ভাগীরথীর গর্ভে চড়া পড়ে প্রথমে যে দ্বীপ বা ভূখণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল তাই অগ্রদ্বীপ। অগ্রদ্বীপ, প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বৈষ্ণবতীর্থ অগ্রদ্বীপে গোপীনাথ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। দালান স্থাপত্যরীতিতে মন্দিরটি নির্মিত। ৮টি গোলাকার থামের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দির। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কষ্টিপাথরে নির্মিত গোপীনাথ, পাশে অষ্টধাতুর রাধিকা মূর্তি। কষ্টিপাথরের অপরূপ গোপীনাথ মূর্তিটির বয়স ৫০০ আগে, মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় দুই ফুট। দাঁইহাটের কোনও এক ভাস্কর মন্দিরটি গড়েছিলেন।
গোপীনাথ এবং বৈষ্ণব সাধক গোবিন্দ ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত পূর্ব বর্ধমানের অগ্রদ্বীপ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে প্রবীণ এক জনপদ। কাটোয়ার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে অগ্রদ্বীপ গ্রাম। গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা অগ্রবর্তী গ্রাম হিসেবেই গ্রামের নামকরণ। প্রতি বছর চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে এখানে মেলা বসে। মেলাটি অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলা নামে পরিচিত। সাধক গোবিন্দ ঘোষ ও তাঁর আরাধ্য গোপীনাথকে কেন্দ্র করেই এই মেলা। বিগত পাঁচ-ছয় বছরে মেলা জনপ্রিয়তা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। প্রতি বছর দশ থেকে বারো লক্ষ মানুষ এই মেলায় আসেন। পুণ্যার্থীদের জন্য চারশো থেকে পাঁচশো আখড়া তৈরি হয়। মেলার বয়স কম পক্ষে পাঁচশো বছর হবেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৫১৫ সালের ফাল্গুন মাসে গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসে ছিলেন শ্রীচৈতন্য। শ্রীচৈতন্য একটি কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। চৈতন্যই কৃষ্ণের নাম দেন গোপীনাথ। গোপীনাথের সেবার দায়িত্ব গোবিন্দ ঘোষকে দিয়ে নীলাচলে চলে যান শ্রীচৈতন্য।
আবার অন্য এক কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৫৮৮ সালে চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে মারা হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত গোবিন্দ ঘোষ। এই গোবিন্দ ঘোষ ছিলেন শ্রীচৈতন্যর অষ্ট পার্ষদের অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন গোপীনাথের সেবক। সেই তিথিকে স্মরণে রাখতেই প্রতি বছর গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক হিসেবে চিড়ে মহোৎসব আয়োজিত হয়। স্বয়ং গোপীনাথ এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন। শ্রাদ্ধের কাছা ধারণ করেন। গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক ক্রিয়ায় পিণ্ডদানের জন্যই এই আয়োজন। জনশ্রুতি রয়েছে, শিশুপুত্রর মৃত্যুর পর শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন গোবিন্দ ঘোষ। তখন গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনিই পুত্র হিসেবে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দেন। সেই কথা মেনে গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পরে তাঁর শ্রাদ্ধ করেন গোপীনাথ। অনেকে বলেন, একমাত্র এখানেই নাকি ভগবান ভক্তের শ্রাদ্ধ করেন। সেই প্রথা আজও চলছে।
