচলিত ধারণা ছিল, সাহেবসুবোরাই শক্তিমান, বাঙালি ভীরু, দুর্বল জাতি। এই ভাবনা খর্ব করতেই বীরাষ্টমীর উদ্‌যাপনের শুরু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জুডো, ক্যারাটে, বক্সিংও। স্বদেশী যুগে এই বীরাষ্টমী ছিল জনসংযোগের মাধ্যম। এখানে বীরাষ্টমী ব্রত উদযাপন হত নানান শারীরিক কসরতের মাধ্যমে। আর পাঁচটা পুজো মণ্ডপের থেকে একটু অন্যভাবে মায়ের পায়ে অঞ্জলি অর্পণ করা হত। শোনা যায়, এই বীরাষ্টমীতে জনতার ভিড়ে মিশে যেতেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা। মিশে গিয়ে ছড়িয়ে দিতেন বিপ্লবের বীর মন্ত্র। বছরের এই দিনটায় অনেক পরিকল্পনা থাকত। এখনও মহাষ্টমীর দিন এই ব্রত বজায় রেখেছে বাগবাজার সার্বজনীন। বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ,সুভাষচন্দ্র বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখদের নাম। আজও সগর্বে সেই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে এই পুজো। 

তবে বীরাষ্টমীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন নেতাজি। ১৯১৯-১৯২০ সাল নাগাদ নেতাজির উৎসাহে বাংলা জুড়ে বীরাষ্টমী শুরু হয়েছিল। তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কলকাতা, মেদিনীপুর, খুলনা, রাজশাহী গোটা বাংলার প্রতিটি প্রান্তে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বিপ্লবী দল। কিন্তু তারা বিচ্ছিন্ন। সবাইকে এক ছাতার তলায় আনতে পুজোর সময়কে বেছে নেওয়া হল। ব্যায়ামাগার, আখড়া, লাঠি খেলা, ছুরি খেলার ক্লাবদের নিয়ে অষ্টমীর দিনে লাঠি খেলা, ছুরি খেলার মাধ্যমে শক্তি রূপিণী দেবীকে বীর সন্তানদের অঞ্জলি। এই প্রথা আজও বজায় রেখে চলেছে সিমলা ব্যায়াম সঘিতি, বাগবাজার সার্বজনীন। বঙ্গ বীর-বীরাঙ্গনাদের তেজে

সে সময় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল প্রতিটি মণ্ডপ। ১৯২৬ সালে বিপ্লবীদের আখড়া বলে পরিচিত সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে দুর্গাপুজো শুরু হল। সিমলা ব্যায়াম সমিতি তখন পুলিশের নজরে। সার্বজনীন পুজোর কারণে সাধারণ মানুষের আনাগোনা বাড়ল, বিপ্লবীদের সুবিধা হল। সারা বছর ধরে তলোয়ার চালনা, কুস্তি প্রভৃতির চর্চা চলত। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনটিকে বেছে নেওয়া হত, 'বীরাষ্টমী দিবস' হিসেবে। উদ্দেশ্য বাঙালি জাগরণ।

১৯২৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেন নেতাজি। ১৯২৮ সালের কলকাতার বিভিন্ন দুর্গাপুজোর সঙ্গে তিনি যুক্ত হলেন। প্রথম থেকেই তিনি লাঠি খেলা, কুস্তি প্রভৃতিকে উৎসাহ দিতেন। তিনি যুক্ত হওয়ায় উৎসাহ আরও বাড়ল। ১৯৩০ সালে কলকাতার মেয়র হওয়ার পর, বেশ কিছু পুজো কমিটি নেতাজিকে সভাপতি করল। নেতাজির উদ্যোগে ক্লাবগুলিতে চালু হল বীরাষ্টমী। ফলে বৃহত্তর পরিসরে বাংলাজুড়ে বীরাষ্টমী পালিত হতে শুরু হয়েছিল।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...