কালীকথা: বামাকালী

কালীকথা: বামাকালী

আজ কালী কথায় পূর্ব বর্ধমানের বামাকালীর কথা বলব। তবে তার আগে বামাকালী নিয়ে কিছু কথা। দ্বিতীয় মহাবিদ্যা দেবী তারা শায়িত শিবের বক্ষে দন্ডায়মান থাকেন। দেবীর বাম পদ অগ্রগামী, তাই দেবী 'বামাকালী' নামেই পরিচিতা। দেবীর গাত্রবর্ণ ঘননীল। অগ্নিময় শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার মধ্য থেকে বিনির্গতা এই দেবী লোলজিহ্বা, লম্বোদরী, নবযৌবনা এবং মুন্ডমালিনী। দেবীর আসন স্বরূপ জ্বলন্ত চিতা জ্ঞানাগ্নির প্রতীক। চতুর্ভুজা দেবীর ডানদিকের উপরের হাতে খড়্গ এবং নীচের হাতে কাটারি। বামদিকের এক হাতে পদ্মফুল এবং নীচের অন্য হাতে নরকপাল। দেবীর কটিদেশ ব্যাঘ্রচর্মে আবৃত। দেবীর মস্তকে পঞ্চমুদ্রাবিভুষিত পিঙ্গলবর্ণের একজটা। পঞ্চমুদ্রা অর্থাৎ শ্বেত অস্থি নির্মিত চারটি পটি দিয়ে ত্রিকোণাকারে গাঁথা পাঁচটি নরকরোটি। মুন্ড জ্ঞানের প্রতীক। এখানে পঞ্চমুণ্ড শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধের প্রতীক সুচিত করে। দেবীর জটাশীর্ষে রয়েছেন 'অক্ষোভ্য', অর্থাৎ ত্রিগুনাত্মিকা ব্রহ্মশক্তির প্রতীক স্ত্রী-নাগরূপী

মহাদেব স্বয়ং। দেবীর সর্বাঙ্গ স্ত্রীসুলভ নাগ অলঙ্কারে ভূষিতা। দেবীর সর্বাঙ্গে সর্পালঙ্কার প্রকটিত বৈরাগ্যের প্রতীক।

জীবকে ভবসাগর থেকে উদ্ধার করেন বলে তিনি তারিণী নামেও পরিচিতা। আবার এই নীলবর্ণা ত্রিনয়নী দেবী জীবকে বাকশক্তি প্রদান করেন বলে নীলসরস্বতী নামেও পূজিতা হন। এছাড়াও কুরুকুল্লা, ত্র‍্যক্ষরী, পঞ্চাক্ষরী, মহানীলসরস্বতী ইত্যাদি তাঁরই নাম। অগ্নিপুরাণে অক্ষোভ্যা এবং সর্বজ্ঞা নামে তার দুই যোগিনীরূপের উল্লেখ আছে।

নীল গাত্র বর্ণের বামাকালী পূজিত হন বর্ধমানে। ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদের প্রতিষ্ঠিত কালীই এখানে বামাকালী নামে পরিচিত। মন্দিরে বয়স সাড়ে তিন শতাব্দীরও বেশি। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পাণ্ডুক গ্রামের ডাকাত দলের এই মন্দির প্রতিষ্ঠিতা করেছিল। বঙ্গে ডাকাতের সঙ্গে কালীর সম্পর্ক বহুদিনের। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার ডাকাতেরা কালীর আরাধনা করে ডাকাতি করতে বেরত। এইভাবেই গড়ে উঠেছে অজস্র কালী মন্দির।

