পৌষ মাস। পূর্ণিমা তিথি। এই তিথিতে শ্রীমন্দিরে জগন্নাথের যে স্বর্ণবেশ অনুষ্ঠিত হয়, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বেশকে বলা হয়, 'পুষ্য অভিষেক বেশ'।
বিশেষ এই 'বেশ' আসলে রাজবেশ। এতে জগন্নাথ রাজা-রামরূপে সজ্জিত হন। আসলে, জগন্নাথ যে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম, শ্রীবিষ্ণুরই আর এক রূপ, তিনি অন্য কেউ নন--ভক্তদের এটা বোঝানোর জন্যই বারো মাসের বিভিন্ন তিথিতে বিচিত্র সব বেশের সমাহার।
অনুষ্ঠানের আগের দিন ভোগ মণ্ডপে প্রশস্ত সামিয়ানা টাঙানো হয়। রাতে বড় শৃঙ্গার বেশের পর, ভোগ নিবেদনের ঠিক আগে 'জোগানিয়া' নামের সেবকের দল একুশ ঘড়া জল আর একুশ ঘড়া ঘি এনে সেই সামিয়ানার ছায়ায় মজুত করেন। মন্দিরের পুরোহিতেরা সে-সব বুঝে-শুনে নিয়ে প্রতিটি ঘড়ার মুখ ভালো করে বন্ধ করে রেখে দেন। তারপর 'বড় শৃঙ্গার ভোগ' নিবেদনের জন্য আয়োজন শুরু করেন।
গর্ভগৃহে যখন ভোগ নিবেদন শুরু হয়, সেই সময়ই অন্যদিকে 'কোঠা সুয়ানসিয়া' নামের এক সেবক-সম্প্রদায় পরদিনের অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ কাঠের পিঁড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। সেই পিঁড়িকে বলা হয়, 'ভদ্রাসন'। রাতেই যথেষ্ট পরিমাণে ফুল ও চন্দন বেটে তাঁরা এই ভদ্রাসনে রেখে যান, পরদিন অধিবাস-অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য।
শ্রীমন্দিরে তখন ভোগ-পুজো সম্পন্ন করে তিন দেবদেবীর শরীর শীতল করতে সুনিদ্রার জন্য ডাব নিবেদন করা হয়। এবং তারপরই তাঁদের 'শয়ন' করানো হয়।
পূর্ণিমার দিন খুব ভোরে উঠে পড়েন ব্রাহ্মণের দল। তাঁরা স্নান-শুদ্ধ হয়ে নির্মাণ শুরু করেন যজ্ঞবেদির।
গর্ভগৃহে ইতোমধ্যেই দেবতাদের নিদ্রাভঙ্গ ও প্রাতঃকৃত্যাদি সম্পন্ন হয়। সকাল ধুপ বা সকালের ভোগ নিবেদনের কাজটিও শেষ হয়ে যায়। ও-দিকে যজ্ঞবেদি নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ-দিকে মৈলম বা বস্ত্র পরিবর্তনের পর ত্রিদেবদেবীর মহাস্নান পূজাও সমাপন হয়।
সামিয়ানার ছায়া থেকে এবার 'গোরাবাদু' নামের সেবকেরা সেই মুখবন্ধ একুশ ঘড়া জল ও ঘি নিয়ে চারটি সারিতে এসে দাঁড়ান গর্ভগৃহে। এই ঘি ও জলে ত্রিদেবদেবীর অভিষেক হবে।
ইতোমধ্যে 'মুদিরাথা' সেবকেরা জগন্নাথদের শীতল ভোগ নিবেদন করেন। পুরোহিতেরা এরপর জগন্নাথদের 'ছলনমূর্তি'সমূহকে কাঠের পিঁড়িতে অধিষ্ঠিত করে পুজো শুরু করেন। পুজোর পর পুষ্পালক সেবকের দল বিগ্রহের মৈলম অর্থাৎ বস্ত্র পরিবর্তন করে দেন।
