বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: নবম পর্ব

অক্ষয় তৃতীয়া। এ-দিন সকাল থেকেই 'শ্রী নহর' অর্থাৎ পুরীর রাজবাড়ির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে মহা ধুম। ঐতিহ্যবাহী ছুতোর পরিবারটি এবং শ'দুয়েক ছুতোর হাজির হয়েছে তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে; হাজির রয়েছে দর্জি, কামার থেকে শুরু করে রথ তৈরিতে যাদের যাদের লাগে, তাদের সবাই। কিন্তু কেন? 


কেননা, এ-দিনই জগন্নাথের রথযাত্রার রথ তৈরি শুরু হবে যে। তার জন্য প্রস্তুতি অবশ্য অনেক আগে থেকেই চলছে। সেই সরস্বতী পুজোর দিন প্রয়োজনীয় কাঠ এসেছে, রাম নবমীতে কাঠকলে তা চেরাই হয়েছে। 


তবে, ছুতোরের দল কাজ শুরু করবে আজ থেকেই। কারণ, অক্ষয় তৃতীয়া শাস্ত্রীয় শুভদিন; শাস্ত্র মতে আজই যা-কিছু গঠনমূলক, যা-কিছু বৃত্তিমূলক, যা-কিছু সদুদ্দেশ্যমূলক, যা-কিছু সৃজনমূলক-সমস্তই শুরু করার জন্য সবচেয়ে শুভদিন।


শ্রীমন্দিরের পুরোহিতদের একটি দল সকাল থেকেই সেই সদুদ্দেশ্যমূলক সৃজনের শুভারম্ভ করতে পড়ে রয়েছেন এই রাজগৃহ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণেই মঙ্গল-কামনায় যজ্ঞ করেছেন তাঁরা, পূজাপাঠ করছেন। আর অপেক্ষা করছেন নির্মাণকর্মে আজ্ঞাদায়ী ঈশ্বরের আগমনের। যতই যাই হোক-না-কেন, তাঁর আজ্ঞা না-পেলে কাজ শুরুই হবে না।


অল্প পরেই অপেক্ষার অন্তধ্বনি শোনা গেল সম্মুখের বড় রাস্তায়, প্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বারে। কানে এল, 'দেখ গো রাধামাধব চলি' গান। 

LordJagannath3

প্রবেশদ্বারে এসে থামল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। যার অগ্রভাগে ঈশ্বরের সুদৃশ্য পালকি। পালকির নাম, 'মনিবিমান'। তাতে বিরাজমান, শ্রীদেবী-ভূদেবী দুই সহচরীর মধ্যমণি, মদনমোহন। জগন্নাথের প্রতিনিধি-মূর্তি।


মদনমোহনের পালকির ঠিক পিছনেই সমসজ্জিত পালকিতে বলরামের উৎসব-মূর্তি, রামকৃষ্ণ। তারপর পর পর পাঁচ-পাঁচটি পালকিতে শ্রীমন্দির প্রাঙ্গনের 'পঞ্চপাণ্ডব' শিবের পাঁচটি উৎসব অর্থাৎ প্রতিনিধি মূর্তি। 


সদলে এঁরা সচন্দন মদনমোহনের সঙ্গী হয়ে চলেছেন চন্দনযাত্রায়; আগামি একুশ দিন ধরে নরেন্দ্র সরোবরের জলে নৌকোবিহার করে গ্রীষ্মকালীন আনন্দযাপন করবেন বলে। 


আর সেই আনন্দ-গন্তব্যের পথ ধরে ঈশ্বর প্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বারে আসতেই পড়ল সানুনয় বাধা। বাধা দিলেন দ্বারের বাইরে দণ্ডায়মাণ পুরোহিতের একটি সংঘ।তাতে অবশ্য ঈশ্বর একেবারেই অসন্তুষ্ট হলেন না। বরং, সানন্দিত হলেন, প্রসন্ন হলেন। হবেন না-ই বা কেন, এ-যে তাঁর 'যাত্রা' লীলারই একটি বিশিষ্ট অঙ্গ।


লীলাময়ের 'লীলা' সম্পূর্ণ করতেই পুরোহিতেরা সমন্ত্র সাড়ম্বর আপ্যায়নে পুরোভাগে মদনমোহনকে রেখে সমগ্র দেবগোষ্ঠীকে নিয়ে গেলেন অন্দরে।


অন্দরে তিনখানা বৃহৎ (বারো ফুট লম্বা) কাষ্ঠখন্ড রাখা। অচিরেই জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলভদ্রের জন্য যে আলাদা আলাদা তিনটি রথ নির্মিত হবে, তাতে এগুলো ব্যবহৃত হবে। 


ওই তিনটি কাষ্ঠখন্ডের সম্মুখে পূজার মধ্য দিয়ে দেবতাদের আনা হল। তারপর জগন্নাথ-প্রতিভূ মদনমোহনের কাছে ওই কাষ্ঠ দিয়ে রথনির্মাণের অনুমতি চাইলেন পুরোহিতেরা।

LordJagannath2

পুরোহিতদের ইচ্ছেয় তিনজন পূজাপাণ্ডা এ-মুহূর্তে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হলেন। অল্পক্ষণে তাঁদের মাধ্যমেই মিলল ঈশ্বরের অনুমতি। ঈশ্বরের পুষ্পমাল্যে শুদ্ধ হল কাষ্ঠমালা, অনুগৃহীত হল।


তখন আজ্ঞাদাতা ঈশ্বরকে প্রণাম করে ছুতোরেরা সেই কাষ্ঠে প্রথম তাঁদের যন্ত্র ছোঁয়াল। শুরু হল কাজ। 


