কাল, মাস ও ঋতুবৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ রেখে শ্রীক্ষেত্রবাসী জগন্নাথদেবের সেবানীতিতেও বৈচিত্র্য রাখা হয়েছে। সেই প্রয়োজনকে মাথায় রেখেই বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশিষ্ট সব উৎসবের আয়োজন রাখা হয়েছে। আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিধান দেওয়া হয়েছে উপযুক্ত সাজবেশেরও।
আসুন, বছরের শুরু থেকেই এই বিশেষ-পর্বের সজ্জামালা ও ঐতিহ্য অবলোকন করি:
বছরের প্রথম মাস, বৈশাখ। এই মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিটি ধর্মীয়ভাবনার দিক থেকে বিশিষ্ট। সব দিক থেকে এই তিথিটিকে শুভ বিবেচনা করে এই তিথির নাম দেওয়া হয়েছে, 'অক্ষয় তৃতীয়া'।
যে-কোন শুভকাজ শুরু করার জন্য ওই তিথিটিকে আদর্শ বলে নিদান দেওয়া হয়েছে শাস্ত্রে। তাই জগন্নাথদেবের বাৎসরিক শুভ উৎসবের সূচনাও হচ্ছে এই তিথি থেকেই।
অক্ষয় তৃতীয়া থেকে জগন্নাথদেবের যে বিশেষ লীলা-উৎসবটির সূচনা, তার নাম, 'চন্দন যাত্রা' বা 'গন্ধলেপন যাত্রা'। এতে জগন্নাথের জন্য যে বিশেষ সেবানীতি নির্ধারিত রয়েছে, তাকে বলা হয়, 'চন্দনবেশ'।
উৎসবটি বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়ায় শুরু হয়ে চলে জ্যৈষ্ঠের শুক্ল অষ্টমী অব্দি। অর্থাৎ, বিয়াল্লিশ দিন ধরে। এটাই জগন্নাথদেবের সবচেয়ে বড় লীলা-উৎসব।
বৈচিত্র্যভেদে এই উৎসবকে দুটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে, 'বাহার চন্দন যাত্রা' এবং 'ভিতর চন্দন যাত্রা'। প্রথম পর্ব চলে প্রথম একুশ দিন ধরে, দ্বিতীয় পর্ব চলে বাকি একুশ দিন যাবৎ। দুয়ে মিলে মোট বিয়াল্লিশ দিন পূর্ণ হয়।
মূল উৎসবে প্রবেশের আগে উপরোক্ত ধরতাইটুকুর প্রয়োজন ছিল। সেটুকু যখন সুসম্পন্ন হয়ে গেছে, তখন আসুন উৎসবের বিস্তারে প্রবিষ্ট হই:
আর পাঁচটা সাধারণ দিনে জগন্নাথ ও তাঁর ভাইবোনকে যেমন ঘুম থেকে তোলা হয়, সেভাবেই তোলা হয়েছে, মঙ্গল আরতি করে মুখ ধোয়ানো হয়েছে, স্নান করানো হয়েছে, বস্ত্র পরিবর্তন করানো হয়েছে এবং এক্ষুনি সকালের ভোগ নিবেদনও হয়ে গেল। তবুও এ-দিন আর পাঁচটা দিনের চেয়ে আলাদা। কেন?
