বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: পর্ব-১৩

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ-ত্রয়োদশী তিথিতে পুরীর শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদের যে বিশেষ বেশটি হয়, তার নাম 'কৃষ্ণ-বলরাম বেশ'। এর পিছনে কোন পৌরাণিক গল্প নেই, তবে দারুণ বিশেষত্ব আছে।


এই বেশ-ঐতিহ্যের সূচনা অত্যন্ত অর্বাচীনকালে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। রাজার আদেশে গোপালবন্ধু মিশ্র নামের এক জমিদারের হাত ধরে। 


'কৃষ্ণ-বলরাম বেশ' হল সন্ধেবেলার বেশ। এই বেশে সুসজ্জিত করার পর জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্রের আরতি করা হয়। এই বেশের মধ্য দিয়ে তিনভাইবোনের সুদৃঢ় বন্ধনটিকে যেমন আলোকিত করা হয়েছে, তেমনি সজ্জায় রাখা হয়েছে অভিনবত্বও।


বেশকালে জগন্নাথ ও বলভদ্রের অঙ্গে দু'খানি করে রত্নময় হাত সংযোজন করা হয়। কিন্তু, সুভদ্রার অঙ্গে সংযোজিত হয় চারখানি হাত। দুই হাতে তিনি বরাভয় দান করেন। আর বাকি দুই হাতের একটিতে ধারণ করেন পাশ, অন্যটিতে অঙ্কুশ। বেশটিকে 'রাম-বলরাম বেশ' নামেও অভিহিত করা হয়।

Jagannathbody1

নাম যা-ই হোক-না-কেন, এই প্রথম কোন বিশেষ সজ্জায় সুভদ্রাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হল। আসলে, এর মধ্য দিয়ে হয়তো এটাই বোঝানো হল যে, সংসারে দুই ভাইয়ের সৌহার্দ্যকে মধ্যমণি হয়ে পরিচর্যা করে, পালন করে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র বোন। কারণ চতুর্ভুজা সুভদ্রার বরাভয়, পাশের (দড়ির) বন্ধন, অঙ্কুশের সঞ্চালনশক্তি তারই ইঙ্গিত দেয়।


'কৃষ্ণ-বলরাম বেশ'-এর ঠিক পূর্বে বেশ কিছুকাল আগেও একটি বেশ হত, তার নাম, 'গিরিগোবর্ধন বেশ'। কটকের চৌধুরি-বাজারের এক জমিদার এই বেশের সমস্ত খরচ বহন করতেন। বড় ওড়িয়া মঠের মাধ্যমে শ্রীমন্দিরে তিনি বেশকর্মটি পরিচালনা করাতেন। কিন্তু, কোন এক অজ্ঞাত কারণে এই বেশ-ঐতিহ্যটি অনেকদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে।


ভাদ্র মাসের শেষ বিশেষ সজ্জাটির নাম, 'বামন বেশ'। এটি শুক্ল-দ্বাদশী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। হ্যাঁ, এই বেশের প্রেক্ষাপটে একটি পৌরাণিক কাহিনি আছে। সেটা এবার বলছি:


বামন। বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার। ভাদ্রের শুক্ল-একাদশী  তাঁর আবির্ভাব তিথি। সেই আবির্ভাব কেন ও কীভাবে হল এবং তারপর কী হল, সেটাই গল্প। গল্পটা 'ভাগবত পুরাণ' থেকে নেওয়া:


দৈত্যকুলে বলি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি একদিন তপবলে ও বাহুবলে ত্রিলোক জয় করে ফেললেন। প্রবল পরাক্রমে দেবতাদের দেবলোক থেকে দূর করে নিজে স্বর্গের রাজা হয়েও বসলেন।


বিতাড়িত দেবতারা তখন নিজলোক উদ্ধারের কোন উপায় খুঁজে না-পেয়ে বিষ্ণুর চরণে এসে শরণ নিলেন। বিষ্ণু তাঁদের আশ্বস্ত করে কশ্যপ মুনির পত্নী অদিতির গর্ভে বামনরূপে জন্ম নিলেন।


ওদিকে বলি আরও বলশালী হয়ে উঠতে এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করলেন। ঘোষণা করলেন, যজ্ঞকালে যে যা চাইবে, তাকে তিনি তা-ই দেবেন।


বেশ। যজ্ঞের দিন দলে দলে এল কতশত বামুন-ভাট-ভিখারি। তারা যে যা চাইল বলি সত্যি তা-ই দিলেন তাদের। শেষে এলেন বামন। তিনি এসে বলির কাছে চাইলেন মাত্র তিন-পাদ ভূমি। অর্থাৎ, তিনটি পা স্থাপন করা যায়, এমন স্থান।

