বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: চতুর্থ পর্ব

আপনারা জানেন যে, 'কালার থেরাপি'-র নামে হালে এক শ্রেণির প্রবঞ্চক বড়লোক ক্লায়েন্ট ধরে ধরে ঠকায়। বড়লোকেরা ঠকতে ভালোবাসে। পূর্বে প্রবঞ্চনা-ব্যবসাটা জ্যোতিষীদের একচেটিয়া ছিল। রাজাকে ঠকাতে এবং ঠিকমতো ভজাতে পারলে 'রাজজ্যোতিষী' পদপ্রাপ্তি আটকায় কে! তার ওপর পদটি বংশপরম্পরায় পাকা করে নিতে পারলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা। 

জ্যোতিষী আর শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণের খপ্পরে একবার পড়লে তারাই আপনাকে আপন ট্র্যাকে চালাবে, সে আপনি রাজা হোন, গজা হোন কিংবা নিদেনপক্ষে প্রজা। চালাবেই। 

তাই, আগের পর্বেই আপনারা দেখেছেন যে, সকালে উৎকলের রাজকুমার ও রাজকুমারী হিসেবে যখন জগন্নাথদের সেবাকাজ হচ্ছিল; তখন দিনের শুভাশুভ, কর্তব্য-অকর্তব্য, খাওয়া-দাওয়ার বিধিনিষেধ সম্বন্ধে গুচ্ছের উপদেশ দিয়ে রাজজ্যোতিষী নিজের পথে জগন্নাথদের চালানোর শুভারম্ভ করে গেলেন।

JagannathOutfits1

অশনের পরেই আসে ব্যসন। ব্যসনের উল্লেখযোগ্য উপকরণ, বস্ত্র। রাজজ্যোতিষী তাতে নাক গলাবেন না, তা আবার হয় নাকি! তাই বার-অনুযায়ী জগন্নাথদের বিভিন্ন রঙের কাপড় পরানোর আয়োজন করা হল।  তৈরি করা হল রীতি, গড়ে উঠল ঐতিহ্য। দোহাই দেওয়া হল শাস্ত্রের; যে শাস্ত্রের নাম, জ্যোতিষশাস্ত্র।  

জ্যোতিষশাস্ত্র বলছে যে, ন'টি গ্রহ আমাদের অর্থাৎ কি না মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই ন'টি গ্রহ হল : রবি বা সূর্য, সোম বা চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু। তাদের মধ্যে রাহু ও কেতুকে নচ্ছারজ্ঞানে একটু দূরে দূরেই রাখা হয়। তাই বাকি সাতটি গ্রহকে সাতবারের দায়িত্ব দেওয়া হল। 

গ্রহ হলেও এঁরা দেব, এঁরা জ্যান্ত। এঁরাই এইসব বারের অধিপতি। এঁদের নামেই সাতবারের নামকরণও করা হল।

জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, রবিবারের অধিপতি রবি অর্থাৎ সূর্যের অবস্থানগত কারণে আপনার ভাগ্য সাময়িক খারাপ যেতে পারে, দিনটিও অঘামার্কা কাটতে পারে। তাতে অবশ্য মুষড়ে পড়ার খুব একটা দরকার নেই। কারণ, জ্যোতিষীর হাতে এর প্রতিকারও আছে।

পরিমাণমতো রত্ন বা পাথর ধারণ করে সূর্যের এই অবস্থানকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সূর্যের রঙ লাল, চুনি পাথরের রঙও লাল। তাই এই লাল পাথরটি সূর্যেরই প্রতিরূপ। 

আপন প্রতিরূপটি কোন মানুষকে ভক্তিতে বা ভয়ে নিষ্ঠা ভরে ধারণ করতে দেখে সূর্য খুশি হয়ে হয় কৃপা করেন; নয়তো ওই পাথরটির মধ্যে সূর্যের চেয়েও বেশি শুভ ক্ষমতা আছে, যার দ্বারা সূর্যকে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তার ফলে মানুষের মঙ্গল হয়, শুভ হয়। 'হয়' এবং 'নয়'-এর মধ্যে এরকমই কোন একটা গপ্পো থাকে।

