বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা:পর্ব-১১

যিনিই কৃষ্ণ, তিনিই জগন্নাথ। প্রচলিত জগন্নাথ-কাহিনি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতকের ভক্তকবি জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্য এবং তারই ধারা বেয়ে চৈতন্যদেবের ভক্তদৃষ্টি-সবারই প্রতিপাদ্য তাই-ই। তাই শ্রাবণ মাসে শ্রীকৃষ্ণের 'ঝুলন যাত্রা' পুরীধাম ও শ্রীমন্দিরের একটি বড় লীলা-উৎসব।

শ্রীমন্দিরের ঝুলন উৎসবটির বয়স খুব বেশি নয়, তাও ধরুন প্রায় তিনশো বছর। আঠারো শতকে গজপতি রাজা দ্বিতীয় দিব্যসিংহ দেব-এর আগ্রহে এর সূচনা। উৎসবটি উদযাপিত হয় সাতদিন ধরে। শুক্ল-দশমীতে শুরু হয়ে শেষ হয় কৃষ্ণ-প্রতিপদে।

পূর্বে 'ঝুলন যাত্রা' অনুষ্ঠিত হত শ্রীমন্দির লাগোয়া সূর্য মন্দির-প্রাঙ্গণে; এখন হয়, মুক্তিমণ্ডপ ও শ্রীমন্দিরের মাঝখানের অংশে। ম্যারাপ বেঁধে, মণ্ডপ তৈরি করে। সেই ফুল ও লতামণ্ডিত সুসজ্জিত মণ্ডপটিকে বলা হয়, 'ঝুলন মণ্ডপ'।


মণ্ডপে থাকে কাঠের দোলনা। সেটি মালতি প্রভৃতি বর্ষার সুগন্ধী ফুলে ও সুদৃশ্য লতায়-মালায় সাজানো হয়। 


দশমীর দিন জগন্নাথের উৎসবমূর্তি বা প্রতিনিধিমূর্তি মদনমোহনকে কৃষ্ণের সাজে সাজিয়ে সেই দোলনায় এনে বসানো হয়। তাঁর দু'পাশে রাধার সাজে সাজিয়ে বসানো হয় শ্রীদেবী ও ভূদেবীকে। এঁদের সকলের পোশাকের রঙে উৎসবের এই সাতদিনই থাকে সবুজের ছোঁয়া।

Jagannathpuri3

এখানে যেটা লক্ষ করার বিষয়, সেটা হল: মদনমোহন কৃষ্ণ সাজেন, শ্রীদেবী-ভূদেবী রাধা সাজেন; রাধাকৃষ্ণের মতো তাঁরা লীলামধুর ঝুলনদোলায় দোলেন, মধ্যরাত্রি অব্দি ভজন ও ভক্তিগান শোনেন, নৃত্য দর্শন করেন; কিন্তু তাঁদের মধ্যে কিছুতেই পরকীয়া হয় না।


কারণ, সাংসারিক সম্পর্কে মদনমোহন-শ্রীদেবী-ভূদেবী স্বামীস্ত্রী। শ্রীমন্দিরের 'ঝুলন যাত্রা'র এটাই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।


ভাদ্র মাসে আবার কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন পালন বা জন্মাষ্টমী উৎসব শ্রীমন্দিরে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালিত হয়ে থাকে। কারণ, ওই যে জগন্নাথই কৃষ্ণ, কৃষ্ণই জগন্নাথ, তাই।

জন্মাষ্টমী উদযাপন কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমীতে শুরু হয়ে চলে ত্রয়োদশী অব্দি। প্রতিদিনই কৃষ্ণের এক একটি লীলাসাজে এক-একরকম সাজে সজ্জিত হন জগন্নাথ-বলভদ্রেরা। সেই সব সাজবেশের নাম যথাক্রমে: 'বনভোজী বেশ', 'কালীয়দমন বেশ', 'প্রলম্বাসুরবধ বেশ' এবং 'কৃষ্ণ-বলরাম বেশ'।


অষ্টমীতে অর্থাৎ জন্মের দিন গোপালসাজ হয়; নবমীতে নন্দোৎসব, সেদিনও তাই। 


দশমীর দিন হয় জগন্নাথের 'বনভোজী বেশ'। এই বেশের উৎস শ্রীকৃষ্ণের বনভোজনকালে ঘটে যাওয়া একটি পৌরাণিক ঘটনা। সেই ঘটনাটি বলতে বলতে আসুন সাজের কথা বলি:

