বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: সপ্তম পর্ব

কবি জয়দেবের একবার সাধ হল, স্বরচিত গীতিকাব্য ‘গীতগোবিন্দ’-এর শ্লোকমালা প্রিয় জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্রকে অর্ঘ্য দেবেন। 

আসলে, গানে গানে অর্ঘ্য তো প্রায়ই দেন, কাব্যের পুঁথিটিও পদতলে একবার রেখেছিলেন—এবার একটু অন্যভাবে দিতে হবে; যাতে বহুক্ষণ তাঁর সৃষ্টি প্রিয় দেবতাদের স্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়। কিন্তু, উপায় কী?

জয়দেবের জন্মভূমি কেন্দুলি সসান গ্রামে যেসব তাঁতিরা বাস করেন, তাঁরা যথার্থ অর্থেই ‘তাঁতশিল্পী’। 

দ্বাদশ শতকের বহুযুগ আগে থেকেই তাঁরা সিল্কের কাপড় বোনায় সিদ্ধহস্ত। পুরীর রাজবাড়ির অন্দরে এদের বোনা কাপড় যেমন যায়, তেমনি জগন্নাথ মন্দিরেও যায় দেবতাদের বসন হিসেবে। 

দু'তরফের চাহিদার কারণ, এ-গ্রামের তাঁতিরা কাপড়ে সুতো বেঁধে রঙে চুবিয়ে এমন সুন্দর সুন্দর বাটিকের নকশা তুলতে পটু যে, তেমনটা আর কেউ পারে না।

LordJagannath3

হঠাৎ জয়দেবের মনে হল, যদি এঁদের দিয়ে কাপড়ের গায়ে নকশার মতো করে ‘গীতগোবিন্দ’-এর শ্লোক লিখিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তা জগন্নাথদের অঙ্গে বহুক্ষণ শোভা পাবে, গানের অনুরণনের মতো ক্ষণিকের হবে না! হ্যাঁ, এমন যদি করা যায়, তাহলে তো বেশ হয়!


যেমন ভাবা, তেমন কাজ। জয়দেব অমনি মনের কথা বলতে গেলেন তাঁতিপাড়ায়।


জয়দেব বড় ভক্ত, পণ্ডিত, কবি; গাঁয়ের গর্ব। তাই গাঁয়ের লোক তাঁকে যেমন সম্মান করে, তেমনি ভালোও বাসে। 


ফলে, তাঁতিপাড়ায় মনের কথাটি বলতেই একেবারে যেন হুলস্থুল পড়ে গেল। বাহ, এ তো ভালো কথা; দারুণ কথা! যে কাব্যি জগন্নাথের এত প্রিয়, তাকে তাঁর অঙ্গের ভূষণ করতে পারলে তো বেশ হয়!

অমনি উৎসাহের চোটে সকলেই লেগে পড়ল কাজে। চেষ্টা করতে লাগল বুদ্ধি দিয়ে কাপড় ভাঁজ করে সুতো বেঁধে রঙে চুবিয়ে 'গীতগোবিন্দ'-এর শ্লোক কাপড়ের গায়ে আঁকার। তাঁতিরা তো সংস্কৃত জানে না, দেবনাগরী হরফ লিখতেও জানে না; তাই তারা ওড়িয়া হরফেই লেখার চেষ্টা করল সংস্কৃত শ্লোক।

কথায় বলে, মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করলে সব হয়। সেভাবে তাঁতিরাও একসময় সফল হল। 

তারা সফল হতেই আনন্দে আত্মহারা হলেন জয়দেব। তিনি তিনখানা খান্ডুয়া বস্ত্র নিয়ে অমনি ছুটতে ছুটতে হাজির হলেন গিয়ে মন্দিরে। 'গীতগোবিন্দ'র পদ গাইতে গাইতে পরিয়ে দিলেন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে।

LordJagannath2

ইচ্ছে পূরণ হল জয়দেবের। স্বপ্নপূরণ হল তাঁর। ইষ্ট মাধবের প্রণয় নিয়ে লেখা কাব্যটিকে এভাবেই জগন্নাথরূপী প্রিয় মাধবের অঙ্গের ভূষণ করতে পেরে জয়দেব ধন্য হলেন।

জয়দেবের কাহিনিটি কিংবদন্তি বেয়ে পাওয়া। এর পরবর্তী অংশ আপনাদের শোনাব জগন্নাথ মন্দিরের প্রামাণ্য ধারাবাহিক ইতিহাস ‘মাদলা পাঁজি’র বিবরণ থেকে। এটি কিংবদন্তিকালের ছ'শো বছর পর অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমদিকের কথা। 

তখন কেন্দুলি সসান গ্রামের তাঁতিদের তাঁতশিল্পে অবনতি ঘটেছে, অভ্যুত্থান হয়েছে মনিয়াবাঁধা ও নুয়াপাটনা গ্রামের তাঁতিদের। তবে, জয়দেব ও 'গীতগোবিন্দ'র শ্লোক-ছাপা খান্ডুয়া শাড়ির কিংবদন্তি তখনও উৎকলের আকাশে-বাতাসে।

এই সময় পুরীর রাজসিংহাসনে বিরাজ করছেন সোমবংশীয় রাজা রামচন্দ্র দেব। তিনি কেন্দুলি সসান গ্রামের ক্ষীয়মাণ তাঁতিদের কাছ থেকে রাজপরিবার ও মন্দিরের জন্য খান্ডুয়া বানানোর অধিকার কেড়ে নিলেন; দিলেন নুয়াপাটনার তাঁতিদের। 

১৭১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাজা রামচন্দ্র দেব কিংবদন্তির কথা মাথায় রেখে প্রতিদিন যাতে জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'র শ্লোকছাপা খান্ডুয়া জগন্নাথদের পরানো হয়, সেই নিয়মটি চালু করলেন। 

এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ওই বিশেষ কাপড়টির নাম হয়ে উঠল, 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া'। এছাড়াও এই পর্বেই 'বড়শৃঙ্গার বেশ'-এর সময় জগন্নাথদের এই 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া' পরানো এবং পরানোর সময় 'গীতগোবিন্দ'-র পদ গেয়ে শোনানোর রীতিটিও রামচন্দ্র দেবের আগ্রহেই তৈরি হল।

'খান্ডুয়া' শব্দের অর্থ, 'কোমরের নীচের পরার কাপড় বা শাড়ি'। কিন্তু, এর দৈর্ঘ্য বারো হাত হওয়ায় বাঙালি মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরেন, সেভাবেও পরা যায়।

JagannathsOutfits2

হস্তচালিত তাঁতে বোনা সিল্কের এই শাড়িটি মূলত হালকা লাল রঙের হয়। তাছাড়া হালকা গোলাপি, হলুদ, সবুজ, কমলা রঙেরও হয়ে থাকে। পাড় ও আঁচলে রাখা হয় লাল, নীল, সবুজ রঙ। আবার অনেক সময় কালচে আঁচলও দেখা যায়। 

এই শাড়িতে ব্যবহৃত সমস্ত রঙই ভেষজ। লাল রঙ তৈরি করা হয় শাল গাছের ছাল থেকে। কাপড়ের জমিতে বাটিক পদ্ধতিতে আঁকা হয়-শঙ্খ, গদা, পদ্ম, হাতি ও নানান বনজ লতা, ফুল, গাছ, পাখি, পশুর নকশা।

শাড়িটি বোনার সময় যিনি বুনছেন, তাঁকে বোনার সময় উপোষ দিয়ে থাকতে হয়, ধোয়াকাচা-শুদ্ধ কাপড় পরে থাকতে হয় এবং যে-ক'দিন বোনার কাজ চলে, সে-ক'দিন সম্পূর্ণ নিরামিষ খেয়ে থাকতে হয়।

খান্ডুয়া শুধু যে দেবতাদের নিত্যি পরানো হয়, তাই নয়। রথযাত্রা এবং উল্টোরথের সময় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার তিনটি রথই যে ভিন্ন ভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে মোড়া হয়, তাও কিন্তু খান্ডুয়া।

জগন্নাথদের 'নবকলেবর' অনুষ্ঠানের সময় 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া'র বিশিষ্ট ভূমিকা থাকে। বারো বা উনিশ বছরের ব্যবধানে দেবদ্বয় ও দেবী সুভদ্রার নবকলেবর গড়তে 'দারু' অনুসন্ধানের জন্য দয়িতাপতির নেতৃত্বে মন্দির থেকে অরণ্যে যাওয়ার যে রীতি, তাকে বলা হয়, 'বনজগযাত্রা'। 

যাত্রার আগে রত্নবেদির সামনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান থাকে, তার নাম, 'শাড়িবান্ধা'। এই অনুষ্ঠানে জগন্নাথদের ব্যবহৃত 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া' ফেট্টির মতো করে সকলকেই মাথায় বাঁধতে হয়। বেঁধে দেন ভিতরচা মহাপাত্র-নামের সেবক-সম্প্রদায়।

Jagannath1

তারপর জগন্নাথদের আজ্ঞা নিয়ে পথে বেরিয়ে 'বনজগযাত্রা'র দলটি আসে কাকতপুরে দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দিরে। পুজো করে দেবীর মাথাতেও অনুরূপ একটি ফেট্টি বেঁধে দেন তাঁরা। প্রার্থনা জানান, 'দারু' অনুসন্ধানে দেবী যেন তাঁদের সহায় হন। 

এমনটা করার কারণ, মনে করা হয় যে, এই দেবীর সঙ্গে জগন্নাথদেবের আত্মীয়তা রয়েছে। ফেট্টিসূত্রে সেই আত্মীয়তা যেমন স্মরণ করানো হয়, তেমনি জগন্নাথ যে এবার নবকলেবরে অধিষ্ঠিত হবেন, সেই বার্তাও দেওয়া হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময় এভাবে 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া' মানব এবং মূর্তি উভয়ের মাথায় বাঁধার কারণটি কি? 

আসলে, 'গীতগোবিন্দ'-র যে শ্লোকটি এই সময় খান্ডুয়ায় ছাপা থাকে, তার অর্থ, 'রাধার পার্থিব আবেগ-অনুভূতি তুচ্ছ করে মাধব কংসবধ করতে গোপভূমি ত্যাগ করেছিলেন।' 

অর্থাৎ, এই বাণীটি মাথায় বেঁধে যেন জগন্নাথকে ভক্তরা বার্তা দেন, হে জগন্নাথ রাধার অমন হৃদয়-নিংড়ানো পার্থিব আবেগ-অনুভূতিকে তুমি যখন তুচ্ছ করতে পেরেছিলে, তখন বর্তমানের এই মায়াময় দারুদেহ ত্যাগ করতে তোমার কোন কষ্ট হওয়ারই কথা নয়। গোপভূমি ত্যাগ করে তুমি কখনই আর ফিরে যাওনি, কিন্তু পুরনো কলেবর ত্যাগ করেও নবকলেবরে তোমার আবার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে; হে জগদীশ্বর, এতে তোমারই বা দুঃখ কী? আমাদেরই বা শোক কোথায়!...

'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া'র ইতিকথা এখানেই শেষ হল। আগামি পর্ব থেকে শোনাব বছরের বারো মাসে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে বারো রকমের বিশেষ সজ্জায় জগন্নাথদের কেন ও কীভাবে সাজানো হয়, তার গল্প। আজ এই পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...