বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: পর্ব-১৪

ঘটনাটা ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দের। ‘মাদলা পাঞ্জি’র বিবরণ অনুযায়ী এই সময় ওড়িশার গজপতি রাজা কপিলেন্দ্র দেব দাক্ষিণাত্যের এক রাজার বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর কপিলেন্দ্র যুদ্ধে জয়লাভ করেন। লুঠে আনেন ষোলটি হাতির পিঠ বোঝাই করে সহস্র মণ সোনা। 

 

প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে এক সময় জয়ের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন রাজা কপিলেন্দ্র, আশ্রয় নিয়েছিলেন জগন্নাথদেব ও মা জয়দুর্গার চরণে। তাতেই বোধ হয় দেবদেবীদের কৃপা হল, একদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। রাজা জয়ী হলেন। 

 

জয়ী হলেও রাজা কিন্তু জয়ের কৃতিত্ব নিজে নিতে পারলেন না। তাঁর মনে হল, প্রভু জগন্নাথ ও দেবী জয়দুর্গা নিজেদের শ্রীক্ষেত্র রক্ষা করলেন নিজেরাই। তাই এ-জয়ের সমস্ত কৃতিত্ব তাঁদেরই। তাঁরাই ওড়িশার প্রকৃত রাজা-রানি।

Jagannath10

এই ভাবনার ফলেই লুঠতরাজের সমস্ত সোনা কপিলেন্দ্র শ্রীমন্দিরের ভাণ্ডারে পাঠিয়ে দিলেন। তার একটি কণাও নিজে স্পর্শ করলেন না বা নিজের ভোগের জন্য রাখলেন না। কারণ, তাতে তো প্রকৃত রাজারই অধিকার। 

 

এই যে জগন্নাথদেবকে কপিলেন্দ্র ওড়িশার প্রকৃত রাজা বলে স্বীকার করলেন, নিজেকে তাঁর অনুগত সেবক বলে মনে করলেন; সেটাই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের সম্মুখে উদযাপনের জন্য তিনি এই সময় জগন্নাথের ‘রাজবেশ’-এর প্রবর্তন করলেন। সাধারণের কাছে এই ‘বেশ’ আর একটি নাম পেল, তা হল, ‘বড়া তাধাও বেশ’

 

কপিলেন্দ্র এই সময় থেকেই বিশেষ বিশেষ তিথিতে বছরে পাঁচ বার এই বিশিষ্ট ‘বেশ’কর্মটি উদযাপনের ব্যবস্থা করলেন। আষাঢ়ের শুক্ল একাদশী, আশ্বিনের বিজয়া দশমী, কার্তিক-পূর্ণিমা, পৌষপূর্ণিমা এবং দোলপূর্ণিমায়।

 

তার মধ্যে শুধু আষাঢ়ের ‘রাজবেশ’ অনুষ্ঠিত হয় রথের ওপর, মন্দিরের বাইরে, রথযাত্রা কালেবাকি মাসের গুলো উদযাপিত হয় মন্দিরে রত্নসিংহাসনের ওপরেই। 

 

আষাঢ়ের ব্যতিক্রমটি রাজা কপিলেন্দ্র ঘটিয়েছিলেন শ্রীমন্দির-ভাণ্ডারঘরের তত্ত্ববধায়ক ‘তাদাও করণ’-এর অনুরোধে। করণ অনুরোধ করেছিলেন, যাতে আপামর সকলেই এই সুদৃশ্য বেশকর্মের সাক্ষী হতে পারেন। আষাঢ়ের বিশেষ বেশভূষা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আগের পর্বগুলোর একটিতে এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি, লেখকের নামে ক্লিক করে আমাদের ওয়েব পেজ থেকে সেই পর্বটি চাইলে আপনারা পড়তে পারেন।

 

যাই হোক, আশ্বিনের বিজয়া দশমী বা দশেরার দিন ‘রাজবেশ’ কীভাবে অনুষ্ঠিত হয়, আসুন তার বিবরণে প্রবেশ করিঃ

 

‘অবকাশ নীতি’ শেষ হতেই অর্থাৎ জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা—এই তিন ভাইবোন কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে, স্নান করে স্নিগ্ধ হতে-না-হতেই বিজয়া দশমীর দিন শুরু হয়ে যায় একটি বিশেষ আচার। ভাণ্ডার মেকপের দল ভাণ্ডার ঘর থেকে তিনটি রুপোর পাত্রে বাটা চন্দন নিয়ে হাজির হন তাঁদের সামনে

 

