জগন্নাথের হেঁশেলে সেই কোন্ সকালে পুজোর মধ্য দিয়ে যে উনুন জ্বলেছে, রাত্তির এক প্রহরের আগে তা আর নিভবে না। সূর্যদেব অস্তাচলের পথে হাঁটতে হাঁটতে সবে মাথার উপরটিতে এসে দু'দণ্ড জিরোবার জন্য স্থির হয়েছেন। কিন্তু, হেঁশেলের পৈতেধারী বামুনঠাকুরদের (উৎকলের ভাষায় এঁদের বলা হয়, 'সুয়ারা') এই মুহূর্তে সে ফুরসৎটুকুও একেবারেই নেই।
কারণ, ওদিকে গর্ভগৃহে রত্নসিংহাসনের নীচে জগন্নাথদের দ্বিপ্রাহরিক আহারের জোরদার তোড়জোড় চলছে। তাই এদিকে ভাত, ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন, পিষ্টক প্রভৃতির রকমফের আয়োজন অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে হেঁশেলে বাড়তে শুরু করে দিয়েছেন বামুনঠাকুরেরা। কাজটি সমাধা করেও কিন্তু তাঁরা বিশ্রাম পাবেন না। কারণ, এরপরই জগন্নাথদের সান্ধ্য-আহারের আয়োজনে ব্যস্ত হতে হবে তাঁদের।
মধ্যাহ্নে যে ভোগ নিবেদন করা হয়, তাকে বলা হয়, 'মধ্যাহ্ন ধুপ'। ইতিমধ্যে হেঁশেল থেকে ভোগ নিয়ে এসে তিন ভাইবোনকে নিবেদন করা হল। ষোড়শ উপচারে পুজো ও প্রদীপ আরতির মধ্য দিয়ে তা মহাপ্রসাদ হল।
মধ্যাহ্নভোজ সমাধা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই 'মৈলম' অর্থাৎ বেশ পরিবর্তনের পালা। তার জন্য হাজির হলেন পুষ্পালক শৃঙ্গারীরা। তাঁরা যথাবিহিত বস্ত্র, পুষ্পমালা ও অলঙ্কারসমূহ পরিবর্তন করে দিলেন।
প্রয়োজন বুঝে মধ্যাহ্নভোজনের পর জগন্নাথদের মাঝে মাঝে বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয়। সব দিন নয়। যেদিন সেই বিশ্রামের বালাই থাকে না, সেদিন এই মৈলমের পরপরই সন্ধ্যারতি করে ফেলা হয়। সন্ধ্যের জন্য অপেক্ষা করা হয় না।
তবে 'সন্ধ্যা ধুপ' বা সন্ধ্যের আহার কিন্তু সন্ধ্যেতেই নিবেদন করা হয়। বেলা থাকতে সন্ধ্যারতি হোক বা সন্ধ্যেতেই সন্ধ্যারতি হোক-এ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় না।
সান্ধ্য-আহারের জন্য শীতল খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। শরীর ঠাণ্ডা থাকলে রাত্রে বিশ্রাম ও নিদ্রা দুই-ই ভালো হয়। তাই সে-কথা মাথায় রেখেই সান্ধ্য আহারের খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে প্রধান খাবার হিসেবে রয়েছে সুবাস পাখাল অর্থাৎ জলে ভেজা ভাত। আর পিঠেপুলির মধ্যে রয়েছে মহাপুলি, ঠেকুয়া, ভোগপিঠা, কাখরা, চাদেইনিদা এবং 'আমালু' নামের মালপোয়া।
আহার নিবেদন করে শুরু হয় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার পুজো। এই পুজোয় দু'রকমের আরতি করা হয়। কর্পূর আরতি ও জয়মঙ্গল আরতি।
যাই হোক, আহারে যেমন পেট ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা ছিল, বাহারেও সেই ব্যবস্থাপনার সূচনা এখন আমরা দেখতে পাব। তাই এবার মৈলমের আগে একটি নতুন অনুষ্ঠান আমরা দেখব, যার নাম, 'চন্দনলাগি'।
'চন্দনলাগি' অনুষ্ঠানে পুষ্পালক শৃঙ্গারীরা প্রথমে চন্দন বাটা, কর্পূর, কস্তুরী এবং কেশর ইত্যাদি শীতল-সুগন্ধী একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নেন। তারপর তিন ভাইবোনের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে দেন।