জগন্নাথদের মৈলম সম্পন্ন হতে-না-হতেই দেবী মহালক্ষ্মী শ্রীমন্দির-প্রাঙ্গণে অবস্থিত তাঁর নিজস্ব মন্দির থেকে পালকিতে চড়ে জগন্নাথ-মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সাতবার মন্দিরটি প্রদক্ষিণ করে তারপর গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন। অধিষ্ঠান করেন জগমোহন খটায়। সেখানে অবস্থান করে তিনি আজ্ঞামালা বা আদেশ দান করেন। তখন 'ঘাটুয়ারি', 'পাণ্ডা', 'পতি' ও 'মুদিরাথা' নামের সেবকেরা সমবেতভাবে জগন্নাথ বিগ্রহের অঙ্গে চন্দন লেপন করেন। এই ভাবে শুরু হয় অভিষেক। অভিষেক সম্পন্ন হলে শুরু হয় স্বর্ণবেশের সজ্জা।
এই 'বেশ'কালে ত্রিদেবদেবীই রাজকীয় পোশাক, প্রভূত সোনার অলঙ্কার, সুগন্ধী ফুলের মালায় সুসজ্জিত হন। এই সজ্জায় জগন্নাথদেবকে মনে হয় যেন স্বয়ং সম্রাট।
জগন্নাথদের স্বর্ণবেশ সম্পন্ন হলে মহালক্ষ্মী নিজেও স্বর্ণবেশে সুসজ্জিত হন। সেজেগুজে তিনি আপন মন্দিরে ফিরে যান।
গর্ভগৃহে স্বর্ণবেশে সুসজ্জিত তিন দেবদেবীর তখন ষোড়শ উপচারে পুজো শুরু হয়। এই পুজোকে বলা হয়, 'রাজনীতি' ও ' বন্দপান নীতি'। এই পূজার সময় দেবতারা রত্নবেদির সামনে 'ভিতরচা মহাপাত্র' নামের সেবক কাপড়ের ছাতা ধরে লক্ষ্মণের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। আর 'ভাণ্ডার-মেকপ' নামের সেবক সম্মুখে ভক্ত হাত জোড় করে হনুমানের মতো বসে থাকেন। তিনজন 'পালিয়া পূজা পাণ্ডা' এই পূজা সম্পন্ন করেন।
পুজো সম্পন্ন হলে জগন্নাথের কণ্ঠ থেকে একখানা মালা খুলে পালকিতে করে মহালক্ষ্মীর মন্দিরে পাঠানো হয়। এবার তিন দেবদেবীর 'ছলন-বিগ্রহ' বিশ্রামের জন্য দক্ষিণের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
অনেকের মতে, পৌষের এই পূর্ণিমার দিনই শ্রীমন্দিরে জগন্নাথেরা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হন। অন্য মতে, এই দিনই চোদ্দ বছরের বনবাস শেষে রাজা রাম অযোধ্যায় ফেরেন এবং অভিষেকের পর সিংহাসনে আরোহণ করেন। 'পুষ্য অভিষেক বেশ' অর্থাৎ পৌষের এই অভিষেক বেশ-অনুষ্ঠানটি সেই দুই স্মৃতিরই উদযাপন।
ঘরে ঘরে যখন মকর সংক্রান্তির প্রস্তুতি, পুণ্যস্নানে মোক্ষের আকাঙ্ক্ষা আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়, জনপদে পার্বণী-পিঠের মধুর সুবাসে চারিদিক ম' ম' করে ওঠে; তখন শ্রীমন্দিরে মহাসমারোহে জগন্নাথদের 'নবাঙ্ক বেশ' অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেষ এই বেশ-সজ্জাটি অনুষ্ঠিত হয় মকর-সংক্রান্তির আগের দিন। 'ফুল মেলানা নীতি', 'চাউল মেলানা নীতি' ও 'নবাঙ্ক নীতি'--এই তিন নীতি বা রীতি মিলিয়ে সম্পূর্ণ হয় এই অনুষ্ঠান।
