প্রাচীন জনপদ ব্রহ্মপুর। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের আধিক্যের জন্য অঞ্চলের নাম হয়েছিল ব্রহ্মপুর। ব্রিটিশদের উচ্চারণে সেই নাম মুখে মুখে বদলে গিয়ে হয়ে যায় বহরমপুর। কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার।
১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলা ও ওড়িশার রাজধানী। সেই সময় ব্রহ্মপুর ছিল একখন্ড ছোট্ট গ্রাম মাত্র। পুরো নাম সাতপুরিয়া ব্রহ্মপুর। গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিমপ্রান্তে বয়ে যেত ভাগীরথী নদী। প্রায় ৭০০ ঘর ব্রাহ্মণের বাস ছিল গ্রামে।
১৭৬৭ সালে নবাব মির জাফর ব্রহ্মপুর মৌজার চারশো বিঘে জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দান করেন। পলাশীর যুদ্ধ শেষ হলে কোম্পানী সেই অঞ্চল ব্রিতিশ সেনাবাহিনির প্রয়োজনে কাজে লাগায়। গড়ে ওঠে সেনানিবাস, ক্যান্টনমেন্ট। প্রসাশনিক কাজকর্মের জন্য তৈরি হয় কালেক্টর ভবন। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই গোটা বাড়তে থাকে ব্রহ্মপুর অঞ্চলের গুরুত্ব।
তার আগে পর্যন্ত আভিজাত্য এবং রাজনৈতিক-প্রশাসনিক তিন দিক থেকেই মুর্শিদাবাদের মধ্যে কাশিমবাজার আর সৈদাবাদ ছিল সর্বাপ্রেক্ষা ভারী নাম। ব্রহ্মপুর তথা বহরমপুরে ব্রিটিশ সেনাকর্তাদের যাতায়াত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যেতে থাকে অঞ্চলের চরিত্র। ধীরে ধীরে জেগে ওঠে নতুন শহরের চেহারায়। বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন, মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় সেজে ওঠে।
তৈরি হয় ব্যারাক স্কোয়ার। নবাব মির জাফরের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে জমি দান হিসাবে পেয়েছিল সেই জমিতে ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কোম্পানি তৈরী করে ব্যারাক স্কোয়ার। প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে ঘেরা মাঠের পূর্ব দিকে তৈরি হয়েছিল গোরা সেনাদের থাকার জন্য আবাস। তিন ভবনের এক একটির আয়তন ছিল ২৮ হাজার বর্গফুট। উত্তর-দক্ষিণ দিকের ভবনগুলিতে থাকতেন সেনা আধিকারিকরা। পশ্চিমদিকের আবাস সেনানায়কদের। এছাড়াও ছিল অতিথিনিবাস, আস্তাবল, ক্লাব, অস্ত্রাগার, সমাধিস্থল ।
মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে বহরমপুর পর্যটক এবং ইতিহাসবিদ উভয় পক্ষের কাছেই অত্যন্ত বিশেষ। সেনাযোগ তার অন্যতম কারণ। ১৮৫৭ সালে ভারতের মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল এইপ্রান্ত থেকেই। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯ নং ব্যাটলিয়নের সিপাহিরা প্যারেড করতে অস্বীকার করে। সেই সূত্রপাত, তারপরই সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ব্যারাকপুর, কলকাতা হয়ে গোটা দেশে। সিপাহি বিদ্রোহের শতবর্ষে ১৯৫৭ সালের ১৫ আগস্ট এই স্মরণ স্তম্ভটি নির্মিত হয়।
ব্যারাক স্কোয়ার নির্মাণের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল প্রচুর পরিমান ইঁটের। ইঁট তৈরির জন্য মাটি খনন করতে গিয়ে তৈরি হয় বহরমপুরের বিখ্যাত লালদীঘির। ১৭৬৫-১৭৬৭ দু’বছর লেগেছিল সেনানিবাসের কাজ শেষ হতে। সেখানকার ব্যবহৃত জল ও বৃষ্টির জল গিয়ে পড়ত ভূগর্ভস্থ নালায়, সেখান থেকে লালদিঘিতে। লালদিঘির উদ্বৃত্ত জল ধোপঘাটি হয়ে চলে যেত চালতিয়ার বিলে। এখনও লালদিঘির চার কোণে চারটি ভূগর্ভস্থ নালার মুখ দেখা যায়।
বহরমপুরে আছে দুটি বিখ্যাত গির্জা। একটি ক্যাথলিক চার্চ এবংরপ্রোটেসট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য সেন্ট জনস চার্চ।
সাহেবদের অনেক কুঠিবাড়ী ছিল এখানে। আজ এই ভবনগুলি সার্কিট হাউস এবং বিভিন্ন সরকারী দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এমন অজস্র দেখার বিষয় ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের শহরে। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না বহরমপুর ছাড়া।