প্রতিদিন রাত্রে শোবার আগে জগন্নাথ ও তাঁর ভাইবোনের যে সাজবেশ হয়, বিগত পর্বে আপনারা তো জেনেইছেন যে, তার নাম, 'বড়শৃঙ্গার বেশ'।
আপনারা এও জেনেছেন যে, এই সময় তাঁদের একটি বিশেষ কাপড় পরানো হয়, তার নাম, 'বরলাগি পট্ট'। হস্তচালিত তাঁতে বোনা বারো হাত লম্বা এই কাপড়টি সিল্কের তৈরি। এই কাপড়ের গায়ে ওড়িয়া হরফে সংস্কৃত সাহিত্যের কবি জয়দেব রচিত 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের শ্লোক ছাপা থাকে। তাই কাপড়টিকে 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া'-নামেও ডাকা হয়।
শুধু তাই নয়, কাপড়টি যখন জগন্নাথ এবং তাঁর ভাইবোনকে পরানো হয়, তখন 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের শ্লোকও গেয়ে গেয়ে শোনানো হয়। এটাই ঐতিহ্য অর্থাৎ 'রীতি'। মন্দিরের পরিভাষায় যাকে বলে, 'নীতি'।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কবি জয়দেব দেবতা জগন্নাথের সঙ্গে জুড়লেন কী করে? জগন্নাথদের বিশেষ সাজ (তা, নিদ্রা-বেশ বা অভিসার-বেশ যাই হোক না কেন), তার সাথে জয়দেবের লেখা 'গীতগোবিন্দ' গীতিকাব্যটি অত্যন্ত আবশ্যিক হয়ে উঠল কেন?
অর্থাৎ, ওই বিশেষ কাপড়টিতে 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের শ্লোক লেখা হয় কেন? কাপড়টি পরানোর সময় ওই কাব্যের শ্লোকগানই বা গাওয়া হয় কেন?
অনেকগুলো মনে হলেও, প্রশ্ন আসলে একটাই। প্রথমেরটি। বাকিগুলো উত্তর খোঁজার অভিমুখ। আসুন, উত্তর খুঁজি:
আমরা জানি যে, জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের বাঙালি কবি। বীরভূমের কেন্দুলিতে তাঁর জন্ম। অজয়নদের তীরে সম্বৎসর মকর-সংক্রান্তির কালে তাঁর নামে আউল-বাউল মেলা বসে।
কিন্তু, সর্বভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা জয়দেবের বাঙালিয়ানায় বাদ সেধেছেন। তাঁরা তথ্যসহ প্রমাণ করেছেন যে, জয়দেব ওড়িয়া। পুরী থেকে খানিক দূরে প্রাচী নদীর তীরে যে কেন্দুবিল্ব বা কেন্দুলি সসান গ্রামটি এখনও রয়েছে, সেখানেই তাঁর জন্ম। তাতে অবশ্য জন্মস্থান-বিতর্ক শেষ হয়ে যায়নি; তাঁদের 'প্রমাণ' বেশিরভাগ পণ্ডিতই মেনে নিয়েছেন, অনেকেই মানেননি।
যাই হোক, দ্বাদশ শতকে প্রাচী নদীতীরের কেন্দুলি সসান গ্রামটিতেই জয়দেবের জন্ম ধরেই আমরা এগোব। কারণ, ডঃ সুকুমার সেনের মতো বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক প্রথম দিকে বিরোধ করলেও পরে এই মতটিকেই যুক্তিযুক্ত বুঝে মেনে নিয়েছেন।