মাখানো শেষ হবার পর তিন দেব-দেবীকে নতুন বস্ত্র, পুষ্পালঙ্কার ও মালা পরিয়ে দিতে প্রস্তুত হন পুষ্পালকদের দল। এই কাজে তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সুয়ারবাদু, ঘটুয়ারি, মুদুলি, পালিয়া মেকপ, গরাবাদু, হাড়াপ নায়েক, পালিয়া খুন্তিয়া ও পালিয়া পাধিয়ারি প্রভৃতি শ্রেণির শৃঙ্গার-সেবকেরা।
এবার যে বেশভূষাটি রচিত হবে, এটি মোটেই সাধারণ বেশভূষা নয়। দিনান্তে এটিই জগন্নাথদের শেষ বেশ। এক অর্থে এটি জগন্নাথের অভিসার-বেশ, অন্য অর্থে নিদ্রা-বেশ।
প্রচলিত বিশ্বাসে, রাতের অন্ধকার প্রগাঢ় হলে রাধা ও গোপিনীরা জগন্নাথরূপী কৃষ্ণের সমীপে অভিসারে আসেন। তাই 'বড়শৃঙ্গার বেশ'-এ সজ্জিত হয়ে গায়ে সুগন্ধী মেখে জগন্নাথ তাঁদের আগমনের আশায় অপেক্ষা করেন। এদিক থেকে এই 'বেশ' মহান বা 'বড়'। 'শৃঙ্গার' শব্দটি এখানে নিছক 'সজ্জা' নয়, 'প্রেমের' অর্থবাহী।
প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, এই বেশে তিন দেব-দেবীকে সাজিয়ে পুজো করে তাঁদের শোবার ব্যবস্থা করা হয়। রত্নবেদীর সামনে খাট-বিছানা পেতে দেওয়া হয়। ঘুম পাড়ানোর আয়োজন করা হয়। তাই 'বড়শৃঙ্গার বেশ' এদিক থেকে নিদ্রা-বেশ।
কিন্তু, যে পরিমাণ জাঁকজমক এই পর্বের বেশবাসে আমরা দেখতে পাই, তা নিদ্রার জন্য মোটেই সুখকর নয়। যথেষ্টই জবরজং বলা যায়। তাই, দাদা ও বোনের কাছে নিদ্রার ছলনায় এটা জগন্নাথের রাত্রিব্যাপী রাধাসঙ্গে রভসযাপনের আয়োজন নয়তো? হতেই পারে।
যাই হোক, বড়শৃঙ্গার বেশের শুরুতেই তুলসী পাতা বাটার সঙ্গে কর্পূর মিশিয়ে জগন্নাথের নাভিতে লেপন করা হয়। এতে শরীর ঠাণ্ডা থাকে। এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয়, 'নখ তুলসী' অনুষ্ঠান।
তিন ভাইবোনের মাথায় এরপর 'শ্রী কাপড়'-এর ফেট্টি বেঁধে দিয়ে শুরু হয় বস্ত্রসজ্জার কাজ। পরানো হয়, 'বরলাগি পট্ট' বস্ত্র। একে 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া'ও বলে।এমন নামের কারণ, এই কাপড়ের গায়ে ওড়িয়া হরফে কবি জয়দেবের লেখা 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের শ্লোক ছাপা থাকে।
কাপড়টি সিল্কের তৈরি। লম্বায় বারো হাত। মূল রঙ, লাল। কাপড়টি ভাঁজ করে পরানো হয় তিন ভাইবোনকেই।
বস্ত্রসজ্জা শেষ হলে শুরু হয় ফুলসজ্জা। এই পর্বে আট রকমের ফুলের অলঙ্কার দিয়ে তিনজনকেই সাজানো হয়। এই অলঙ্কারগুলি হল:
এক, চন্দ্রিকা ও অলকাপন্তি: এই অলঙ্কার কপাল সুসজ্জিত করে ঢাকার জন্য ব্যবহৃত হয়।
দুই, পুস্পতিলক: মাথার চারপাশ সুসজ্জিত করার জন্য এই অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়।
তিন, করপল্লব: রাম তুলসী ও বিবিধ সুগন্ধী ফুল দিয়ে এই অলঙ্কার তৈরি হয়। প্রতীকী হাতের পাঁচটি আঙুল সুসজ্জিত করতে ব্যবহৃত হয়।
চার, মকরকুণ্ডল: মকর মাছের মুখের আকৃতিতে তৈরি করা হয় এই অলঙ্কার। কানের দুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পাঁচ, হৃৎপদক: বুকের বাঁদিকে যেখানে হৃদয় অবস্থিত থাকে, সেইখানটি সুসজ্জিত করতে পদ্মের আকার বা পানপাতার মতো দেখতে এই অলঙ্কারটি ব্যবহৃত হয়।
ছয়, গুণ, ঝুম্পা, নাকুয়াসি, নাকছানা : নাকের সজ্জার জন্য বানানো হয় ফুলের তৈরি বিভিন্ন নকশা ও আকারের নথ।