কৃষ্ণ তখন কৈশোর ছুঁতে চাওয়া বালক। গোপবালকদের সঙ্গে অরণ্যে এসেছেন গাভী চরাতে। খানিক আগেই তাঁকে হত্যার জন্য কংস যে বিরাট সাপের মতো দেখতে অঘাসুরকে পাঠিয়েছিল, সেই বিকট অসুরকে হত্যা করে তার গ্রাস থেকে নিজেকে ও গোপবন্ধুদের উদ্ধার করেছেন কৃষ্ণ। সেটি করতে গিয়ে তাঁর যে বীরত্ব প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সমগ্র দেবলোক মোহিত হয়েছে।

Jagannathpuri4

কিন্তু, এরই মধ্যে দেবতাদের মধ্যমণি ব্রহ্মার হঠাৎ ভীমরতি হল। তিনি কৃষ্ণের আরও বীরত্ব আরও মহিমা পরখ করতে অস্থির হয়ে উঠলেন।

ব্রহ্মার যখন এসব মতিছন্ন হচ্ছে; তখন ওদিকে অসুরবধে কৃষ্ণের বীরত্ব দেখে এবং নবজীবন পেয়ে গোপবলকদের আনন্দের অন্ত নেই। এই সময় কৃষ্ণ প্রস্তাব দিলেন যে, আনন্দের এ-মুহূর্তে সকলে মিলে একসঙ্গে বনভোজন করবেন। এ-প্রস্তাবে সকলেই সানন্দে অমনি উৎসাহিত হয়ে উঠল।

গাভীগুলিকে অরণ্যে নিশ্চিন্তে চরতে দিয়ে কৃষ্ণকে মধ্যিখানে রেখে পদ্মদলের মতো সকলে তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসল। পুঁটুলি খুলে মায়ের বেঁধে দেওয়া খাবার বের করে দধি দিয়ে তারা মাখতে শুরু করল। কৃষ্ণও তাই।

কিন্তু, কৃষ্ণ গ্রাসটি যেই মুখে তুলতে যাবেন, অমনি সকলে খেয়াল করল যে, চরতে থাকা সহস্র গাভীর একটিকেও আর দেখা যাচ্ছে না! কোথায় গেল তারা! সদ্য এক অঘটন পার-করা সকলেই আসন্ন অন্যতর অঘটনের আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠল।

তখন কৃষ্ণ সকলকে আশ্বস্ত করে গ্রাসের অন্ন হাতে নিয়েই ব্যস্ত হয়েই উঠলেন। এবং, গাভীগুলিকে অরণ্যের আরও অন্দরে গেলেন খুঁজতে গেলেন। ভাবলেন, চরতে চরতে তারা হয়তো সেখানেই প্রবেশ করেছে। 

কিন্তু, সেখানে গিয়েও কৃষ্ণ তাদের দেখতে পেলেন না বা কণ্ঠলগ্ন ঘণ্টাধ্বনিও শুনতে পেলেন না। তখন হতাশ হয়ে বনভোজনস্থানে ফিরলেন।

ফিরে আরও অবাক হয়ে গেলেন কৃষ্ণ। গোপবন্ধুদের অভুক্ত খাবার পড়ে রয়েছে, কিন্তু বন্ধুরা কোথাও নেই! যেন মায়াবলে তাদেরও হঠাৎ অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে। 

কৃষ্ণ ধ্যানস্থ হয়ে বুঝলেন মায়াটা ব্রহ্মার। তিনি সবৎসা গাভী এবং সখা-গোপবালকদের হরণ করে নিকট-পর্বতের এক প্রশস্ত গুহায় লুকিয়ে রেখেছেন। করে রেখেছেন তাদের মায়াবলে আচ্ছন্ন। ব্যাপারটা বুঝে কৃষ্ণ মুচকি হাসলেন শুধু। 

তারপর সেই গোপবালকদের মায়েদের কথা ভেবে চিন্তিতও হলেন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। গোপ-মায়েরা তাঁদের পুত্রদের সধেনু প্রত্যাবর্তন করবার পথটির দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে আছেন।

LordJagannath3

সেই মায়েদের কথা ভেবেই কৃষ্ণ হৃত গোপসখাদের অবিকল প্রতিরূপ হয়ে উঠলেন। একা হয়ে উঠলেন অনেক। হয়ে উঠলেন হৃত সবৎসা গাভীদেরও প্রতিরূপ।

ফলে, আর-পাঁচদিনের মতোই সন্ধ্যের সময় নিরাপদে সকল গোপবালক ঘরে ফিরল, মায়ের আদরে আপ্লুত হল, গোয়ালে ফিরল ধেনু। 

কিন্তু কেউ বুঝতেই পারল না যে, তারা আসলেই আসল নয়। না-বুঝেই মায়েরা তাঁদের অশেষ সন্তান-বাৎসল্যে কৃষ্ণের সেবা করলেন। আর বুঝে কৃষ্ণ অসংখ্য গোপমাতার সন্তান হয়ে উঠলেন। সেবা নিতে লাগলেন, কৃপা করতে লাগলেন। প্রবাহিত হতে লাগল এক অনন্য লীলাপ্রবাহ।


এমনি করে কেটে গেল পুরো একটা বছর।


তখন ব্রহ্মা একদিন হাজির হলেন দেখতে যে, গাভী এবং গোপসখাদের হারিয়ে বিহ্বল কৃষ্ণের কী অবস্থা হয়েছে! 