তারপর তিন ভাইবোনের সর্বাঙ্গে তাঁরা সেই চন্দন ভালো করে মাখিয়ে দেনচন্দনের অপূর্ব সুগন্ধে সর্বাঙ্গ সুগন্ধিত করে বত্রিশ রকমের সোনার গয়না দিয়ে তিনজনকে সাজিয়ে দেন এই সোনার গয়নাগুলো সমস্তই তৈরি হয়েছে রাজা কপিলেন্দ্রর সেই যুদ্ধে জিতে আনা সোনা থেকে।  

Jagannath11

শুধু সোনার গয়না দিয়েই তিন দেবদেবীকে যে সাজানো হয়, এমনটা নয়; সঙ্গে থাকে পাঁচ রকমের ফুলের গয়না এবং মালাও। 

 

প্রজাপালন ও সুশাসন বজায় রাখার জন্য রাজাকে সময়ে সময়ে অন্যায় দমনে দন্ডবিধান করতে হয়, অস্ত্রধারণ করতে হয়। তাই শ্রীমন্দিরে ‘রাজবেশ’এর জন্য আগের দিন অর্থাৎ নবমী তিথি থেকে বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথের অস্ত্রসমূহ—‘হল্’, ‘মুষল’, ‘ওধিয়ানি’, ‘শঙ্খচক্র’র পূজা শুরু হয়। 

 

সেই পূজিত অস্ত্রমালা দিয়ে বিজয়া দশমীর দিন তিন দেবদেবীকে সুসজ্জিত করেন পুষ্পালকের দল। ‘বিজয়া’ বা ‘দশেরা’র এই বিশেষ দিনটিতে এভাবে বিষ্ণুর অনন্য অবতার শ্রীরামের মতোই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন জগন্নাথেরা। ভক্তদের কাছে এই সময় এমন দর্শনসুখের চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী-ই বা হতে পারে!  




আশ্বিনে আর-একটি নয়নাভিরাম বেশকর্ম শ্রীমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়, তার নাম ‘রাধা-দামোদর বেশ’

 

আশ্বিনের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে শুরু হয়ে এই ‘রাধা-দামোদর বেশ’ কার্তিকের শুক্ল দশমী অব্দি নিত্যই অনুষ্ঠিত হয়এই ‘বেশ’ স্বভাবতই কৃষ্ণলীলা থেকে অনুপ্রাণিত এবং এর প্রেক্ষাপটে একটি পৌরাণিক গল্প আছেঃ

 

কংসের রাজকর্মচারীদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন সাত্ত্বিক, বিষ্ণুভক্ত ও সদাচারী মানুষ ছিলেন, তিনি হলেন অক্রূর। 

 

গোকুল ও বৃন্দাবনে ঘাতক পাঠিয়ে কৃষ্ণ-বলরামকে নানাভাবে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ মথুরায় এনে হত্যা করার জন্য একদা কংস এক দারুণ চক্রান্ত করলেন। সেই জন্য অক্রূরকে পাঠালেন নিমন্ত্রণ করে কৃষ্ণ-বলরামকে আনতে। চক্রান্তের বিন্দু-বিসর্গ না-জেনেই আপন ভক্তির পরাকাষ্ঠা নিয়ে সানন্দে তিনি হাজির হলেন বৃন্দাবনে। 

 

বৃন্দাবনলীলার সমাপ্তিকাল এসে গিয়েছিল। এসে গিয়েছিল কংস-ধ্বংসের কালও। তাই কৃষ্ণ-বলরাম সহজেই অক্রূরের সঙ্গে পাড়ি দিলেন মথুরায়। অক্রূরের ভক্তিভাব দেখে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছে হল তাঁকে কৃপা করে ধন্য করতে। 

 

তাই পথে স্নান-পূজা নিত্যকর্মের জন্য অক্রূর যখন রথ থামালেন, যখন যমুনায় নামলেন অবগাহন করতে; তখন শ্রীকৃষ্ণ মুচকি হেসে কৃপা করলেন। 

 

অক্রূর স্নানের জন্য ডুব দিতেই যমুনার জলের ভেতর শ্রীকৃষ্ণ-রাধাকে অপরূপ লীলাময়রূপে যুগলমূর্তিতে অধিষ্ঠিত দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেন একই অঙ্গে গোলকবিহারী বিষ্ণু-লক্ষ্মীর অলৌকিক সমাবেশ, হল অদ্ভুত দর্শন। দেখলেন, যিনিই কৃষ্ণ, তিনিই বিষ্ণু; যিনিই লক্ষ্মী, তিনিই রাধা। ইষ্টের কৃপায় অক্রূর ধন্য হলেন, পেলেন মোক্ষপথের সন্ধান।

 