সংক্রান্তির আগের দিন 'মালি' নামের সেবায়েত-সম্প্রদায় জগন্নাথদের জন্য সুগন্ধী ফুলের মালা ও অলঙ্কার গাঁথেন। নিয়ে আসেন বেহেরানা দ্বারে। সেখানে তারা সে-সকল তুলে দেন 'পালিয়া মেকপ' নামের সেবায়েতদের হাতে। সন্ধ্যারতির সময় সেই সব মালা ও অলঙ্কার ত্রিদেবদেবীকে নিবেদন করা হয়। এই যে নিবেদন, একেই বলে 'ফুল মেলানা নীতি'।
পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, মকর সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যায় জগন্নাথ-পত্নী দেবী লক্ষ্মী একমাসের অবসর কাটিয়ে বাপের বাড়ি সাগর-দেশ থেকে শ্রীমন্দিরে ফিরে আসেন। ফেরার সময় স্বামী, ভাসুর ও ননদের জন্য কিছু উপঢৌকন নিয়ে আসেন।
কী আনেন তিনি? মিষ্টি, ফল, নতুন বস্ত্র এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা সঙ্গে করে আনেন, সেটা হল, নতুন ধানের চাল। মকর সংক্রান্তির দিনে এই চাল দিয়েই জগন্নাথেরা নবান্ন-উদযাপন করেন।
দেবীর সঙ্গে আনা ওই সব সামগ্রী ন'বার শ্রীমন্দির প্রদক্ষিণ করিয়ে তারপর অন্দরে গ্রহণ করা হয়। একেই বলে, 'চাউল মেলানা নীতি'।
এই সন্ধ্যেতেই অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথদের 'নবাঙ্ক বেশ'। এই বেশকর্মের প্রবর্তক স্বয়ং চৈতন্যদেব। 'নবাঙ্ক' মানে, 'নয়'। কারও মতে 'নবাঙ্ক' মানে হল, নয়টি ভক্তিপথের সমাহার। যে-পথে ঈশ্বরের নাম করা হয়, যে-পথে ঈশ্বরের নাম শোনা উচিত। কারও মতে বা, বাউলের নয় দরজা। তবে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, এ-দিন ভক্ত যদি ন'বার জগন্নাথ মন্দির প্রদক্ষিণ করেন, তাহলে তাঁর সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
তবে ভক্তের আগে এই প্রদক্ষিণ শুরু করেন স্বয়ং মদনমোহন। মদনমোহন প্রথমে এ-দিন গর্ভগৃহে জগন্নাথদের রত্নসিংহাসন সাড়ে চার বার প্রদক্ষিণ করেন, তারপর কুর্ম বেদি প্রদক্ষিণ করেন বাকি সাড়ে চার বার। দু'য়ে মিলে হয়, নয়। এই পরিক্রমাকে বলে, 'নবাঙ্ক বেধ পরিক্রমা'।
বাপের বাড়ি অবস্থানকালে লক্ষ্মীদেবী যে একমাস জগন্নাথদের হৃদয়ের একান্ত প্রেম-প্রীতি নিবেদন করতে পারেননি, শ্রীমন্দিরে ফিরে প্রথমে সেটাই নিবেদন করার আন্তরিক উদ্যোগ নেন তিনি। আর, সেটা নিবেদন করতেই তিনি চওড়া লাল-পাড়ওয়ালা লম্বা সিল্কের বস্ত্র পরিধান করেন। তাঁর দেখাদেখি ত্রিদেবদেবীও একই বস্ত্র পরিধান করেন রাতের শেষ সজ্জায় অর্থাৎ শয্যা গ্রহণের পূর্বসজ্জায় 'বড় শৃঙ্গার বেশ'কালে। আসলে, লক্ষ্মীর এতদিনের অনিবেদিত প্রেম যে তাঁরা গ্রহণ করলেন, এটা তারই প্রতীকী আচার।