কেন্দুলি সসান গ্রামের বৈষ্ণব ভোজদেব ও রাধাদেবীর পুত্র জয়দেব শৈশবের পাঠ শেষ করলেন গ্রামেই। তারপর শ্রীকুর্মপতাকায় গিয়ে নাচ, গান ও কাব্য-সাহিত্যের পাঠ সম্পন্ন করলেন। এবং, যৌবনে পদার্পণ করলেন।
শ্রীকুর্মপতাকা তখন বিদ্যাভ্যাসের বিখ্যাত একটি কেন্দ্র। শিক্ষা শেষ করে জয়দেব এখানেই শিক্ষকতা শুরু করলেন।
জয়দেব জগন্নাথের নিষ্ঠ ভক্ত। তাই শিক্ষকতার অবসরে নিয়মিত পুরীর মন্দিরে গিয়ে জগন্নাথকে গান শোনাতে শুরু করলেন এবং দেবপ্রিয় ভক্তিমূলক কাব্য রচনায় মন দিলেন।
কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, সেই সময় দেবশর্মা নামে এক ব্রাহ্মণও ওই কেন্দুলি সসান গ্রামেই বাস করছিলেন। তিনিও জগন্নাথের দারুণ ভক্ত।
বেশ কিছুকাল আগের কথা, বিয়ের পর অনেকদিন কেটে গেলেও যখন দেবশর্মার কোন ছেলেপুলে হচ্ছিল না; তখন তিনি জগন্নাথের চরণে একদিন মানত করলেন। ইচ্ছে রাখলেন, প্রভুর কৃপায় পিতা হলে, প্রথম সন্তানটিকে তিনি প্রভুর চরণেই উৎসর্গ করবেন।
কালক্রমে তাঁর স্ত্রী সন্তানবতী হলেন। এবং, একদিন একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। কন্যার নাম দেওয়া হল, পদ্মাবতী।
ধীরে ধীরে পদ্মাবতী শিশু থেকে বালিকা হলেন। তখন কথা রাখতে দেবশর্মা তাঁকে জগন্নাথের চরণে দান করলেন।
পদ্মাবতী জগন্নাথ-মন্দিরে আশ্রয় পেলেন। সেবাদাসীরা তাঁকে নিয়মিত নৃত্যগীতের শিক্ষা দিয়ে দেবদাসীর কৃত্য শেখাতে লাগলেন।
বেশ কিছুকাল কেটে গেল।
তারপর একদিন একদিকে জগন্নাথকে দর্শন করে গান শোনাতে যুবক জয়দেব যেমন মন্দিরে আনাগোনা শুরু করলেন; অন্যদিকে তেমনি কিশোরী পদ্মাবতীও শিক্ষা শেষে দেবসেবায় নিযুক্ত হলেন। পদ্মাবতীর নৃত্যে এবং জয়দেবের গানে যে আত্মনিবেদন, তাতে জগন্নাথ ভারি তুষ্ট হলেন। তাঁর ভীষণ ইচ্ছে হল, এই দুই নিবেদিতপ্রাণ ভক্তকে দাম্পত্যে মিলিয়ে দিতে।
জগন্নাথ স্বপ্নে দেবশর্মাকে জানালেন তাঁর ইচ্ছের কথা।ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপর কথা চলে না। সুতরাং, জয়দেব-পদ্মাবতী, অচিরেই দু'জনের বিয়ে হয়ে গেল।
দাম্পত্যের স্বাদ নিয়ে, প্রেমজীবনের স্বাদ নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার প্রেমজীবনের গাথা লিখতে সাধ হল জয়দেবের। শুরু করলেন লিখতে।
প্রতিদিন যতটুকু অংশ লেখা হতে লাগল, ততটুকু অংশের শ্লোকমালা মন্দিরে এসে জয়দেব শোনাতে লাগলেন জগন্নাথকে। তাঁর সামনে সুরকে দেহবিভঙ্গে মূর্ত করে তুললেন পদ্মাবতী। চলল অসাধারণ যুগলবন্দী। দিনের পর দিন এভাবেই এগিয়ে চলল গীতিকাব্যরচনার ধারা।
একদিন তারই মাঝে ঘটে গেল একটি ঘটনা...
