মাঘ মাস। চরাচরে শীতের প্রকোপ কমতে কমতে সরোবর যখন আবার পদ্মময় হয়, তখন তার সৌরভে সুবাসিত হয় শ্রীক্ষেত্রের শ্রীমন্দিরও। কেননা, তখন রত্নবেদিতে জগন্নাথদের পদ্মসজ্জা অর্থাৎ 'পদ্ম বেশ' অনুষ্ঠিত হয়। কেন হয়, তা নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় একটি কাহিনি আছে। আসুন, সেটাই প্রথমে শুনে নিই:
বহুকাল আগের কথা। উৎকলের ঋষিকুল্যা নদীর তীরে যে শাহপুর গ্রাম, সেখানে 'মনোহর দাস' নামে জগন্নাথদেবের এক বৃদ্ধ ভক্ত বাস করতেন। মাঘ মাসের রৌদ্রে সরোবরের শীত পেরনো পদ্মগুল্মরাজি যখন পুনরায় সঞ্জীবিত হল এবং তায় একে একে পদ্মমালা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করল; তখন সেই পদ্মে জগন্নাথকে সুসজ্জিত করার আকাঙ্ক্ষা জাগল মনোহরের মনে।
মনের বাসনা মোটেই মনে চেপে রেখে দেওয়ার মানুষ নন মনোহর। কাজেই আকাঙ্ক্ষা যখন জেগেছে, তখন আর দেরি না-করে শুভ দিন দেখে একদিন আপন সরোবরের পদ্ম তুলে ঝুড়ি ভর্তি করলেন তিনি। তারপর তা-ই নিয়ে পাড়ি দিলেন পুরীধামের পথে।
সাধারণ গেরস্ত মানুষের যাতায়াতের বাহন ছিল তখন একমাত্র আপন পদযুগল। পালকি বা পশু ছিল নেহাতই বড়লোকের সাধন। কাজেই যুগল পদের ভরসাতেই মনোহরকে বেরোতে হল পথে। শাহপুর থেকে পুরী অনেক দূরের এবং কয়েক দিনের পথ। তাই সংগৃহিত পদ্ম রোদে-বাতাসে যাতে শুকিয়ে না-যায়, তার জন্য মনোহর তাতে ঢাকা দিলেন জলে ভেজা তাঁর লাল গামছাটি।
কিন্তু ভেজা গামছা কী আর সারাক্ষণ ভেজা থাকে! রোদে-বাতাসে তা যে অল্পেই শুকিয়ে যায়! কাজেই সমস্যার সমাধান করতে মনোহরকে খানিক যেতে যেতে বারে বারেই থামতে হল গামছা ভেজানোর জন্য। ভাগ্যিস, এ-মুলুকে পদে পদেই পুস্করিণী, তাই মনোহরকে বিপদে পড়তে হল না।
তাছাড়া, এই সব পুস্করিণীতে পদ্মও প্রচুর। তাই গামছা ভেজাতে মনোহর যে পুস্করিণীতে থামেন, সেখান থেকেই খানিক তাজা পদ্ম তুলে পুরনো গুলোর সঙ্গে ঝুড়িতে রাখতে লাগলেন প্রাণের ঠাকুর জগন্নাথকে অর্পণ করবেন বলে। তাতে ভর্তি ঝুড়ি উপচে পড়তে লাগল, বাড়তে লাগল ভক্তের ভার।
বৃদ্ধ বয়সে ঝুড়ির বোঝা সামলে যোজন যোজন পথ অপরিসীম কৃচ্ছ্র ও কায়ক্লেশে হেঁটে মনোহর যখন পুরীধামে পৌঁছলেন, তখন সব কিছু ভুলে তাঁর মুখে ইষ্ট-সমুখে আসতে পারার তৃপ্তিতে স্মিত হাসি, চোখে আনন্দের অশ্রু। তাই নিয়েই সন্ধের মুখে তিনি হাজির হলেন শ্রীমন্দিরের সিংহদরজায়।