শ্রীকৃষ্ণ ও জগন্নাথকে এক করে দেখাতে, তাঁর মোক্ষদায়ীরূপটি স্মরণ করতে শ্রীমন্দিরে প্রবর্তিত হয়েছে এই ‘রাধা-দামোদর বেশ’টি।   

 

প্রখ্যাত গবেষক সদাশিব রথশর্মা তাঁর ‘শ্রীজগন্নাথ বেশ রহস্য’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে, এই বেশপ্রথাটি শুরু হয়েছে দ্বাদশ শতক থেকে। 

 

কেননা, দ্বাদশ শতক ও তার পরবর্তী সময়ে ‘রাধা’ একইসঙ্গে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের নায়িকা এবং কৃষ্ণের হ্লাদিনী হিসেবে গৃহীত হয়ে খুবই বিখ্যাত হয়ে পড়েন সমগ্র ভারতবর্ষে। 

 

তারপর ধীরে ধীরে তিনি বাংলার চণ্ডীদাস ও মিথিলার কবি বিদ্যাপতি পদ-কবিতায় কবির আত্মা হয়ে উঠলেন, ইষ্ট বিষ্ণুর চরণে আত্মনিবেদনের পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠলেনসেই সঙ্গে বিষ্ণুস্বামী, নিম্বার্ক, চৈতন্যদেবের মতো বৈষ্ণব ভক্ত-সাধকের কাছে ‘দেবী’ হিসেবে পূজিতও হতে শুরু করলেন ফলে, এই সব ভক্তসাধক যখন শ্রীমন্দিরে এলেন, তখন তাঁদের মাধ্যমে এই বেশরীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। 

 

অন্য মতে, এই বেশরীতিটি শ্রীমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ষোড়শ শতক থেকে। শ্রীচৈতন্যদেব পুরী আসার পর। কারণ, চৈতন্যদেব মনে করতেন যে, জগন্নাথ হলেন শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের সম্মিলিত প্রতিমা। এই মতের অনুসারীদের বিশ্বাস, এই বেশনীতিটি রাজা গজপতি পুরুষোত্তম দেব শ্রীমন্দিরে প্রবর্তন করেন। 

Jagannath12

বেশনীতিটির উদ্ভব যে-সময়ই হোক-না-কেন, তার পরিকল্পনা যে অপরূপ, সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। এখন আসুন দেখি কীভাবে এই বেশনীতি উদযাপিত হয়ঃ

 

‘অবকাশ নীতি’র পর পরই সকালে ‘রাধা-দামোদর বেশ’কর্মটি সম্পাদন করা হয়। 

 

বেশকালে জগন্নাথ ও বলভদ্র ‘ত্রিকাছা’ ধারণ করেন। বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথের গলায় পরানো হয় তিন খানা করে সোনার হার। হাতে পরানো হয় একজোড়া করে সোনার ‘নালিভুজ’ নামের গয়নামণিবন্ধে ‘ওদিয়ানি’ পরানো হয়। এবং, দুটি করে পরানো হয় সোনার ‘তিলকিয়া’। 

 

এছাড়াও বলভদ্র-জগন্নাথ দুটি করে সোনার চন্দ্র-সূর্য ধারণ করেন। বিভিন্ন রকমের সোনার কুণ্ডল কানে ধারণ করেনতাছাড়াও তাঁদের ‘তদকা’, ‘ফুটা’, ‘শ্রীকাপড়’, ‘পহরণ’, বালি’, অধরবালা’, ‘উত্তরীয়’ প্রভৃতি পরানো হয়। 

 

পরিশেষে বাঁশ, কাপড়, ফুল, পাতা দিয়ে সুদৃশ্য চূড়া তৈরি করা হয় এবং সোনার ‘চন্দ্রিকা’ গয়না দিয়ে  তা সুসজ্জিত করে তিন দেবদেবীর মাথায় পরানো হয়।

 

এভাবে সযতনে সুসজ্জিত ‘রাধা-দামোদর বেশ’টি বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে বড় পবিত্র। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত এই নয়নাভিরাম ‘বেশ’-সৌন্দর্য দেখে তৃপ্ত হতে এই সময় ছুটে আসেন শ্রীমন্দিরে। ছুটে আসেন কৃপা পেতে। পৌরাণিক অক্রূরের মতো ইষ্টের কৃপা পেয়ে ধন্য হতে...

 

শ্রীমন্দিরে আশ্বিনের বিশেষ বেশভূষা ‘রাধা-দামোদর বেশ’-এর মধ্য দিয়েই শেষ হয়। সুতরাং, এই পর্ব এখানেই শেষ করছি। আগামি পর্বে নিয়ে আসছি কার্তিক মাসের বিশেষ বেশভূষার কথা ও কাহিনি...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...