ওই দেখুন, ভোগ নিবেদন শেষ হতেই সেবকদের দল মাঝারি একটি রুপোরপাত্রে বাটা চন্দন নিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করল--যা আর পাঁচটা সাধারণ দিনে আমরা দেখিনি।
এবার দেখুন, তিনবার রত্নবেদি প্রদক্ষিণ শেষে তিন ভাইবোনকে প্রণাম করে বাটা চন্দনের পাত্রটি তারা রত্নবেদির ওপর স্থাপন করল। চন্দনটি টাটকা নয়, আগের দিন বেটে রাখা হয়েছিল। এটাই নিয়ম।
আসলে, ধারণা করা হয় যে, টাটকা চন্দনের চেয়ে বাসি চন্দন বেশি ঠাণ্ডা। ফলে, তা গায়ে মাখলে গরমে শরীর প্রভূত শীতল রইবে। আর 'চন্দন যাত্রা' উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই তো হচ্ছে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠের বিরক্তিকর দাবদাহে শ্রীঅঙ্গ শীতল রাখা; তিন ভাইবোনকে আরাম ও আনন্দে রাখা। তাই এই উদ্দেশ্যমূলক উৎসবের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হল, 'চন্দনবেশ' অর্থাৎ গায়ে চন্দনলেপন।
আমরা বিগত পর্বগুলিতে জেনেছি যে, ভোগ নিবেদন হয়ে গেলেই ঝটপট 'মৈলম' অর্থাৎ বিগ্রহের বস্ত্র পরিবর্তন করাতে হয়। কিন্তু, আজ থেকে আগামি বিয়াল্লিশতম দিন পর্যন্ত আগে ওই বাটা চন্দন ভালো করে বিগ্রহের গায়ে মাখিয়ে তারপর বস্ত্র পরিবর্তন করতে হবে।
ওই দেখুন, ইতিমধ্যেই জগন্নাথদের শ্রীঅঙ্গে চন্দনচর্চা আরম্ভ করে দিয়েছে পুষ্পালক, পালিয়া মেকপ প্রভৃতি সেবকের দল। চোখ বন্ধ করে অনুভব করুন, ওই দারুঅঙ্গ চন্দনের ললিত প্রলেপে ক্রমশ শীতল হয়ে উঠছে! গর্ভগৃহ ক্রমে সুরভিত হয়ে উঠছে শ্বেত চন্দনের অপূর্ব সুগন্ধে!
এবার চোখ খুলে দেখুন, সুললিত ছন্দে চন্দন মাখানো শেষ করে তিন ভাইবোনকে সুতির হালকা বস্ত্র পরিয়ে ফুলমালায় সুসজ্জিত করে সেবকেরা বিদায় নিচ্ছে।
হ্যাঁ, এবার জগন্নাথদের মুখের দিকে তাকান। দেখুন, কেমন স্নিগ্ধ-মধুর-প্রসন্নতা! অন্তর্যামীর করুণাঘন অন্তর যেন আয়না হয়েছে! তাই না?...
সময় বড় বেগবান। দেখতে দেখতে দেখুন কেমন নৈমিত্তিক দ্বিপ্রাহরিক ভোগের সময় হয়ে গেল। এবার আপনাদের একটি নতুন ব্যাপার দেখাব। দেখুন, তিন ভাইবোনের সঙ্গে রত্নসিংহাসনে বিরাজ করছেন আরও দুই বিগ্রহ, মদনমোহন এবং রামকৃষ্ণ। তিন ভাইবোনের এমন সমকক্ষ হয়ে বসবার সৌভাগ্য কোন দেবদেবীর হয়েছে, এমনটা এর আগে কখনও দেখেছেন কি? উঁহু, দেখেননি।
আসলে, মদনমোহন এবং রামকৃষ্ণ হলেন যথাক্রমে জগন্নাথ ও বলভদ্রের প্রতিনিধি বিগ্রহ। বাইরের লীলা উৎসবই বলুন বা অনুষ্ঠান, সেখানে জগন্নাথরা স্বয়ং যান না; আপন প্রতিনিধিকে পাঠান।
তাই এই দুই প্রতিনিধি এখন মধ্যাহ্নের ভোজন জগন্নাথদের সঙ্গে সমাধা করবেন। তারপর যাবেন নরেন্দ্র সরোবরে জলক্রীড়া বা জলকেলি করতে। দাদাদের এই জলকেলিতে বোন সুভদ্রার কিন্তু কোন প্রতিনিধি থাকে না। তিনি এই আনন্দে একরকম উপেক্ষিতাই। কেন?
