অঘ্রান মাস। বাতাস বয়ে শরীরে শীতের কাঁপন লাগতে শুরু করেছে। ফলে, সময় হয়েছে গরম পোশাক বের করে গায়ে চাপানোর। নইলে ঋতু পরিবর্তনের এই অবসরে অসুখ বাধতে কতক্ষণ!
শ্রীক্ষেত্রের শ্রীমন্দিরের জগন্নাথ একাধারে ভগবান, অবতার ও মানব তথা 'উৎকল-সম্রাট'। ঋতু পরিবর্তনের এই অবসরে তাই প্রয়োজন হয়েছে তাঁর সাজবেশের মধ্যেও রাজকীয় শীতের পোশাক অন্তর্ভুক্ত করার। আর এটা করতে গিয়ে অঘ্রানে একটা বিশেষ সাজবেশের ঐতিহ্যই তৈরি করে ফেলা হয়েছে, যার নাম, 'ঘোডালাগি বেশ'।
উৎকল প্রদেশীয় এই 'ঘোডালাগি' কথাটির মানেই হল, দেবদেবীদের শীতের বিশেষ পোশাক পরানো। বলা বাহুল্য, বেশকর্মটি অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় তিন দেবদেবীই রত্নসিংহাসনে অধিষ্ঠান করেন। এই বেশে মুখমণ্ডলটুকু খোলা রেখে তাঁদের সারা শ্রীঅঙ্গই সুদৃশ্য ও মনোরম ভেলভেট কাপড়ে এমনভাবে মুড়ে দেওয়া হয়, যাতে দুরন্ত শীত কিছুতেই তাঁদের সেই শ্রীঅঙ্গ স্পর্শ করতে না-পারে।
'ঘোডালাগি বেশ'কর্ম শুরু হয় অঘ্রান মাসের শুক্ল ষষ্ঠী তিথিতে। চলে পৌষ পেরিয়ে মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী অর্থাৎ বসন্ত পঞ্চমী অব্দি।
আমরা সাধারণ মানুষেরা আশ্বিনে দুর্গা পূজার পূর্বে পিতৃপক্ষে মহালয়ায় তর্পণ করে পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, কার্তিকে দীপাবলীতে আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁদের স্মরণ করি।
কিন্তু, জগন্নাথ আমাদের মতো তো আর সাধারণ না। তাঁর সমস্ত কিছুই তাই 'বিশেষ'। তিনিও পিতৃপুরুষকে স্মরণ করেন, শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু তা আশ্বিনের মহালয়ায় না, কার্তিকের দীপাবলীতেও না। তিনি এই কৃত্য তিনদিন ধরে একই সঙ্গে পালন ও সম্পন্ন করেন এবং তা করেন অঘ্রান মাসে। সেই উপলক্ষে তাঁর 'বেশ'ও হয় বিশিষ্ট, পালিত হয় বিশেষ এক আচার। সেই আচার-ঐতিহ্যের নাম, 'শ্রাদ্ধ বেশ'।
আসলে, আর পাঁচটা শ্রাদ্ধাচারে মৃতের পুত্রকন্যাদের সাধারণত যে-বেশে দেখা যায়; আচার পালনের ওই তিনদিন জগন্নাথ-সুভদ্রা ও বলভদ্র তিনজন সেই শ্বেত-শুভ্র বস্ত্রই পরিধান করেন। তাতে বৈচিত্র্যময় রঙের সামান্য সামান্য ছোঁয়া থাকে, যা সাদাকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তোলে, মহিমান্বিত করে। বলা বাহুল্য, এই সময় তাঁদের অঙ্গে অলঙ্কারের কোন ঘটা থাকে না।
আমরা জানি যে, প্রতিদিন রাত্রে শোবার আগে জগন্নাথদের সারা অঙ্গে চন্দন লেপন করা হয়, সুবাসিত ও শীতল অঙ্গে যাতে ঘুম ভালো হয় সেই জন্য। আমরা এও জানি, এই শৃঙ্গার-অনুষ্ঠানের নাম, 'চন্দন লাগি'। রাত্রে এই চন্দন লাগির ঠিক আগেই অনুষ্ঠিত হয়, 'শ্রাদ্ধ বেশ'।
যেহেতু মৃত পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে এই অনুষ্ঠান, তাই এই অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয় কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে। আর সেই আত্মাদের সন্তুষ্টি ও শুভেচ্ছার ইঙ্গিত দিতে অনুষ্ঠান প্রসারিত হয় অমাবস্যা পেরিয়ে শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ অব্দি। এই ভাবে মোট তিনদিন।