কিন্তু দেখতে এসে নিজেই তাজ্জব হয়ে গেলেন। দেখলেন, সকলেই রয়েছে, সবই ঠিক চলছে! এ কী করে সম্ভব! তিনি যাদের হরণ করেছেন তারা মায়া, নাকি তিনি এখন যাদের দেখছেন তারা মায়া! 

উপলব্ধি ব্রহ্মার চোখ থেকে পর্দা সরাল। বুঝিয়ে দিল ভুল। বলল, পরমেশ্বরের নাভিপদ্ম থেকে যাঁর উদ্ভব, সেই ব্রহ্মা তাঁকে ছলনায় পারবেন কী করে!

তখন ব্রহ্মা এসে কৃষ্ণের চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন। স্বীকার করলেন ভুল। তারপর হৃত গাভী ও গোপসখাদের ফিরিয়ে দিলেন।

Jagannathpuri2

ব্রহ্মার এই আত্মনিবেদনে কৃষ্ণ তুষ্ট হলেন। তাঁকে আকাশভেদী অনন্তদেহী বিষ্ণুরূপ দেখালেন। দেখালেন সেই দেহে সমস্ত জগৎ লীন, সমস্ত লোক, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড, সমস্ত সৃষ্টি সমাহিত। বুঝিয়ে দিলেন, তিনি সবকিছুর মধ্যেই ব্যাপ্ত, সবকিছু তাঁর মধ্যেই লুপ্ত। সবকিছুই তিনি, তাঁর মধ্যেই সব। তাই গোপসখা বা গাভী হৃত হলেও সেই তিনিই, বর্তমান থাকলেও তিনি, লোপ পেলেও সেই তিনিই।

ছলনা করতে এসে ব্রহ্মা শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের কৃপা পেলেন, লীলাময়ের লীলার সাক্ষী হয়ে পরমেশ্বরের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে দেবলোকে ফিরে গেলেন।

কালক্রমে লীলাটি 'বনভোজন লীলা' হিসেবে স্থান পেল কৃষ্ণকথা-ভাগবতে। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দারুবিগ্রহ জগন্নাথের সাযুজ্য দেখাতেই পরবর্তীকালে শ্রীমন্দিরের উৎসব-ঐতিহ্যে 'বনভোজন বেশ'রূপে এই অনুপম লীলাটির উদযাপন আবশ্যিক হয়ে উঠল।  

শ্রীমন্দিরে 'বনভোজন বেশ'টি সম্পন্ন হয় দশমীর দিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর। রাখা হয় সান্ধ্যভোজন পর্যন্ত। পোশাকের দিক থেকে এই সময় জগন্নাথদের গোপবালকদের মতো করে সাজানো হয়। তবে তাঁরা যে যথেষ্ট সম্পন্ন গোপ-সর্দারের পুত্র, সেটিও সজ্জার মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়। 

তাই এ-সময় তাঁদের অঙ্গে ওঠে ওধিয়ানি, তিলক, হার প্রভৃতি বিচিত্র নামের পঁচিশ রকমের সোনার অলঙ্কার। যেহেতু 'বনভোজন বেশ', তাই আভিজাত্যের সঙ্গে বনের স্পর্শ রাখতে বুনো কেওড়া ফুলের মালাও পরানো হয়। তাতে, গ্রাম্যতা-আভিজাত্য-বন্যতা সমস্তটা অপূর্ব বিন্যাসে মিলেমিশে জগন্নাথেরা হয়ে ওঠেন একেবারে নয়নাভিরাম...

জগন্নাথের রূপসজ্জায় সৌন্দর্যের খতিয়ান সহজে শেষ হয় না। তবে বক্ষ্যমাণ রচনাটি আর বেশি দীর্ঘ করাও কাজের কথা নয়। তাই ভাদ্র মাসের যে সাজবেশগুলোর কথা বাকি রইল, তাদের গল্পসহ বিবরণ নিয়ে আসব আগামি পর্বে। আজ এ-পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...