প্রশ্নটির উত্তর অল্প সময়ের জন্য উপেক্ষা করে বলি, মধ্যাহ্নের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে জলবিহারের চেয়ে আমোদ আর কিছুতেই নেই। সেখানে প্রতিনিধির আনন্দেই জগন্নাথের আনন্দ, প্রতিনিধির ক্রীড়াই জগন্নাথের ক্রীড়া, প্রতিনিধির আরামেই জগন্নাথের আরাম, প্রতিনিধির লীলাই জগন্নাথের লীলা। কারণ, যিনিই মদনমোহন, তিনিই তো জগন্নাথ। এই প্রতিনিধি বিগ্রহকে মন্দিরের ভাষায় বলা হয়, 'উৎসব মূর্তি'।
আমাদের কথার মধ্যেই মধ্যাহ্ন ভোজন সমাধা করে নব বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছেন মদনমোহন ও রামকৃষ্ণ। তাঁরা এবার পালকিতে উঠবেন। দুজনের দুটি আলাদা পালকি। সুদৃশ্য ও সুসজ্জিত। যে সেবকেরা তাঁদের পালকিবাহক হবে তাদের বলা হয়, 'বিমান বাদু'।
বিমান বাদুরা মদনমোহন ও রামকৃষ্ণকে নিয়ে এলেন শ্রীমন্দিরের সিংহদুয়ারে। কিন্তু, সিংহদুয়ারে আসতেই মদনমোহনের পালকিতে এসে উঠলেন তাঁর দুই লীলাসঙ্গিনী। শ্রীদেবী এবং ভূদেবী। দু'পাশে দু'জন।
এবার বুঝতে পারলেন তো, দাদার এই রভসযাত্রায় সুভদ্রার কোন প্রতিনিধি কেন নেই? এও নিশ্চয় বুঝতে পারলেন যে, বোনের চোখ এড়াতেই গর্ভগৃহে দুই দেবীকে স্থান দেওয়া হয়নি। আর সেজন্যই খানিকদূর এগিয়ে আসার পরই তবে তাঁদের পালকিতে ওঠার ব্যবস্থা!
এই দেখুন, মদনমোহনদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন আরও পাঁচ জন। লোকনাথ, জ্ঞানেশ্বর, কপালমোচন, মার্কণ্ডেশ্বর ও নীলকণ্ঠেস্বর। শ্রীমন্দির প্রাঙ্গণের পাঁচ শিব-মন্দিরের পাঁচ শিব এঁরা। এঁদের একত্রে বলা হয়, 'পঞ্চপাণ্ডব'।
আসলে, মনে করা হয় যে, 'মহাভারত'-এর পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের প্রিয়সখা শ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদ সইতে পারেননি। তাই শ্রীকৃষ্ণ যখন জগন্নাথরূপে উদ্ভূত হলেন, তখন তাঁরাও পাঁচ শিবের মূর্তি ধরে শ্রীক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গী হলেন। পূজ্য হলেন। জগন্নাথের বিশেষ লীলা উৎসবের সঙ্গী হলেন। তাঁদেরও মন্দির হল।
শ্রীমন্দিরের সিংহদুয়ার থেকে নরেন্দ্র সরোবর, দেড় কিমি পথ। 'গীতগোবিন্দ'র গান আর ওড়িয়া ভজন মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে শুনতে শুনতে এই পথটুকু পাড়ি দেবেন দেববিগ্রহেরা। আর আমোদিত হবেন, পালোয়ানদের কসরৎ দেখে।
নির্দিষ্ট সময়ে জগন্নাথের অনুমতি নিয়ে শুরু হল পথ চলা। বড় দণ্ডা অর্থাৎ বড় রাস্তা ধরে।
প্রথমে মদনমোহন-শ্রীদেবী-ভূদেবীর পালকি, তারপর রামকৃষ্ণের পালকি, তারপর আলাদা আলাদা পালকিতে পঞ্চপাণ্ডব। তাঁদের সঙ্গে পাখাবরদার-পতাকাবাহী-ছত্রধরের দল আপন আপন দায়িত্ব পালন করতে করতে এগিয়ে চলল, এগিয়ে চলল পুরুত-পাণ্ডা-সেবকের দলও। প্রশস্ত হল শোভাযাত্রা। ভক্তদের শারীরিক কসরৎ-নাচ-গান-মন্ত্র ও জয়ধ্বনির জাঁকে পথ হয়ে উঠল যেন চলমান উৎসব-প্রাঙ্গণ।
চলতে চলতে পথে পড়ল রাজবাড়ি। সেখানে এসেই শোভাযাত্রা হঠাৎ থমকে গেল। কিন্তু, কেন?
প্রশ্নের উত্তরে আসবে গল্প। সেই গল্প আজ না, আগামি পর্বে। আজ এ-পর্যন্তই...