বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: পর্ব-১২

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে যে বিশেষ সজ্জায় জগন্নাথেরা সজ্জিত হন, তাকে বলা হয়, 'কালীয়দমন বেশ'। বেশভূষার বিবরণ দেওয়ার পূর্বে এর পিছনে যে পৌরাণিক গল্পটি রয়েছে, সেটি আগে বলে নিই :

কালীয় এক নাগ। তার একশটি ফণা। বিকট তার আকার, ভয়ঙ্কর তার বিষের প্রকোপ।

কিন্তু, তা সত্ত্বেও গরুড়ের সঙ্গে এক যুদ্ধে একদিন সে হেরে গেল। তারপর প্রাণের ভয়ে সপরিবারে পালিয়ে যমুনার দহে এসে বাস করতে শুরু করল।

কিন্তু, সে এমনই বদ যে, দহের জল অচিরেই দারুণ বিষাক্ত করে তুলল। তার জ্বালায় আশপাশের গাছেরা মরে গেলে। এমনকি, সেখান দিয়ে উড়তে গিয়ে পাখিরাও মরতে শুরু করল। বৃন্দাবনবাসীরা তাই সাবধান হতে বাধ্য হল। এবং, দহটির নিকটে যাওয়া বন্ধ করল। তবুও ঘটে গেল একটা অঘটন।

কৃষ্ণ ও তাঁর গোপসখারা গরু চরাতে চরাতে একদিন সেই দহের কাছাকাছি এসে পড়লেন। ক্লান্তিবশত কয়েকজন সখা দারুণ তৃষ্ণার্ত হয়ে হঠাৎ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। এবং, কৃষ্ণের অলক্ষ্যে সেই দহের জল পান করে বসল ও তৎক্ষণাৎ ছটফট করতে করতে মারা গেল।

কৃষ্ণ তাদের সেই অবস্থা দেখে কাতর হয়ে ছুটে এলেন। আপন শক্তিতে সখাদের পুনর্জীবিত করেও তাদের দুরবস্থার জন্য অসম্ভব কুপিত হলেন। এবং, সেই দুরবস্থার কারণটিকে নির্মূল করতে অমনি ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন দহের জলে। সটান হাজির হলেন গিয়ে কালীয়র কাছে।

কালীয় কৃষ্ণকে শত্রু বুঝে মারাত্মক ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ করল। একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। পাক দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মেরে ফেলতে চাইল। কিন্তু পারল না।

কৃষ্ণ নিজের দেহ এমন বিস্ফারিত করতে লাগলেন যে কালীয় চাপতে গিয়ে নিজেই চাপে পড়ে গেল। ছেড়ে দেওয়ার পথ পেল না।

আর ছাড়া পেয়েই কৃষ্ণ লাফ দিয়ে তক্ষুনি উঠে পড়লেন কালীয়র মাথায়। দেহের ভার বহুগুণ বাড়িয়ে তার মাথায় নৃত্য করতে করতে দলন শুরু করলেন।

সেই বিপুল পদভার-দেহভার কালীয় কিছুতেই সহ্য করতে পারল না। এমনকি ক্রোধে সমস্ত বিষ উদ্গীরণ করেও কৃষ্ণের কোন ক্ষতি করতে পারল না। উল্টে শেষ পর্যন্ত বিষ শেষ হয়ে রক্ত বমন করতে করতে নিজেই মুমূর্ষু হয়ে পড়ল।

তখন কালীয়র পত্নী ও সন্তানেরা এসে কৃষ্ণের কাছে পদবন্দনা-সহকারে তার প্রাণভিক্ষা করতে শুরু করল। উপায় না-দেখে কালীয়ও কৃষ্ণের শরণ নিল।

শরণাগতকে কৃষ্ণ রক্ষা করেন। এবারও করলেন। শুধু কালীয়কে যমুনার দহ ছেড়ে চলে যাবার আদেশ দিলেন। এবং অভয় দিলেন, তার মাথায় কৃষ্ণের পদচিহ্ন দেখে গরুড় আর তার কোন ক্ষতি করবে না।

কৃপা ও আশ্বাস পেয়ে কালীয় সপরিবারে অচিরেই দহ ত্যাগ করল।

এভাবেই কালীয়কে দমন করে নদীজল বিষমুক্ত করলেন কৃষ্ণ, হলেন জগৎকল্যাণের কারণ। তাই 'কালীয়দমন' কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ লীলাসমূহের মধ্যে বিশিষ্ট।