এভাবেই আজ্ঞা দিয়ে কাজ শুরু করিয়ে তবে মদনমোহন সদলে প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে ফের নামলেন পথে। সঙ্গে রইল সংকীর্তন-স্তব আর স্তুতিমুখর শোভাযাত্রা।


শোভাযাত্রা একসময় নরেন্দ্র সরোবরে পৌঁছল। যখন পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে আকাশে বিকেলের রঙ লাগতে শুরু করেছে। 


সরোবরে সকলই প্রস্তুত। ঘাটে ফুলমালায় সুসজ্জিত, সুদৃশ্য ও সুবৃহৎ নবনির্মিত দুটি নৌকো বাঁধা আছে। দুটির দুই নাম, 'নন্দা' ও 'ভদ্রা'। তাতে রয়েছেন অপেক্ষমান সেবকের দল।


মহাসমারোহে পালকি থেকে নেমে প্রথম নৌকোটিতে প্রথমে এসে বসলেন মদনমোহন। শ্রীদেবী-ভূদেবী তাঁর সঙ্গ নিলেন। তারপর দ্বিতীয় নৌকোটিতে এসে উঠলেন রামকৃষ্ণ। পঞ্চপাণ্ডব হলেন তাঁর সঙ্গী।


সামনে মদনমোহনের নৌকো, তার পিছনে রামকৃষ্ণের-এভাবেই নৌকো দুটি এবার সমগ্র সরোবর একবার পরিক্রমা করবে। ধীর লয়ে জলের গায়ে দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ উঠবে। সেই ক্রমাগত শব্দে রোমাঞ্চিত হবে শরীর। জল-সংলগ্ন শীতল বাতাস নৌকোর বেগে গতিমান হবে। আর তার সুললিত সংস্পর্শে ঈশ্বরের নিদাঘতপ্ত দারুশরীর সুশীতল হবে। দু'পাশে প্রেমময়ী দুই দেবী, মধ্যে মদনমোহনের সুখনিবাস। সম্মুখে সুশ্রাব্য গীত, সঙ্গে কমনীয় নৃত্য। তৎসহ সেবকের চামর সেবা, তাম্বুল সেবা, পুষ্পমাল্য সেবায় সুখকর হবে প্রমোদযাত্রা।

Jagannathpuri2

যাত্রা শুরু হল প্রশস্ত সময়ে।


সরোবরের ঠিক মধ্যিখানে ক্ষুদ্র দ্বীপ। তাতে সুগঠিত ছোট্ট একটি মন্দির। বিশ্রাম মন্দির। পরিক্রমা শেষে নৌকো বাঁধা হল মন্দিরের ঘাটে। ধীরে ধীরে মদালসভঙ্গিতে নেমে এলেন দেবতারা। ঠাঁই নিলেন মন্দিরে।


দেহে সুখের স্পর্শ বিদ্যমান, তথাপি মন্দিরে চন্দনকাঠের গামলায় স্নানাবগাহন করে দেবতারা শরীর আরও শীতল করবেন। আরও চন্দন মাখবেন অঙ্গে, জলে মিশ্রিত হবে শীতলতম সুগন্ধীসমূহ।


দেবঅঙ্গ চন্দনচর্চিত হল। তাঁরা অবগাহন করলেন। তখন সময় হল মৈলম অর্থাৎ বস্ত্র-পরিবর্তনের। সেবকেরা পরিয়ে দিলেন হালকা অথচ সুদৃশ্য বস্ত্র। অঙ্গে দিলেন মিষ্টগন্ধী ফুলের মালা, কোমল অলঙ্কার। এখন যেমন দেখছেন, এমনি করেই একুশ দিন ধরে নিত্য একুশ রকমের সাজপোশাকে সাজবেন জগন্নাথ-প্রতিভূ মদনমোহন, আর তাঁর লীলাসঙ্গী ও সঙ্গিনীরা।


মৈলমের পর আহার। সেও শীতল। তার সঙ্গে সকলেই গ্রহণ করবেন বিশেষ এক রকমের মিষ্টান্ন। নাম, 'মান্ডুয়া ভোগ'। আটা, চিনি ও পনির দিয়ে তৈরি।


আহার সমাধা হলে আবার বিহার। নৌকোবিহার। 


ইতিমধ্যেই নেমে এসেছে সন্ধ্যে। সন্ধ্যের এই ম্লানময়ী  স্নিগ্ধ আলোতেই নৌকোবিহারের আনন্দে মাতবেন মদনমোহনেরা। সান্ধ্যকালীন এই নৌকোবিহারটিকে বলে, 'রাত্রি ছপ'। দিনের বেলায় যে নৌকোবিহারটি হয়েছে, তার নাম ছিল, 'দিবস ছপ'।


সন্ধ্যের নৌকোবিহার শেষ হলে আর দ্বীপের মন্দিরে ফিরবেন না দেবতারা। তাঁরা এবার বড় রাস্তার ঘাটে গিয়ে উঠবেন। সেখান থেকে পালকিতে। রাত্রিযাপন করতে তাঁরা ফিরবেন শ্রীমন্দিরের নিজস্ব ঠিকানায়। যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই-মহাড়ম্বরে শোভাযাত্রা সহকারে।


এভাবেই আসা-যাওয়া ও আনন্দযাপন চলবে প্রতিদিন, একই সময়ে, টানা একুশ দিন ধরে। আর তার মধ্য দিয়েই শেষ হবে 'চন্দন যাত্রা'র প্রথম পর্ব, 'বাহার চন্দন যাত্রা'।


আগামি পর্বে 'ভিতর চন্দন যাত্রা'র বিবরণ নিয়ে আসছি। আজ এই পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...