সিংহদরজার সামনেই সুপ্রাচীন বড় ছাতা মঠ। মঠের সজ্জনেরা দেখতে পেলেন ক্লান্ত বৃদ্ধ ভক্ত মনোহরকে। তাঁরা দেখলেন, মনোহরের সর্বাঙ্গে ভক্তির অনাবিল জ্যোতি। সেই জ্যোতি তাঁদের আকৃষ্ট করল মানুষটির প্রতি। তাঁদের মনে হল, মানুষটি মোটেই সাধারণ না, তিনি একান্তভাবেই 'বিশেষ'। ফলে, তাঁরা মনোহরের সেবা শুশ্রূষার জন্য ব্যাকুল হলেন। আমন্ত্রণ জানালেন আতিথ্য গ্রহণের। সে-আমন্ত্রণে মনোহর সাড়া দেবেন কী, তাঁর চোখে যে তখন ইষ্টের চরণ, অন্তরে চরণের টান! সেই টানেই তিনি সিংহদরজা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন শ্রীমন্দিরের দিকে।
মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই একেবারে একদল পুরোহিতের সম্মুখে পড়লেন মনোহর। আর সেই পুরোহিতদের চোখ গেল শুধু গামছা ঢাকা ঝুড়ির ওপর। তারা জানতে চাইল ঝুড়িতে কী আছে! মনোহর গামছা সরিয়ে স্মিত মুখে বললেন, পদ্ম। আমার প্রভুর জন্য। এই পদ্ম প্রভুর শ্রীপদে অঞ্জলি দেব, আর তার পাঁপড়ি দিয়ে সাজবো প্রভুর অঙ্গ। এ-টুকুই যে এ-অধমের বাসনা!
মনোহর গামছা সরাতেই পুরোহিতেরা দেখতে পেয়েছিল ঝুড়ির অধিকাংশ পদ্মই শুকোতে শুরু করেছে। তার মধ্যে বেশ কিছু পদ্মেই আবার ইতোমধ্যে পচন ধরেছে। তাই দেখে তাদের নাক আগেই সিঁটকে উঠেছিল। এবার মনোহরের মুখে এই সব পদ্ম দিয়ে জগন্নাথকে সাজানোর কথা শুনে তাদের মনে হল, লোকটার কী স্পৰ্ধা! শুধু মনেই হল না, তাদের মাথায় ভয়ানক রাগও চড়ে গেল। তাতেই তারা পদ্মের ঝুড়ি টান মেরে পাকশালার নর্দমায় ফেলে দিল। মনোহরকে পাগল ঠাউরে বেজায় মারতে মারতে আর ধাক্কা দিতে দিতে সিংহদরজার বাইরে বের করে দিল।
একে পথশ্রমে ক্লান্ত, তায় বৃদ্ধ--পুরোহিতদের মার মনোহর সইতে পারলেন না, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলেন মাটিতে।
চরাচরে ইতোমধ্যেই নেমে এসেছিল অন্ধকার। তাতে অবশ্য সিংহদরজা একেবারেই জনবিরল হয়ে ওঠেনি, কিন্তু মনোহরকে সত্যিই পাগল-টাগল ভেবে তাঁকে নিয়ে কেউ বড় একটা গা করল না।
সেই সমবেত উপেক্ষার মাঝে বড় ছাতা মঠের এক সেবায়েত কী একটা কাজে মঠের বাইরে বেরোতে, তাঁর চোখ পড়ল জ্ঞানহীন মনোহরের দিকে। খানিক দূর থেকে আবছা আলোয় প্রথমটায় অবশ্য তিনি মনোহরকে চিনতে পারলেন না। ভাবলেন, হতভাগ্য-দুঃস্থ কেউ হবে হয়তো। সাধু-মানুষ তিনি, এগিয়ে এলেন সেবা দিতে।
কিন্তু সম্মুখে এসে দেখলেন, এ যে সেই ভক্ত মনোহর! অমনি চেঁচিয়ে ডাকলেন আর সকলকে। তাঁর ডাক শুনে মঠ থেকে সকলে ছুটে এলেন। জ্ঞানহারা মনোহরকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন, আহা রে, ইনি যে সেই ইষ্টনিষ্ঠ ভক্ত! চলো চলো এঁকে ভেতরে নিয়ে চলো!