অগ্রদ্বীপের খ্যাতি বারুণীর স্নান উৎসবের জন্যই। চৈত্র মাসে কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে এই স্নান হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, শ্রীচৈতন্যর আবির্ভাবের অনেক আগেই এই উৎসব চলে আসছে। বাংলা, বিহার, ওড়িশা এবং ওপার বাংলার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অগ্রদ্বীপে বারুণীর স্নানে সামিল হতে আসতেন। আঠারো উনিশ শতকে গঙ্গাসাগর মেলার চেয়েও অগ্রদ্বীপের বারুণীর স্নানের খ্যাতি বেশি ছিল। এখানেও গঙ্গাবক্ষে সন্তান বিসর্জন দেওয়ার রীতি ছিল।
কৃষ্ণচন্দ্র রায় নির্মিত অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরটি ১৮২৮ সালে বিধ্বংসী বন্যায় গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এখন যেখানে গোপীনাথের মন্দির, আগে সেখানে ছিল কাপড়ের কল। এখনকার মন্দিরের প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে ছিল কৃষ্ণচন্দ্র রায় নির্মিত গোপীনাথ মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। যশোরের বগচর নিবাসী গোপীনাথ পোদ্দার পরের মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার টাকা দান করেছিলেন। কালীপ্রসাদ পোদ্দার বাংলাদেশের ভক্তদের অগ্রদ্বীপে গোপীনাথের মেলা ও বারুণীর স্নানে উৎসবে আসার সুবিধার জন্য একটি রাস্তা তৈরি করে দেন বলেও জানা যায়। কালীপ্রসাদ পোদ্দার বননবগ্রাম থেকে চাকদহ পর্যন্ত আরও একটি কুড়ি মাইল দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করেছিলেন বলে শোনা যায়।
মন্দিরের খ্যাতি মেলার জন্যে, যা শ্রীচৈতন্যর অন্যতম পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধদিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয়। এই মেলা গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের শ্রাদ্ধ-মেলা নামেও পরিচিত। শ্রীচৈতন্যের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন গোবিন্দ ঘোষ, পরবর্তীকালে বৈষয়িক আসক্তির কারণে শ্রীচৈতন্যদেবের দ্বারা পরিত্যাজ্য হয়ে অগ্রদ্বীপে গঙ্গার ধারে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। সন্ন্যাসধর্ম ত্যাগ করে সংসারধর্ম পালন করলেও, গোপীনাথ বিগ্রহকে নিয়েই সাধনা করতে থাকেন গোবিন্দ ঘোষ। তবে অল্প দিনের মধ্যেই স্ত্রী ও পুত্রকে হারান গোপীনাথ। প্রচলিত লোককথা বলে, বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে মৃত্যু ভয় গ্রাস করেছিল। তিনি তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া নিয়ে মুষড়ে পড়েছিলেন, এরপরই ভগবান স্বয়ং তাঁর শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। চিঁড়ে মহোৎসবের মধ্য দিয়ে এখানে উৎসব শুরু হবে। মন্দির থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় গোবিন্দ ঘোষের সমাধি মন্দিরে। দেবতার হাত দিয়ে মানব পিতার কুশ ও পিণ্ডদান করা হয়। দেবতাকে কাছা পরিয়ে মানবপিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের এমন বিরল ঘটনার সাক্ষী এই মন্দির। প্রচলিত নিয়ম মেনে, গ্রামের মানুষও ওইদিন অরন্ধন পালন করেন। দ্বিতীয় দিনে অন্ন মহোৎসব, তৃতীয় দিন গঙ্গা স্নান, চতুর্থ দিন স্থানীয়ভাবে গোপীনাথের দোলের পালিত হয়।
