স্বপ্নদেশে জন্ম হয়েছিল বেলঘরিয়ার রথযাত্রার

বর্ষার অন্যতম সেরা উৎসব হল জগন্নাথের রথযাত্রা, প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় রথ। বাংলার অন্যতম প্রাচীন রথযাত্রা হল মাহেশের রথ, প্রায় ছ'শো বছরের বেশি সময় যাবৎ সেই রথযাত্রা চলছে। রয়েছে মালাধর বসু কুলীন বর্ধমানের কুলীন গ্রামের রথ, তার বয়সও প্রায় পাঁচশো অতিক্রম করে ফেলেছে। বাংলায় গত দুশো-আড়াইশো বছরের মধ্যে অজস্র রথযাত্রার সূচনা হয়েছে। মন্দির, জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ি, বনেদি পরিবারদের উৎসব প্রিয়তা, ঈশ্বর ভক্তি বাংলাজুড়ে অজস্র রথের সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ রথযাত্রাই প্রায় ১৭৫০ থেকে ১৭৮০ মধ্যে শুরু হয়েছিল। তেমনই একটি দ্বিশতাব্দী প্রাচীন রথযাত্রা হল বেলঘরিয়ায় রথযাত্রা। এই রথযাত্রার কারণেই রথতলার জন্ম। বিটি রোড বরাবর ডানলপ পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক ব্যারাকপুরের দিকে এগোলেই স্টপেজ পড়বে রথতলা। সেখানকার বিখ্যাত ঘোষালদের রথের কথাই বলব।

IMG-20230619-WA0009

বাংলা ১২০১ বঙ্গাব্দ, ১৭৯৪ সাল। হঠাৎই একদিন বালির পাঠকবাড়ির কর্তা স্বপ্নাদেশ পেলেন। এখানে বলে রাখি, এই রথের শুরু স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে। এখানে বলা ভাল মাহেশের রথও শুরু হয়েছিল স্বপ্নদেশের মাধ্যমে। কথিত আছে, ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে জগন্নাথদেবের এক ভক্ত পুরী গিয়েছিলেন। দেবতার দেখা না পেয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন তিনি। ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে এসে গঙ্গার ধারে বসেছিলেন। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় ভাসমান একটি নিমকাঠ পান ধ্রুবানন্দ। সেই নিমকাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ নির্মাণ করে, প্রতিষ্ঠা করেন। তা আজও পূজিত হচ্ছে।

যে কথা হচ্ছিল, বালির পাঠকবাড়ির কর্তা স্বপ্নে আদেশ পেলেন, বালিঘাটে, গঙ্গায় নিমকাঠ ভেসে আসবে। সেই নিম কাঠ দিয়ে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণ করতে হবে এবং বেলঘরিয়ার ঘোষাল পরিবারে সেই মূর্তি পাঠাতে হবে। জগন্নাথ ঘোষালবাড়িতেই রথের পুজো গ্রহণ করবেন এবং উল্টো রথের দিন আবার বালিতে ফিরবেন। ওই একই সময়, স্বপ্নাদেশ পান বেলঘরিয়ার ঘোষাল পরিবারের কর্তাও। আজ থেকে প্রায় ২৩০ বছর আগে এই ঘোষালদের হাতেই বেলঘরিয়ার রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল। ঘোষাল পরিবারের প্রধান পিরিতরাম ঘোষাল শুরু করন পূজার্চনা। একেবারে প্রথমে রথটি ছিল দারু নির্মিত। কিন্তু দুর্ঘটনায় ভেঙে যাওয়ার পর লোহার রথ গড়া হয়েছে। বাংলার অধিকাংশই রথই প্রথমটায় কাঠ নির্মিতই ছিল, যদিও পরে কোনও না কোনও দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় সবই লোহা দিয়ে নতুন করে বানানো হয়। মাহেশের রথও এর ব্যতিক্রম নয়। সেটিও লোহা দিয়ে নির্মিত।

বেলঘরিয়ার রথের ক্ষেত্রে বালি থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার বিগ্রহ আসতো। শোনা যায়, বালি ব্রিজ তৈরি হাওয়ার আগে, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে বালি থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে উত্তরপাড়া খেয়াঘাটে নিয়ে আসা হত। তারপর সেখান থেকে নৌকোয় করে আড়িয়াদহ ঘাট, এবং আড়িয়াদহ থেকে ফের ঘোড়ার গাড়ি করে বেলঘরিয়ার ঘোষাল বাড়িতে আসতেন তিন ভাই বোন। রথের আগের দিনই বিগ্রহ চলে আসত বেলঘরিয়ায়। বালি ব্রিজ গড়ে ওঠার পর থেকে তিনজন মোটরগাড়িতে চেপেই ঘোষাল বাড়িতে আসতেন। রথতলায় নিয়ে গিয়ে রথে বসানো হত। সেখান থেকে বিটি রোড ধরে মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত যেত রথ। উল্টোরথের দিন ফের ফিরে আসত রথ।

অধুনা বালি থেকে আর বিগ্রহ আসে না। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সারাবছর মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়িতেই থাকেন। মতিলাল শীল ছিলেন দানবীর, ব্যবসায়ী উনিশ শতকের কলকাতার অন্যতম কেউকেটা লোক। বিটি রোডের উপরে বরাহনগরে রয়েছে তাঁর ঠাকুরবাড়ি। আজও কলকাতায় তাঁর নামে রাস্তা, কলেজ, প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়ি থেকেই রথের দিন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে বাইরে আনা হয়। এখন কামারহাটি পৌরসভা ও ইয়ং বেঙ্গল ক্লাব রথযাত্রা ও রথের মেলাটি পরিচালনা করে। যদিও কামারহাটিতে পুরীর রথের অনুকরণে ত্রিশ ফুট উঁচু রথের রথযাত্রা শুরু হয়েছে হালে। তিনটি পৃথক রথ গড়ে রথ যাত্রা পরিচালনা করা হয়। অন্যদিকে, বেলঘরিয়ায় আরেকদিকে অর্থাৎ নিমতা-বিরাটি অঞ্চলের রথও বেশ প্রাচীন। এটি গোপাল জিউয়ের মন্দিরের রথযাত্রা।

তথ্যঋণ: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে: তন্ময় ভট্টাচার্য

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...