বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: দশম পর্ব

আষাঢ় মাসে রথযাত্রার সময় জগন্নাথদের যে বিশেষ বেশভূষা হয়, তা-ই নিয়ে আজ আলোচনা করব। তার আগে গত পর্বে যে 'চন্দন যাত্রা'র বিশেষ সজ্জার কথা বলছিলাম, তার উপসংহারটুকু বলে নিই:


বিয়াল্লিশ দিনের 'চন্দন যাত্রা'য় শেষ একুশ দিনের নাম, 'ভিতর চন্দন যাত্রা'। 


প্রভূত গরমে ক্লিষ্ট হলেও এই একুশ দিন জগন্নাথদের প্রতিনিধি মূর্তিরা চন্দন ও সুগন্ধী মেখে শীতল-স্নান মন্দিরেই সম্পন্ন করেন। নিত্যদিন নৌকোলীলা করতে তাঁরা আর নরেন্দ্র সরোবর যান না। শুধুমাত্র অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী ও একাদশী তিথিতে সন্ধ্যাকালে সদলবলে সাজগোজ করে যান হাওয়া খেতে। নৌকোবিহার করে হালকা হয়ে আসেন। 

'ভিতর চন্দন যাত্রা' শেষ হয় 'স্নান যাত্রা'র মধ্য দিয়ে। তখন জগন্নাথের একটি বিশেষ সাজ হয়। তিনি হস্তিবেশে সুসজ্জিত হন। তাঁর এই হস্তিবেশ কেন হয়, কীভাবে হয়-এ-নিয়ে ক'দিন আগেই পৃথক একটি লেখায় বিস্তারিত লিখেছি, তাই তার আর পুনরাবৃত্তি না-করে আসুন রথযাত্রার বিশেষ সাজে মন দিই...

Jagannathx1

রথযাত্রার সময় জগন্নাথদের যে বিশেষ সজ্জায় সাজানো হয়, তাকে বলা হয়, 'সুনা বেশ' অর্থাৎ স্বর্ণবেশ। এ-সময় জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা একেবারে আপাদমস্তক স্বর্ণমন্ডিত হয়ে ওঠেন। এই বেশকে 'রাজবেশ', 'রাজরাজেশ্বর বেশ' এবং 'রাজাধিরাজ বেশ'ও বলা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বলা হয়?

জগন্নাথ-অঙ্গে এই বেশের সূত্রপাত শোনা যায় উৎকলের রাজা অনঙ্গ ভীম দেবের আমলে। ত্রয়োদশ শতকে। কারণ, তিনি এই সময় জগন্নাথকে 'উৎকলরাজ', 'জাতির রাজা' প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করেন। 

এবং, তিনিই রথযাত্রাকালে জগন্নাথকে রাজার মতো সোনাদানামণ্ডিত বিশেষ সজ্জায় সাজানোর ব্যবস্থা করেন। ফলে, সেই সময় থেকেই এই বিশেষ সজ্জাটিকে 'রাজবেশ', 'রাজরাজেশ্বর বেশ', 'রাজাধিরাজ বেশ' প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হতে থাকে। 


তবে, বেশভূষায় সোনার জাঁক বিপুল পরিমাণে বাড়ে আরও এক শতক পর। পনের শতকে। রাজা কপিলেন্দ্রদেবের আমলে। 


শোনা যায়, দক্ষিণ দেশের এক রাজাকে পরাজিত করে একবার কপিলেন্দ্রদেব স্বদেশে ফেরেন প্রচুর সোনাদানা হিরেজহরত নিয়ে। তার পরিমাণ এত যে ষোলখানা হাতির পিঠেও তা বোঝা হয়ে ওঠে। তবে সে-সব রত্নরাজি বয়ে এনেও আপন রত্নাগারে ঢোকাতে দেননি কপিলেন্দ্র। সমস্তটাই উৎসর্গ করেন জগন্নাথের শ্রীচরণে। কারণ, তিনি মনে করেন, তাঁর এ-জয় জগন্নাথেরই কৃপা, জগন্নাথেরই অনুগ্রহের ফল।

সুতরাং, সেই বিপুল রত্নরাজি ঠাঁই পায় মন্দিরের রত্নাগারে। কপিলেন্দ্র শুধু আদেশ দেন যে, ওই রত্নরাজি দিয়ে তিন দেবদেবীর জন্য যথেচ্ছ সুদৃশ্য অলঙ্কার তৈরি করানো হোক। আর তাই দিয়েই সম্পন্ন হোক রাজাধিরাজের বিশেষ সাজ, 'স্বর্ণবেশ'। এই হচ্ছে স্বর্ণবেশের জাঁকজমকের ইতিহাস।

Jagannathx2

মন্দিরের সেই বিশাল স্বর্ণভাণ্ডার থেকে রাজার আদেশে স্বর্ণকার ও মনিকারেরা কী কী সাজ-উপকরণ এবং অলঙ্কারসমূহ তৈরি করেন, তার একটি বর্ণনামূলক তালিকা দিই আপনাদের:


১. শ্রীহস্ত - সোনার হাত।

২. শ্রীপায়ার - সোনার পা।

৩. শ্রীমুকুট - সোনার সুদৃশ্য বড় মুকুট।

৪. শ্রীময়ূরচন্দ্রিকা - শ্রীকৃষ্ণের মাথায় যেমন ময়ূর পালক বাঁধা থাকে, তেমনি জগন্নাথের জন্য সোনার বন্ধনী সমেত সোনার ময়ূর পালক।