পথ থেকে প্রায় কোলে করে মনোহরকে ভেতরে নিয়ে গেলেন সকলে। সেবা দিয়ে, শুশ্রূষা দিয়ে তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
রাত বাড়ল। সেই রাতেই স্বয়ং জগন্নাথ স্বপ্নে দেখা দিলেন উৎকলের রাজাকে। আদেশ দিলেন, হে রাজন, যাও এক্ষুনি ভক্ত মনোহরের কাছে। তার প্রতি সহৃদয়তা দেখাও। তাকে তার অধিকার বুঝে নিতে দাও। যাও...
ঘুম ভেঙে রাজা একেবারে ভেবলে গেলেন। কে এই মনোহর, তাঁর প্রতি কী অন্যায় হয়েছে, কিছুই তিনি জানতেন না। তাই জগন্নাথের আদেশ তিনি অনুধাবন করতে পারলেন না। কিন্তু অন্তরে দারুণ অস্বস্তি শুরু হল। কাজেই তখন স্বপ্নাদেশের মর্ম উদ্ধারের জন্য ডাকালেন রাজগুরুকে।
রাজগুরু সব শুনে আপন গুপ্তচরের কাছে জানতে পারলেন ভক্ত মনোহরের প্রতি অন্যায়-বৃত্তান্ত। জানতে পারলেন, মনোহর এই মুহূর্তে বড় ছাতা মঠে আশ্রিত। অমনি জগন্নাথের আদেশ স্মরণ করে রাজগুরু নিজে সেই মঠে হাজির হলেন। ততক্ষণে মঠের সেবায়েতদের সেবায় মনোহর সুস্থ হয়েছেন। যে-ভক্তের জন্য স্বয়ং জগন্নাথ বিচলিত, সেই ভক্তকে দেখে, তাঁকে আলিঙ্গন করে রাজগুরু জীবন সার্থক করলেন।
তারপর তিনি মনোহরের মনের বাসনা পূর্ণ করতে তক্ষুনি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন শ্রীমন্দিরে। নর্দমা থেকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে এলেন মনোহরের সংগৃহিত পদ্মরাজি। মনোহর সে-সকল হাতে নিয়ে দেখলেন, কী আশ্চর্য, তার মধ্যে একটাও মরা বা পচা পদ্ম নেই, জগন্নাথের কৃপায় সমস্ত পদ্মই হয়ে উঠেছে সতেজ ও স্বর্গীয় সুগন্ধময়!
তখন মনোহরের আনন্দের অন্ত রইল না। মনের সুখে সেই পদ্মের কিছু ইষ্টের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে প্রণাম করলেন, কিছু পদ্ম দিয়ে ইষ্টের সর্বাঙ্গ মনের মতো করে সুসজ্জিত করলেন। এ-ভাবে প্রকৃত ভক্তের ভক্তির স্পর্শ পেয়ে জগন্নাথ যেমন আপ্লুত হলেন, তেমনি ইষ্টকে পেয়ে মনোহরের জীবনও যেন সার্থক হল। ভক্ত ও ভগবানের এই সম্মেলনের সাক্ষী হয়ে বিমোহিত হলেন রাজগুরু। তিনিও অনুভব করলেন চরাচরে এক স্বর্গীয় প্রশান্তি...