লেখার মাঝে থমকে গেলেন জয়দেব। কাব্য অমোঘ শব্দ খোঁজে, সেই শব্দমালাই তখন কিছুতে ধরা দিল না তাঁকে।
আসলে, মানময়ী রাধার মানভঞ্জন করবেন কৃষ্ণ। সবটুকু দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করবেন রাধার কাছে; কিন্তু, কীভাবে সেটা করবেন, সেই সকাল থেকে লিখতে বসে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না জয়দেব। নিছক বেলা বাড়ছিল, মধ্যাহ্ন ভোজনের কাল অতিক্রান্ত হচ্ছিল; তাই হাল ছেড়ে একসময় তিনি নদীতে স্নান করতে গেলেন।
অন্যদিনের চেয়ে অত্যন্ত অল্প সময়েই স্নান সেরে ফিরলেন জয়দেব। ভেজা কাপড় ছেড়েই বসে পড়লেন কাব্যের হাল-ছাড়া অংশটি লিখে ফেলতে; সৃষ্টির আবেশ যেন তাঁকে অনন্য তাগিদে টেনে এনে বসাল লেখার আসনে। অধরা ভাবনা শব্দমালার সুতোয় যেন এবার ধরা দিয়েছে। এমন আবেশে অল্পক্ষণেই লেখাটি সম্পন্ন করে যেন শান্তি পেলেন জয়দেব। এতক্ষণে যেন অনুভব করলেন জঠরের জ্বালা; পদ্মাবতীকে বললেন ভাত বাড়তে।
পদ্মাবতী দাওয়ায় আসন পাতলেন। পরম যত্নে ভাত বেড়ে দিলেন। জয়দেব তখন আয়েশ করে বসে খেতে শুরু করলেন। পদ্মাবতী সেই সময়টুকু তালপাতার পাখা বাতাস করলেন, পদ-ব্যঞ্জন এগিয়ে দিলেন। জয়দেব তৃপ্ত হলেন। তারপর মুখশুদ্ধি মুখে নিয়ে জয়দেব দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের জন্য গেলেন শয্যাগৃহে।
তখন এঁটো পাতটিতে ভাত বেড়ে খেতে বসলেন পদ্মাবতী। সবে একগ্রাস অন্ন মুখে তুলেছেন, অমনি জয়দেবকে দেখলেন উঠোনে। স্নান সেরে সবে ফিরছেন! দেখে, পদ্মাবতীর মুখের গ্রাস মুখেই রইল, একেবারে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন! এ কী করে সম্ভব!
জয়দেবও তাঁর আগে পদ্মাবতীকে খেতে বসতে দেখে অবাক! তাঁর বেশ রাগ হল। উষ্মা নিয়ে বললেন, এ কী পদ্মা, এ কী অনাচার! আমায় অভুক্ত রেখে নিজে আহার করছ!...
জয়দেব হয়তো আরও কটুকথা বলতেন, কিন্তু পদ্মাবতী গলায় আটকে থাকা খাবারটুকু অতিকষ্টে গিলে হতভম্বের মতো বললেন, আমিই বা এ কী দেখছি স্বামী! আপনি তো খানিক আগেই স্নান সেরে এলেন, কাব্য লিখলেন, খেলেন, শয্যাঘরে গেলেন; তাহলে এখন আপনি আবার...
পদ্মাবতীর মুখ দেখে জয়দেব স্পষ্ট বুঝলেন কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। তিনি প্রায় ছুটে গেলেন শয্যাঘরে, না, কেউ নেই। ছুটে এলেন পুঁথি-লেখার আসনে, অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, তিনি যেখানে আটকে গিয়েছিলেন, সেখানে উজ্জ্বল আখরে লেখা:
" স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং দেহি পদপল্লবমুদারম।'
এর অর্থ, মান ভাঙাতে প্রিয় রাধার পদপল্লব মাথায় ধারণ করতে চাইছেন কৃষ্ণ!
প্রিয়কে মাথায় করে রাখা, নিজের চেয়েও তাঁকে মহৎ করা, প্রেমকে পূজার মর্যাদা দেওয়া--এর চেয়ে বড় সমর্পণ আর কীসে হয়! এমন অহংত্যাগী সমর্পণই তো চাইছিলেন জয়দেব।
চাইলেও, জয়দেব অত্যন্ত দ্বিধায় ছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে রাধার চরণ ধারণ করাবেন কি না, তাই নিয়ে। দ্বিধা ছিল বলেই সুললিত শব্দের আদলে ভাবনা ধরা দিচ্ছিল না। স্বয়ং প্রভু জগন্নাথ জয়দেবের রূপ ধরে সেই দ্বিধা দূর করে গেলেন, কাব্যের পংক্তিপূরণ করে গেলেন, প্রিয় পদ্মাবতী ও জয়দেবকে কৃপা করে গেলেন। তাঁর লীলা অনুধাবন করে জয়দেবের চোখেও জল এসে গেল। তিনি গদগদ হয়ে ইষ্টের উদ্দেশ্যে পরম ভক্তিতে বার বার প্রণিপাত করতে লাগলেন...