গোপীনাথ বিগ্রহ ও গোবিন্দ ঘোষকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ শতকের কিংবদন্তি। মহাপ্রভু শ্রীক্ষেত্র যাওয়ার সময়, যে ক'জন তাঁর সঙ্গ নেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গোবিন্দ ঘোষ। অগ্রদ্বীপের আগের কোনও এক গ্রামে মহাপ্রভু দুপুরবেলা মুখশুদ্ধি হিসাবে একটু হরীতকী চেয়েছিলেন চৈতন্য। গোবিন্দ তা জোগাড় করে দেন। যাত্রা পথে তিনি যদি আবার চান, তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এক টুকরো নিজের কাছেও রাখেন। পরদিন দুপুরে গোবিন্দ ঘোষ প্রভুর দিকে এক টুকরো হরীতকী এগিয়ে দিতেই প্রভু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন এ হরীতকী তিনি কোথায় পেলেন? গোবিন্দ বলেন, তাঁর সেবায় যদি লাগে, তাই তিনি রেখে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় খুশি হওয়ার বদলে রুষ্ট হয়ে শ্রীচৈতন্যদেব গোবিন্দকে সেখানেই থেকে যেতে আদেশ করেন। কারণ গোবিন্দ সঞ্চয় বাসনা মুক্ত নয়। সন্ন্যাসীর সঞ্চয়ের বাসনা থাকা উচিত নয়। গোবিন্দ ঘোষ বলেন, তিনি যদি সঞ্চয় করে থাকেন, তা নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য। চৈতন্যদেবের উত্তর ছিল যার জন্যই সঞ্চয় করা হোক, তা একধরনের স্বার্থের কথা, বৈরাগ্য হয় না। তাই তিনি বলেন, সেখানে থেকে, বিয়ে করে গৃহী হয়ে যেতে।
গোবিন্দ ঘোষ রয়ে গেলেন অগ্রদ্বীপেই। একদিন গঙ্গাস্নানের সময় তার পায়ে কালো রঙের কিছু একটা জিনিস ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে দৈববাণী হল, ওটা নারায়ণ শিলা, এই শিলা দিয়ে বিগ্রহ বানিয়ে বাৎসল্যভাবে পুজো করো। দাঁইহাটের এক শিল্পী এসে গড়ে দিলেন গোপীনাথের মূর্তি। মূর্তির চোখদুটিতে শ্বেতশঙ্খ বসানো। গোপীনাথ বিগ্রহ ও গোবিন্দ ঘোষের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের। গোবিন্দ ঘোষের স্ত্রী আগেই পরলোকগত হয়েছিলেন। একমাত্র পুত্রর মৃত্যুর পর গোপীনাথ গোবিন্দ ঘোষকে মনস্তাপ করতে নিষেধ করেন। স্বয়ং গোপীনাথ নাকি বলেছিলেন ঘোষঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর শ্রাদ্ধাদিকার্য গোপীনাথের দ্বারাই সম্পন্ন হবে।
একদা বারুণী উৎসবের আগে চৈত্র মাসের একাদশী তিথিতে গোবিন্দ ইহলোক ত্যাগ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সেদিন গোপীনাথের চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা ঝরতে দেখা দিয়েছিল। তাঁকে দাহ না করে মন্দিরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। শোনা যায়, দ্বাদশ দিবসে স্বয়ং গোপীনাথ শ্রাদ্ধের বস্ত্র ও কুশাঙ্গুরীয় পরিধান করে পুত্ররূপে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধকার্য সম্পাদন করেন। আজও প্রতি বছর ওই তিথিতে বিগ্রহকে শ্রাদ্ধের বসন পরানো হয় এবং পুরহিতরা মন্দিরের মেঝেয় কুশ বিছিয়ে বিগ্রহের হাতে পিণ্ড তুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে বাইরে আসেন। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে নাকি দেখা যায়, কুশের ওপর পিণ্ড পড়ে আছে।
এখনও গোপীনাথকে কাছা পরিয়ে কেশহীন অবস্থায় গোবিন্দ ঘোষের সমাধিমন্দিরে নিয়ে এসে কুশ ও পিণ্ড তাঁর হাতে রাখা হয়। শ্রাদ্ধের কাজ শেষ হলে মন্দিরে ফিরিয়ে এনে রাজবেশ পরানো হয়। উৎসব কয়েকদিন ধরে চলে। প্রথম দিনে কেউ অন্নগ্রহণ করে না। দই-চিঁড়ে-কলা খেয়ে চিঁড়ে মহোৎসব পালন করে। দ্বিতীয় দিনে অন্ন মহোৎসব, তৃতীয় দিনে বারুণী স্নান, চতুর্থ দিনে দোল উৎসব হয়। আগে বারো দোলের সময় গোপীনাথকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত। প্রথমে নৌকা করে, পরে পালকিতে। বর্তমানে সেই রীতি আর মানা হয় না, গোপীনাথ অগ্রদ্বীপের মন্দিরেরই বাসিন্দা। ৫০০ বছরের পুরনো গোপীনাথ মন্দির নিজেই ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।