৫. শ্রীচুলপটি - কপালের সৌন্দর্য বাড়াতে সিঁথি থেকে কপাল অব্দি ঝোলানো পদক।

৬. শ্রীকুণ্ডল - ঝুলন্ত গোলকের আকৃতিবিশিষ্ট সোনার কর্ণকুণ্ডল। 

৭. শ্রীরহুরেখা - মুখের চারপাশে পরানোর জন্য প্রায় বর্গাকার অলঙ্কার। এর উজ্জ্বলতা মুখের চারপাশে এক স্বর্গীয় দীপ্তি সৃষ্টি করে।

৮. শ্রীমালা - অনেক রকমের আকার ও নকশাযুক্ত মালা রয়েছে। যেমন:

৮.১. পদম মালা - পদ্ম আকৃতির মালা।

৮.২. সেভতি মালা - ছোট্ট সূর্যমুখী ফুলের আকার-বিশিষ্ট মালা।

৮.৩. অগস্তি মালা - চাঁদের আকার-বিশিষ্ট মালা।

৮.৪. কদম্ব মালা - সোনার কদম্ব দিয়ে তৈরি মালা।

৮.৫. কাঠি মালা - সোনার পুঁতি দিয়ে তৈরি মালা।

৮.৬. ময়ূর মালা - ময়ূর পালকের নকশা ও আকৃতিযুক্ত মালা।

৮.৭. চম্পা মালা - মালাটি একেবারে হলুদ চাঁপা ফুলের মতোই দেখতে।

৯. শ্রীচিতা - এটি তিন দেবদেবীর তৃতীয় নয়ন। সোনার তবকে আটখানি মহামূল্যবান রত্ন চোখের আকৃতিতে সন্নিবিষ্ট করে তিনটি শ্রীচিতা তৈরি করা হয়েছে। তবে জগন্নাথের শ্রীচিতাটির মধ্যিখানে চোখের তারার মতো করে বসানো রয়েছে অত্যুজ্জ্বল হিরে। এই হিরে তাঁর সত্ত্বগুণকে নির্দেশ করে।

       সুভদ্রার শ্রীচিতার মধ্যিখানে রয়েছে পান্না। এটি তাঁর রজঃগুণকে নির্দিষ্ট করে।

১০.  শ্রীচক্র - সোনার সুদর্শন চক্র। 

১১.  শ্রীগদা - সোনার গদা।

১২. শ্রীপদ্ম - সোনার পদ্ম।

১৩. শ্রীশঙ্খ - রূপোর শাঁখ।

Jagannathx3

এছাড়া আরও প্রায় শ'দেড়েক নানান নামের নানান আকারের অলঙ্কার রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করা হয় না বা বেরই করা হয় না মন্দিরের রত্নভাণ্ডার 'ভিতর ভাণ্ডারঘর' থেকে। যেটুকু বের করা হয়, তারই ওজন প্রায় দুই কুইন্ট্যাল বা তার কিছু বেশি। বলা বাহুল্য, ভাণ্ডারের মোট রত্নমালার বর্তমান মূল্য কম করেও কয়েক লক্ষ কোটি টাকা।

যাই হোক, উপরোক্ত যে-সব অলঙ্কারের তালিকা দেওয়া হল, তাই দিয়েই বছরের পর বছর ধরে তিন দেবদেবীর স্বর্ণবেশ হয়ে আসছে। বেশকর্ম শুরু করার ঠিক এক ঘন্টা আগে প্রভূত সশস্ত্র প্রহরীদের নজরদারিতে এই সব অলঙ্কারমালা পুষ্পালক ও দয়িতাপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।


এ-সময় তিন রথ পর পর সিংহদুয়ারে অবস্থান করে। নিজ নিজ রথে অধিরূঢ় হন তিন দেবদেবী। 


তখন সদলে সেখানে এসে দয়িতাপতিদের নির্দেশে পুষ্পালকেরা প্রথমে তিন দেবদেবীর হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গ সংস্থাপন করেন। তারপর একে একে দ্রুত হাতে আপাদমস্তক পরিয়ে দেন রত্নখচিত অঙ্গশোভন সুবর্ণ-অলঙ্কারমালা। জগন্নাথের ডান হাতে দেন সোনার সুদর্শন, বাম হাতে রূপোর শঙ্খ। বলভদ্রের বাম হাতে দেন সোনার লাঙ্গল, ডান হাতে সোনার গদা। আর দেবী সুভদ্রাকে দেন পদ্মের ভার। সেও সোনার।

'স্বর্ণবেশ' আষাঢ়ের শুক্ল একাদশীতে রথযাত্রার সময় যেমন অনুষ্ঠিত হয়, তেমনি বছরের অন্যান্য সময়ে আরও চার বার অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। বিজয়া দশমী, কার্তিক পূর্ণিমা, পৌষ পূর্ণিমা ও মাঘ পূর্ণিমার দিন। তবে তফাৎটা হচ্ছে, এই চারদিন মন্দিরের ভেতর রত্নবেদির ওপর জগন্নাথেরা 'স্বর্ণবেশ' ধারণ করেন; আর আষাঢ়ে মন্দিরের বাইরে, রথের ওপর।

অন্দরের সেই সব 'স্বর্ণবেশ'-এর বিবরণ অবশ্য বছরের বিশেষ বেশভূষা পরিক্রমা করতে করতে ঠিক সময়ে সবিস্তারেই আপনাদের জানাব। তার আগে আগামি পর্বে শোনাব শ্রাবণ মাসে জগন্নাথদের যে বিশেষ সজ্জা ও বেশভূষা অনুষ্ঠিত হয়, তার কাহিনি। আজ এই পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...