প্রায় ৩৫৩ বছর আগে অভিভক্ত বর্ধমানে দেবী বামা কালী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে দেবী মায়ের বাম পাটি এগিয়ে থাকে। কার্তিক মাসের আমাবস্যায় অর্থাৎ কালী পুজোর এখানে ২২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করে পুজো হয়। কথিত আছে, পাণ্ডুক গ্রামের মেটে পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা বর্ধমানের বিখ্যাত ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। বর্তমানে পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা সালারের কাছে কেতুগ্রাম থানার মেটলি গ্রামের 'রামসীতা' মন্দিরের স্বর্ণ অলঙ্কার ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন। পথে বীরভূমের কাছে অপরূপা নারী মূর্তি দেখে ডাকাতরা চমকে ওঠেন। কিন্তু ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটের নির্দেশ ছিল, ডাকাতির পথে মেয়ে মানুষ আর শিশুর গায়ে হাত তোলা যাবে না। সে নীতি লঙ্ঘন করায় এক সদস্যকে সর্দার প্রহ্লাদ এক কোপে দু-টুকরো করে দেন। সেই সঙ্গে নারীর কাছে তার এই ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চান। সেই নারীর কাছে ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটে জানতে চান, তিনি কে, এই রাত্রিকালে তিনি কী করছেন সেখানে? তৎক্ষণাৎ সেই নারী জানান, তিনি কালী বামা।

মা মৃন্ময়ী মূর্তি থেকে চিন্ময়ী মূর্তি ধারণ করলেন। ডাকাত দলটিকে তিনি জানালেন, তাঁকে সেখান থেকে না নিয়ে গেলে ডাকাতদের সর্বনাশ হবে। মায়ের বিশাল মূর্তি নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার কথা বললেন ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ। সেই সঙ্গে বলেন, আজকে রাতে ডাকাতিতে সাফল্য পেলে তবেই সে মাকে নিয়ে যাবে। কথিত আছে, মায়ের আর্শীবাদে সাফল্যও পায় ডাকাত দল। তাই ডাকাতি করে ফেরার পথে বামা মায়ের ছোট শিলা মূর্তিকে সঙ্গে নিয়ে ফেরেন ডাকাত দলটি। পাণ্ডুক গ্রাম ঢোকার পথে মায়ের নির্দেশ মতো তীর নিক্ষেপ করে ডাকাত সর্দার। সেই শর এসে পাণ্ডুক গ্রামের মাঝখানে পড়ে। সেখানেই মা বামাকে স্থাপন করেন সাধক ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ।

কার্তিক মাসে দীপান্বিতা আমাবস্যার গভীর রাতে, ঢাক ঢোল বাজিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ডাকাতদলের সদস্যরা মায়ের ঘট এনে এখানে পুজো করতেন। পুজো শেষে বলি হয়ে গেলে পর দিন রাতে কাঁধে তুলে মাকে রসফাল্লা পুকুরে বিসর্জন করতেন। তারপরই ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদসহ সকলে মায়ের জন্য কাঁদতেন। দুঃখ মোচনে মা বামার নির্দেশেই পরবর্তীতে বারমাস পুজোর জন্য আর একটি মূর্তি গড়ে ডাকাত দলটি। সেখানে পুজো দিয়েই ডাকাতিতে বের হতেন তাঁরা। বর্তমানে দেবীর বিশাল মন্দির তৈরি হয়েছে। যা দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। তবে পুরোনো রীতি মেনে এখনও ডাকাত পরিবারের সদস্যরা বামা কালীর পুজোতে কোন না কোন জিনিস চুরি করে আনেন। আজও মা সেখানে পূজিত হয়ে আসছেন।

আবার নবদ্বীপে রামসীতা পাড়ায় বামাকালী মাতা পূজিত হন, সাবেকি পুজা অসাধারণ সুসজ্জিতা মায়ের মূর্তি, এখানে মায়ের বাম পা আগে তাই বামাকালি বলা হয়, তন্ত্র মতে মায়ের পুজো হয়, এটি বঙ্গের অন্যতম সুপ্রাচীন কালী পুজা। শান্তিপুরেও বামা কালী পুজো হয়।  সুবিশাল মাতৃমূর্তি সেই পুজোর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এছাড়াও বামাকালীর বিসর্জনের শোভাযাত্রা এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে দেবীকে যে নাচানো হয়, তা দেখতে অগুনিত মানুষ ভিড় করেন। নদীয়ার বামা কালীর গল্প আরেকদিন কালী কথায় উঠে আসবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...