এই তিনটে দিন জগন্নাথ পরে থাকেন সাধারণ সাদা জমির ধুতি। তাতে থাকে নরুনের মতো সরু পাড়, হলুদ রঙের।
তবে, শ্রাদ্ধের সময় জগন্নাথ যে সিল্কের সাদা কাপড়টি পরেন, তা হয় প্রায় সাতাশ ফুট লম্বা। তাতে থাকে বেশ চওড়া লাল রঙের অলঙ্কৃত পাড়। বলভদ্র যে চওড়া কালো পাড়ওয়ালা সাদা সিল্কের কাপড়টি পরেন, তা হয় একুশ ফুট লম্বা। আর সুভদ্রা যে চওড়া হলুদ পাড়যুক্ত সাদা সিল্কের শাড়িটি পরেন, সেটি হয় আঠারো ফুট লম্বা।
অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জগন্নাথদেব শ্রাদ্ধ ও দীপদান করেন দশরথ, বসুদেব, নন্দ ও রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আত্মার উদ্দেশ্যে। জগন্নাথের সঙ্গে এঁরা প্রত্যেকেই পূর্বপুরুষ তথা পিতৃ-সম্পর্কে আবদ্ধ। দশরথ, বসুদেব ও নন্দ না-হয় পৌরাণিক পুরুষ, কিন্তু রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর সঙ্গে সেই পিতৃ-সম্পর্ক কীভাবে হল?
দশরথ থেকে শুরু করে ক্রমে ইন্দ্রদ্যুম্নতে এসে ব্যাপারটা স্পষ্ট করছি:
ত্রেতা যুগের কথা। অযোধ্যার রাজা নেমি একবার অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দশ দিকে রথ ঘুরিয়ে আত্মরক্ষা করতে করতে বীরত্বের সঙ্গে অসুরদের নিধন করে 'দশরথ' নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা নামের তিন রানি থাকা সত্ত্বেও, সেই রাজা দশরথের কোন সন্তান ছিল না। মৃগয়ায় গিয়ে অন্ধক মুনির পুত্র শ্রবণকে তিনি ভ্রমবশত হত্যা করেন। তাতে অন্ধক তাঁকে পুত্রবিচ্ছেদ জনিত কারণে মৃত্যুর অভিশাপ দিয়ে আপন পুত্রশোকে মারা যান।
এদিকে অত্যাচারী অসুর রাবণের অত্যাচারে জর্জরিত পৃথিবী বিষ্ণুর কাছে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে একদিন প্রতিকার চাইলেন। তখন বিষ্ণু তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে শ্রীরামরূপে অবতার নেবার সংকল্প করলেন।
ওদিকে দশরথ ঋষিদের পরামর্শে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করে যজ্ঞোত্থিত পায়েস রানিদের যখন খাওয়ালেন, তখন তাঁর তিন রানির গর্ভে চার পুত্রের জন্ম হল। তার মধ্যে বড় রানি কৌশল্যার গর্ভে শ্রীরামরূপে জন্ম নিলেন স্বয়ং বিষ্ণু।
রামচন্দ্র বড় হলেন, সীতার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল। তারপর যখন জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে তাঁর রাজা হওয়ার সময় হল, তখন বিমাতা কৈকেয়ী আপনপুত্র ভরতকে রাজা করতে ও রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দশরথ পূর্বেই কৈকেয়ীর ইচ্ছেপূরণ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, তাই সত্যরক্ষা করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু রামচন্দ্রকে বিনাদোষে বনবাসে পাঠিয়ে তিনি যে অন্যায় করলেন, তার অনুতাপ ও শোক সহ্য করতে পারলেন না। তিনি অসুস্থ হলেন ও মারা গেলেন।