Jagannathbody2

বলি দেখলেন যে, বামন আসলে এক বেঁটে-বামুন। তাঁর তিন-পাদ ভূমি তো যৎসামান্য। তিনি ত্রিলোকের অধিপতি, তাঁর কাছে এ-দান তো কিছুই না। তিনি এই দান দিতে প্রতিশ্রুত হলেন।


যজ্ঞস্থলে উপস্থিত ছিলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। তিনি ব্যাপারটার মধ্যে হঠাৎ বিপদের গন্ধ পেলেন। ছুটে এলেন স্নেহধন্য বলিকে সাবধান করতে। বললেন যে, বামনকে কোন দান না-দিতে। 


কিন্তু, ততক্ষণে বলি অঙ্গীকার করে ফেলেছেন। বলি অসুর হতে পারেন, কিন্তু তাঁর চরিত্রে দৃঢ়তা ছিল। অঙ্গীকারের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। তাই আচার্যের কথা মানতে পারলেন না।


শাস্ত্রমতে দান করতে গেলে গন্ডুষের জল হাতে নিয়ে সংকল্প করতে হয়। শুক্রাচার্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে না-পেরে সবার অলক্ষ্যে বলিকে রক্ষা করতে কীটরূপ ধারণ করে গন্ডুষের নলে ঢুকে তার ছিদ্র আটকে অবস্থান করতে লাগলেন। ফলে, বলি সংকল্প করতে গিয়ে হাতে জল নিতে গেলেন, কিন্তু জল পড়ল না। 


সমস্তটা বুঝে বামনরূপী বিষ্ণু মুচকি হাসলেন। বলিকে পরামর্শ দিলেন কুশ দিয়ে নলে খোঁচা দিতে। তাই শুনে বলি রহস্য না-বুঝে খোঁচা দিতেই তা শুক্রাচার্যের চোখে লাগল। তিনি কানা হয়ে গেলেন। তখন দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি চলে গেলেন।


এতকিছুর পরেও বলি কিন্তু সত্যে অবিচল রইলেন। সংকল্প সম্পূর্ণ করলেন। সংকল্প শেষ হতেই বামন এক পা দিয়ে মর্ত-পাতাল আবৃত করলেন। দ্বিতীয় পা দিয়ে অধিকার করলেন ঊর্ধলোক। তারপরই নাভি থেকে নির্গত হল তাঁর তৃতীয় পা। তখন বামন বলিকে জিজ্ঞেস করলেন যে, এই পা তিনি কোথায় রাখবেন।


ত্রিলোকের অধিপতি বলি সবে দ্বি-পাদ স্থান দিতে গিয়ে ত্রিলোক দান করে ফেলেছেন। দেবার মতো আর কোন স্থান তাঁর অধিকারে অবশিষ্ট নেই। অথচ, না-দিলেও তো সত্যরক্ষা হবে না। তাই তিনি বামনকে বললেন যে, তৃতীয় পা-টি বামন যেন তাঁর মাথায় রাখেন।


অমনি বলতে-না-বলতেই বামন তাঁর তৃতীয় পা বলির মাথায় রাখলেন। রাখতেই দারুণ পদভারে বলি পাতালে প্রবেশ করলেন। 


এইভাবে বামন অবতার নিয়ে বিষ্ণু দেবতাদের স্বর্গের অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। বলির হাত থেকেও তাঁদের রক্ষা করলেন। তবে বলি যেহেতু তাঁর পদভার মাথায় নিয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়েও সত্য রক্ষা করেছেন; তাই বলিকেও কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে দিলেন না। তাঁকে সাবর্ণি মন্বন্তরে ইন্দ্র হয়ে স্বর্গের অধিপতি হবার বর দিলেন।


বামন অবতারে কৃত বিষ্ণুর এই লীলাটি শ্রীমন্দিরে উদযাপনকালে জগন্নাথকে বামন বেশে সাজানো হয়। তখন একজন ব্রাহ্মণের শাস্ত্রমতে যা যা লাগে, অর্থাৎ গাড়ু, কুশ, ছত্র প্রভৃতি সঙ্গে দেওয়া হয়। এই বেশকালে পুষ্পালকের দল তাঁকে একুশ রকমের সোনার অলঙ্কার পরিয়ে দেন। বেশটিকে যেমন 'বামন বেশ' বলা হয়, তেমনি এটি 'বলি-বামন বেশ' নামেও খুব পরিচিত।


ভাদ্র মাসের বেশকথা এখানেই শেষ হল। আশ্বিন মাসের বিশেষ বেশভূষার কথা ও কাহিনি নিয়ে আসছি আগামি পর্বে। আজ এ-পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...