'নবাঙ্ক বেশ'কালে ত্রিদেবদেবীর মুখমণ্ডল লম্বা সিল্কবস্ত্রটির লাল পাড় দিয়ে এমনভাবে বেষ্টিত করা হয়, যাতে মুখের চারপাশে ফুটে ওঠে সুন্দর সুদৃশ্য এক নকশা। এতে তাঁদের মুখসজ্জা আরও মনোহর হয়ে ওঠে। জগন্নাথ ও বলভদ্রের জন্য নির্মিত হয় বিশেষ মুষল ও শঙ্খ-চক্র। তাঁদের পরিয়ে হয় তদগি ও কুণ্ডল। পরিয়ে দেওয়া হয় তুলসী পাতা ও গাঁদা ফুলের মধুগন্ধী মালা। তিনজনেরই মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয় তুলসী পাতায় তৈরি শঙ্কু আকৃতির মুকুট।
মকর সংক্রান্তির দিন সূর্য যখন মকর রাশিতে প্রবেশ করে, তখন জগন্নাথ শুরু করেন তাঁর 'উত্তরায়ণ যাত্রা'। এই উপলক্ষে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা যে বিশেষ সজ্জায় সজ্জিত হন, তাকে বলে, 'মকর চৌরাশি বেশ'।
'চৌরাশি' অর্থাৎ চুরাশি। হিন্দুদের বিশ্বাস, চুরাশি লক্ষ জীব-জন্ম পেরিয়ে অনেক পুণ্যের ফলে মানুষের জন্ম হয়। 'মানুষ' জন্মই হচ্ছে জীবটির সুকৃতির শেষ পরিণতি। সুতরাং, এই 'বেশ'-এর মধ্য দিয়ে জগন্নাথ মানুষকে মকর সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে সেই মোক্ষপথ তথা সুকৃতিপথের কথাই স্মরণ করিয়ে দেন।
'মকর চৌরাশি বেশ'কর্মে 'মকর-চুলা' নামের তুলসী ও গাঁদা ফুলে নির্মিত মুকুটে ত্রিদেবদেবী সজ্জিত হন। সঙ্গে থাকে ফুল-পাতার নানান অলঙ্কার। বেশের জন্য ওড়িয়া মঠ ফুল ও তুলসী পাতার মালার যোগান দেন। 'মকর চুলা' দেন জগন্নাথ বল্লভ মঠ। আর ফুলের অলঙ্কার দেন আলম চণ্ডী মন্দির।
মকর সংক্রান্তিতে যে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয় জগন্নাথদের, তাকে বলা হয়, 'মকর চাউল'।
ভোগের জন্য নতুন ধানের চাল থেকে মণ্ড তৈরি করা হয়। মণ্ড তৈরির জন্য নতুন চাল আগের দিন 'চাউল মেলানা নীতি' নামের যে আচার অনুষ্ঠিত হয়, সেই সময় জলে ভেজানো হয়। সারারাত ধরে তা জলে ভিজে যখন পরদিন ফুলে ওঠে, নরম হয়ে যায়; তখন তাকে জল থেকে ছেঁকে তুলে গুড়, নারকেল কোরা, কলা, জমাট-ছানা, দই, ফল, গোল মরিচ গুঁড়ো, জায়ফলের গুঁড়ো দিয়ে মাখা হয়। এ-ভাবে যে ভোগটি তৈরি হয়, তাকে বলে, 'মকর বেধা'।
পৌষের মকর সংক্রান্তিতে এ-ভাবে নবান্ন-যাপন করে জগন্নাথ শুধু স্বর্ণবেশে সম্রাট হয়েই রইলেন না, হয়ে উঠলেন কৃষকের ঘরের দেবতাও। যে-দেবতা কৃষকের নবান্ন গ্রহণের পর,পত্নীর নবান্ন গ্রহণের পর নিজে নবান্ন গ্রহণ করে তৃপ্ত হন; তিনিই তো জগতের নাথ জগন্নাথ, অপামরের দেবতা...
সংক্রান্তির মধ্য দিয়েই স্বভাবত শেষ হয় পৌষের বিশেষ বেশভূষার কথা। সুতরাং, আগামি পর্বে আসছি মাঘ মাসের বিশেষ বেশভূষার কথা ও কাহিনি নিয়ে। আপাতত এই পর্যন্তই...