রামচন্দ্র পত্নী সীতা ও ভ্রাতা লক্ষ্মণসহ বনবাসে গিয়েছিলেন। সেই বনবাসে থাকাকালেই তিনি পিতার মৃত্যুসংবাদ পেলেন। পিতাকে পিণ্ডদানের দিন পিণ্ডের আয়োজন করতে দুই ভ্রাতা লোকালয়ে গেলেন। কিন্তু, পিণ্ডের সময় উত্তীর্ণ হচ্ছে, অথচ দুই ভাই ফিরছেন না দেখে সীতা দশরথের উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিয়ে দিলেন। এতে পুত্র হিসেবে রামচন্দ্র পিণ্ডদানে বঞ্চিত হলেন। যদিও পুত্রবধূর হাতে পিণ্ড পেয়ে দশরথ অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু রামচন্দ্র অতৃপ্ত থেকে গিয়েছিলেন।
জগন্নাথ যেহেতু স্বয়ং বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অবতার। তাই প্রকারান্তরে রামচন্দ্রও তিনি, দশরথও তাঁর পিতা। তাই প্রথমবার পিণ্ডদানের আক্ষেপ ভুলতে ও বাৎসরিক তর্পণের কর্তব্য ও দীপদান সম্পন্ন করতে অঘ্রানে তিনি উদ্যোগ নেন। আর সেই উপলক্ষেই আয়োজন হয় 'শ্রাদ্ধ বেশ'-এর।
দ্বাপর যুগে কংসের অত্যাচার ও পাপভার থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে দেবকীর অষ্টম গর্ভে ও বসুদেবের ঔরসে বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে জন্ম নিলেন। পূর্বেই দৈববাণীতে কংস জেনেছিল যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তার মৃত্যুর কারণ। তাই সেই মৃত্যুর কারণটিকে হত্যার জন্য সে দেবকী ও বসুদেবকে আপন কারাগারে বন্দি করে কৃষ্ণের জন্মের জন্য অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছিল।
তাই, কৃষ্ণের জন্মের পর বসুদেব সন্তানকে রক্ষার জন্য রাতের অন্ধকারে দৈব সহায়তায় গোপনে গোকুলে সখা নন্দ ঘোষের ঘরে রেখে এলেন। নন্দ যথারীতি কৃষ্ণকে আপন সন্তানের স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করলেন। তখন একদিন কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করে দেবকী ও বসুদেবকে তার বন্দিশালা থেকে উদ্ধার করলেন।
বিষ্ণুসূত্রে কৃষ্ণও জগন্নাথ। তাই কৃষ্ণের পিতা তাঁরও পিতা। শাস্ত্রে যে পঞ্চপিতার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে 'জন্মদাতা' ও 'অন্নদাতা' অর্থাৎ 'পালনকর্তা' অন্যতম। শাস্ত্র এই দুই পিতার প্রতিই পুত্রকে সমভাবে কর্তব্য পালনের কথা বলেছেন। তাই 'শ্রাদ্ধ বেশ' অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ জন্মদাতা পিতা বসুদেব এবং পালকপিতা নন্দের উদ্দেশ্যে বাৎসরিক তর্পণ ও দীপদান সম্পন্ন করে পুত্রের কর্তব্য পালন করেন।
কলি যুগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে দিয়ে শবররাজের কাছ থেকে নীলমাধবকে উদ্ধার করে এনে জগন্নাথরূপে শ্রীক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সময় ইন্দ্রদ্যুম্নের অপুত্রক রানি গুন্ডিচা জগন্নাথকে আপনপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই সূত্রে ইন্দ্রদ্যুম্ন হয়ে উঠেছিলেন জগন্নাথের পিতা। তাই 'শ্রাদ্ধ বেশ' অনুষ্ঠানে জগন্নাথ তাঁর উদ্দেশ্যেও তর্পণ ও দীপদান করেন।
এই 'শ্রাদ্ধ বেশ'-এর মধ্য দিয়েই অঘ্রান মাসের বিশেষ বেশভূষা শেষ হয়। সুতরাং, মাসভিত্তিক এই পর্বটিরও এখানেই শেষ। আগামি পর্বে আসছি পরের মাসের বিশেষ বেশভূষা ও তার প্রেক্ষাপটের অজানা সব কাহিনি নিয়ে...