সেই কবেকার ভক্ত মনোহরের ভক্তি ও পদ্ম নিবেদনের কথা স্মরণ করেই মাঘ মাসে জগন্নাথদের আজও পদ্ম দিয়ে সাজানো হয়। পদ্ম দিয়ে সাজানো হয় বলেই এই বেশের নাম, 'পদ্ম বেশ'। অমাবস্যা তিথির আগে বা পরের বুধ কিংবা শনিবারে অনুষ্ঠিত হয় এই 'বেশ'। এই বেশ-অনুষ্ঠানটি শ্রীমন্দিরে প্রায় তিনশো বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
মনোহরের কাহিনিকে স্মরণ করে সেই তিনশো বছর ধরেই এই বেশের জন্য পদ্ম ও সজ্জা-সামগ্রীর যোগান দেন বড় ছাতা মঠ। সেই সঙ্গে জগন্নাথদের উদ্দেশ্যে বিশেষ এক পায়েসও নিবেদন করেন তাঁরা। এই পয়েসকে বলা হয়, 'পদ্মক্ষীরি'। নিবেদিত পায়েস মন্দিরের সেবায়েত, কর্মী ও নিত্য ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
মনোহর যেহেতু রাত্রে জগন্নাথকে সুসজ্জিত করেছিলেন, তাই রাত্রের শেষ-সজ্জা 'বড় শৃঙ্গার বেশ'-কালেই এই 'পদ্ম বেশ' অনুষ্ঠিত হয়। এই বেশেই জগন্নাথেরা রাত্রিযাপন করেন। তাই সকালে জগন্নাথেরা ঘুম থেকে ওঠার পরও ভক্তেরা তাঁদের এই বেশে দেখার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেন।
বেশকালে পদ্মের পাঁপড়ি দিয়ে জগন্নাথ-সুভদ্রা ও বলভদ্রের শ্রীমুখমণ্ডল বৃত্তাকারে সুসজ্জিত করা হয়। তাঁদের তখন দেখে মনে হয় যেন, পাশাপাশি তিনটি প্রস্ফুটিত পদ্ম। তিন দেবদেবীর মাথাতেই এ-সময় পরিয়ে দেওয়া হয় পদ্ম ও পদ্মের মৃণাল দিয়ে তৈরি ত্রিভুজ আকৃতির মুকুট। আর শুধু বলভদ্র ও জগন্নাথের হাতে দেওয়া হয় পদ্মকলি।
তবে এই বেশে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য হল, তিন দেবদেবীর পদতলে পদ্ম দিয়ে ফুটিয়ে তোলা চারটি রাজহাঁস। কেউ কেউ মনে করেন যে, পদ্মবেশকে প্রাণবন্ত করে তুলতেই এই চার রাজহাঁস রচনা করা হয়। আবার কারও কারও মতে, কিংবদন্তিতে রাজহাঁস যেভাবে জল থেকে দুধ আলাদা করে গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করা হয়, তেমনি প্রকৃত ভক্তের ভক্তিকে দেবতা রাজহাঁসের মতোই অনেক গ্লানির মধ্য থেকে বেছে গ্রহণ করেন, এটা বোঝাতেই রাজহাঁস রচনা করা হয়ে থাকে।
অঘ্রানে দেবতাদের শীত থেকে রক্ষা করতে যে 'ঘোডা লাগি বেশ'কার্য শুরু হয়েছিল, তা 'পদ্ম বেশ'কালেও অব্যাহত থাকে। 'ঘোডা লাগি বেশ'-এ এক-একদিন দেবতাদের এক-এক রঙের চাদরে আবৃত করা হয়। তাই 'পদ্ম বেশ' শনিবারে অনুষ্ঠিত হলে দেবতাদের শ্রীঅঙ্গে বস্ত্র হিসেবে কালো চাদর দেখতে পাওয়া যায়, আর বুধবারে অনুষ্ঠিত হলে নীল।
'পদ্ম বেশ'-এর সজ্জায় প্রকৃত পদ্মের সঙ্গে এখন শোলা ও জরির 'কুণ্ডল', 'চিতা', 'তাহিয়া' প্রভৃতি অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়। সব মিলিয়ে জগন্নাথের এই সজ্জা হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম ও অনির্বচনীয়, যা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বছরভর অপেক্ষা করেন ভক্তকুল, যা দেখে তাঁরা সার্থক করেন নয়ন, তৃপ্ত করেন অন্তর...
'পদ্ম বেশ'-এর সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মাঘ মাসের বিশেষ সজ্জা শেষ হয়ে যায় না। এ-মাসে আরও কয়েকটি বেশ সজ্জা অনুষ্ঠিত হয়, কীর্তিত হয় তাদের প্রেক্ষাপটের আশ্চর্য সব কাহিনি। সুতরাং, সেই সব কথা-কাহিনি নিয়ে আসছি আগামি পর্বে। আজ এই পর্যন্তই...