তারপর একদিন গীতিকাব্যটি সমাপ্ত হল। জয়দেব সেই গীতিকাব্যের নাম দিলেন, 'গীতগোবিন্দ'।
মন্দিরে রত্নবেদিতে বসে জয়দেবের মুখে নিত্যই 'গীতগোবিন্দ'র গীত শোনেন জগন্নাথ। আর শোনেন, মন্দিরের সেবকের দল, ভক্তের দল। শুনতে শুনতে রাধা-গোবিন্দের এই গান সকলের প্রিয় হল, সকলের ঠোঁটে উঠল।
ব্যাপারটা কিন্তু মহারাজা গজপতির একেবারেই পছন্দ হল না। জয়দেবের লেখা গান মন্দিরের প্রধান দেবগান হয়ে উঠবে, এটা হতে দিতে তাঁর মন চাইল না। তিনি ওই একই বিষয়ে একটি গান লিখে সুর দিয়ে আদেশ দিলেন সেই গানই কেবল মন্দিরে গাইতে হবে। জয়দেবের লেখা গান কোনভাবেই মন্দিরে গাওয়া যাবে না।
আর-সকলে সেই আদেশ মানলেও জয়দেব মানলেন না। তিনি 'গীতগোবিন্দ'-ই শোনাতে লাগলেন জগন্নাথকে।
কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি দারুণ রেগে তক্ষুনি জয়দেবকে তলব করে অত্যন্ত কঠিন কণ্ঠে রাজাদেশ অমান্য করার কারণ জানতে চাইলেন। জয়দেব শুধু শান্ত গলায় বললেন, প্রভু জগন্নাথ 'গীতগোবিন্দ'-র গানই যে শুনতে চান, মহারাজ!
কথাটা রাজার অহং-এ আঘাত করল। অসম্ভব রাগ হল। কণ্ঠে তার প্রকাশ ঘটল। বললেন, প্রমাণ?
জয়দেব তেমনই শান্তভাবে বললেন, প্রভু জগন্নাথ নিশ্চয়ই দেবেন। তবে তার জন্য মন্দিরে আসতে হবে মহারাজ।
রাগের মাথায় জেদের বশে মহারাজও এর শেষ দেখতে চাইলেন। তাই জয়দেবের সঙ্গে তিনিও মন্দিরে এলেন।
তখন মহারাজের লেখা গান ও জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' জগন্নাথের সম্মুখে পাশাপাশি রেখে গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। খানিক পরে দরজা খুলতেই দেখা গেল, অবাক কাণ্ড--মহারাজের লেখার ওপরে রাখা রয়েছে জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'!
এভাবে ওপরে রেখে জগন্নাথ যেন বুঝিয়ে দিলেন, জয়দেবের গীতই তাঁর প্রিয়, তাকেই তিনি সবার ওপরে স্থান দেন।
সুতরাং, যে গীতিকাব্যের পদ স্বয়ং জগন্নাথ রচনা করছেন, যে গীতিকাব্যকে তিনি সবার আগে স্থান দিয়ে অত্যন্ত প্রিয় বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন; সেই গীতিকাব্যের গান মন্দিরে গীত হবে, গীত হওয়ার ঐতিহ্য বজায় থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার সূত্র ধরে তাই আজও 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের পদ গেয়ে শোনানো হয় জগন্নাথকে।
'গীতগোবিন্দ' জগন্নাথসূত্রে যেমন মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোত জুড়ে গেছে, তেমনি এই গীতিকাব্যের রচয়িতা হিসেবে তো বটেই, জগন্নাথের প্রিয় ও অনুগৃহিত ভক্ত হিসেবেও মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছেন কবি জয়দেব।
অর্ধেক প্রশ্নের উত্তর তাহলে পাওয়া গেল; বাকি অর্ধেক আগামি পর্বে। সেদিন শোনাব, বরলাগি পট্টের 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া' নামে জগন্নাথের প্রিয় পরিধেয় হয়ে ওঠার কাহিনি। আজ এই পর্যন্তই...