সাত, পুষ্পমালা: অনেক রকমের পুষ্পমালা গাঁথা হয় জগন্নাথদের পরানোর জন্য। তার মধ্যে প্রতীকী বাহুতে যে-মালা পরানো হয়, তাকে বলে, 'অধরমালা'। আর, গলা থেকে প্রতীকী পা পর্যন্ত লম্বিত মালাকে বলা হয়, 'চৌসরমালা'।
আট, তুলসী মালা : বাঁশের সুন্দর ধাঁচায় তুলসীর মালা জড়িয়ে অপূর্ব মুকুট তৈরি করে জগন্নাথকে পরানো হয়।
সব শেষে এই সমস্ত পুষ্প-অলঙ্কারের ওপর গুঁড়ো গুঁড়ো কর্পূর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ সজ্জাটিকে বড় পবিত্র বলে মনে করা হয়। আহারেও তা অপবিত্র হয় না। এই সজ্জায় সজ্জিত জগন্নাথের দর্শন খুবই মঙ্গলকারী বলে মনে করা হয়।
সজ্জা সম্পন্ন হলে আসে শেষ ভোগ নিবেদনের পালা। এই ভোগের নাম, 'বড়শৃঙ্গার ধুপ'। এতে থাকে জল ভেজা ভাত, কাদালি বড়া, ক্ষীর ইত্যাদি। পঞ্চ উপচার দিয়ে পুজো করে এই ভোগ নিবেদন করা হয় রত্নসিংহাসনের নীচে।
এবার শেষ অনুষ্ঠান 'খাট সেজুলাগি'। অর্থাৎ, শয়নের ব্যবস্থাপনা। তারপরই 'পহুড়া' অর্থাৎ বিশ্রাম।
মধ্যযামে তিন দেব-দেবীর জন্য খাট-বিছানা পাতা হয় গর্ভগৃহে। তাঁদের ঘুম পাড়ানোর জন্য একজন ঠাকুরও রয়েছেন। তিনি, 'শয়ন ঠাকুর'। সারাদিন তিনি ভাণ্ডার ঘরে থাকেন। এ-সময় তাঁকে সেখান থেকে গর্ভগৃহে আনা হয়। আনার পথে জয়া-বিজয়া দ্বারের কাছে ডাব ও পান দিয়ে তাঁর যথানিয়ম সৎকার করা হয়। তারপর গর্ভগৃহে তাঁকে স্থাপন করা হয় রত্নবেদীর নীচে।
শুরু হয় শেষ আরতি। সকালে জগন্নাথদের সুন্দরভাবে নিদ্রাভঙ্গের জন্য যেমন কীর্তন গান ও মন্ত্রপাঠের সুব্যবস্থা রয়েছে; তেমনি রাত্রে এই সময় তাঁদের চোখে সুনিদ্রার আবেশ আনতে (মতান্তরে, অভিসারের আবহ তৈরি করতে) কীর্তন ও ভজন পরিবেশিত হয়।
কীর্তন শেষে তিন দেব-দেবীকে প্রতীকী শয়ন করিয়ে গর্ভগৃহের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। তখন তালিচা মহাপাত্র তাঁর সঙ্গী সেবকদের নিয়ে কালাহাট, জয়া-বিজয়া, বেহেরানা প্রভৃতি দ্বার ভালো করে বন্ধ করে দেন। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তারপরই শুরু হয় দেবতা ও সেবকদের প্রকৃত 'পহুড়া' অর্থাৎ বিশ্রামের সময়।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, দিনের পর দিন জগন্নাথদের এই যে এতবার বস্ত্র পরিবর্তন করানো হয়, সেই সব বস্ত্রের কী গতি হয়?
আমরা জেনেছি যে, এক বস্ত্র জগন্নাথেরা দু'বার পরেন না। তাতে বিপুল পরিমাণ নব্য বস্ত্রের জোগান যেমন থাকে, তেমনি সমপরিমাণে ত্যাজ্য-বস্ত্রও জমতে থাকে। কেননা, দেবতাদের ব্যবহৃত বস্ত্র মানুষের ব্যবহারে দানও করা যায় না। ফলে, ভাণ্ডার ঘরে সেই সব পাল্টে ফেলা বস্ত্র ক্রমাগত জমা রাখা হতে থাকে। জমা হতে হতে ভাণ্ডার উপচে পড়লে শুভ দিন দেখে একসময় সেগুলো মন্দিরের কৈলি বৈকুণ্ঠ প্রাঙ্গনে এনে সমাধি দিয়ে দেওয়া হয়।
জগন্নাথদের সাধারণ বেশভূষার ইতিহাস এখানেই শেষ হল। এবার আমরা শোনাব বিশেষ বেশভূষার গল্প। তার আগে শোনাব জগন্নাথদের জন্য নির্মিত এই যে বিশেষ বস্ত্র 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া', তার ইতিহাস। তাতে 'গীতগোবিন্দ' শ্লোক কেন মুদ্রিত থাকে, তার ইতিহাস। জগন্নাথের সঙ্গে জয়দেবের যোগাযোগের ইতিহাস। 'বড়শৃঙ্গার বেশ' ছাড়াও 'গীতগোবিন্দ খান্ডুয়া' বস্ত্র, আর কোন্ কোন্ অনুষ্ঠানে অপরিহার্য-সেই গল্পও শোনাব; তবে, আগামি পর্বে। আজ এই পর্যন্তই রইল...