বিশিষ্ট এই লীলাটি শ্রীমন্দিরে ভাদ্রের কৃষ্ণ-একাদশীতে উদযাপিত হয় জগন্নাথদের মধ্যাহ্ন ভোজনের পর থেকে সান্ধ্যভোজন অব্দি। এ-সময় বস্ত্র-অলঙ্কার-ফুলমালায় তিনভাইবোনের বেশ হয় গোপদের মতো। এই উপলক্ষে একটা তিরিশ ফুটের সাপ নির্মিত হয় এবং তার মাথা ঠেকিয়ে রাখা হয় জগন্নাথের পায়ের নীচে। এছাড়াও মার্কন্ড সরোবরে পাত্রপাত্রী সহযোগে নাটকের আকারে 'কালীয়দমন' লীলাটি এ-দিন অভিনয়ও করা হয়।

পরের দিন অর্থাৎ কৃষ্ণ-দ্বাদশী তিথিতে আয়োজন হয়, 'প্রলম্বাসুর বধ বেশ'-এর। এই বেশের প্রেক্ষাপটে যে গল্পটি আছে, সেটি হল :

কৃষ্ণ, বলরাম ও গোপসখারা একদিন যখন প্রান্তরে হৈ হৈ করে খেলা করছিলেন; ঠিক তখনই কৃষ্ণকে হত্যার জন্য কংস সেখানে প্রলম্ব নামের এক অসুরকে পাঠালেন। সুযোগ বুঝে হত্যা করবে বলে প্রলম্ব গোপবালকের রূপ ধরে খেলায় ভিড়ে গেল। কিন্তু, গোড়াতেই তার একটা ভুল হয়ে গেল। কারণ, সে বলরামকেই কৃষ্ণ ভেবে বসল!

এ-সময় দুই দলে বিভক্ত হয়ে যে খেলাটি হচ্ছিল তাতে নিয়ম হল, যে দল হারবে তাদের কেউ বিজয়ী দলের একজনকে কাঁধে নিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে আসবে।

বলা বাহুল্য, প্রলম্ব বলরামের বিপরীত দলে রইল। তাই তার দল হেরে যেতেই সে এগিয়ে এল বলরামকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে আসতে। তার উদ্দেশ্য একটাই, কাঁধে করে দল ছাড়িয়ে দূরের কোন নির্জন আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলরামকে মেরে ফেলা।

সুতরাং, বলরামকে কাঁধে নিয়েই সে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। কৃষ্ণ ও গোপসখাদের ছাড়িয়ে অনেকদূরে এসেও প্রলম্ব থামছে না দেখে বলরামের মনে সন্দেহ হল। তিনি কঠিন কণ্ঠে থামতে বললেন।

কিন্তু, প্রলম্ব তাতে থামল তো না-ই, উল্টে বরং তার বিকট আসুরিক রূপটি ধারণ করে নিল। এবং, বলরামকে কাঁধ ঝেড়ে সজোরে মাটিতে আছড়ে মেরে ফেলতে চাইল। কিন্তু, বলরাম শক্ত হাতে তার চুলের মুঠি ধরে থাকায় সেটি সহজে সম্ভব হলে না।

কাজেই শুরু হল আকাশ-বাতাস ঝেঁপে হুটোপাটি। তবুও, কিছুতেই প্রলম্ব বলরামকে ফেলতে পারল না। বরং, দারুণ আঘাতে বলরাম তার মাথায় ঘুষি মারতে মারতে তাকে মেরেই ফেললেন।

তখন অকুস্থলে কৃষ্ণ ও গোপসখারা মহানন্দে ছুটে এলেন। তাঁকে উল্লাসে জড়িয়ে ধরে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন।

লীলাটি বলরামের। তাই শ্রীমন্দিরে যে 'প্রলম্বাসুর বধ বেশ' হয়, তাতে বিশেষ সাজে সজ্জিত হন একমাত্র বলভদ্র। জগন্নাথ ও সুভদ্রার বেশ আর-পাঁচদিনের মতো সাধারণই থাকে। বেশের সময়কাল মধ্যাহ্নভোজনের পর, স্থায়িত্ব সান্ধ্যভোজন পর্যন্ত। এই বেশ-ঐতিহ্যের সূচনা ষোড়শ শতকে।

লিখতে লিখতে এতদূর এসেও ভাদ্র মাসের বেশভূষার কিছু বিবরণ ও চমকপ্রদ গল্প এখনও রয়ে গেল। সে-সব নিয়ে আসছি আগামি পর্বে। আজ এ-পর্যন্তই...

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...