ভেতরের গপ্পো যাই হোক না কেন, জ্যোতিষ বিশ্বাস করে যে, চুনি অর্থাৎ রুবি দিয়ে রবিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। লাল পাথর দিয়ে যখন লাল গ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে, তখন লাল বস্ত্র দিয়েই বা যাবে না কেন? সিল্কের কাপড় পাথরের মতোই মসৃণ, রত্নের মতোই উজ্জ্বল। 

তাই জ্যোতিষীরা এক কাঠি এগিয়ে ভাবলেন যে, দীর্ঘ সময়ের গ্রহের ফের আটকাতে রত্ন বা পাথর ধারণ প্রশস্ত; আর দৈনিক গ্রহের ফেরে বদল আনতে বস্ত্রই উপযুক্ত। কারণ, এক্ষেত্রে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র বদল ও বস্ত্রের রঙ বদল করলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। ফলে তাঁরা বিধান দিলেন যে, লাল সিল্কের কাপড় পরেও রবিবারে সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। 

জগন্নাথের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন রবিবারে লাল কাপড় পরতেন কি না জানা যায় না। কিন্তু, তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বর ও কল্পিত সন্তান জগন্নাথের কপালে দিনের শুভেচ্ছায় এমন কাপড় পরার বিধান জুটে গেল।

JagannathOutfits2

একইরকমভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রে সোমবারের অধিপতি চন্দ্রের রঙ কল্পনা করা হয়েছে, সাদা। তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে সাদাটে মুক্তো বা সিল্কের সাদাটে কাপড়। চাঁদের গায়ে তো কলঙ্ক আছে, সেই কলঙ্ক কাপড়ে আনতে তায় আবার যোগ হল কালো কালো ছোপ। এই ব্যাপারগুলোয় উদ্ভাবনী প্রতিভার চেয়ে জাদুর প্রভাব বেশি।

লোকসাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে 'জাদু' হল, চাঁদকে বশ করতে চাঁদের কিছু বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রতীককে বশ করার প্রক্রিয়া। যেমন : 

চাঁদ গোল ও উজ্জ্বল সাদাটে। মুক্তোও গোল এবং উজ্জ্বল সাদাটে। তাই চাঁদের সার্থক প্রতিরূপ, মুক্তো। তাকে আংটির গণ্ডিতে বেঁধে হাতে পরার মানেই তো বশ করা। 'জাদু' ভাবনায় মুক্তোকে বশ করা মানেই চাঁদকে বশ্য করা। অন্যদিকে চাঁদের ঔজ্জ্বল্য ও কলঙ্ককের প্রতিরূপ বস্ত্রের জমি এবং নকশায় আবদ্ধ করে শরীরে ধারণ করাও আসলে চাঁদকে বশ্য করার আরেকটি পথ।

জ্যোতিষ মতে, মঙ্গলবারের অধিপতি মঙ্গলের রঙ লাল বা গোলাপি। তাই লাল কোরাল ধারণ করলে তাকে বশে রাখা যায়। তবে বস্ত্রভাবনায় এখানে একটু বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। পাঁচটি রঙে রাঙানো 'পঞ্চরঙ্গা' কাপড় পরানো হয় মঙ্গলবার। অবশ্য পাঁচটি রঙ হলে হবে কী, প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে একমাত্র লাল-গোলাপিকেই।

বুধবারের অধিপতি বুধের গায়ের রঙ কল্পনা করা হয়েছে, আকাশি-নীল। তাতে আছে সবুজের আভা। সেটা মাথায় রেখেই এদিনের পরিধেয় কাপড়ের বর্ণস্থাপন করা হয়েছে। আগে বলা হয়নি, বুধের নিয়ন্ত্রক পাথর হচ্ছে, পান্না।

বৃহস্পতিবারের অধিপতি বৃহস্পতির রঙ হলুদ। জ্যোতিষ তাই এঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলুদ নীলকান্তমণি ধারণ করার বিধান দিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বৃহস্পতিবারের পরিধেয় কাপড়ের জন্য হলুদ রঙ নির্দিষ্ট হয়েছে।

শুক্রগ্রহের রঙ সাদা। বশকারী ধাতুও সাদা, হীরা। শুক্রবারের কাপড়ও তাই নির্ভেজাল সাদা।

শনির রঙ বেগুনি-নীল। নিয়ন্ত্রক পাথর বা রত্ন, নীল নীলকান্তমণি। এই পাথরের একটা জোরালো বেগুনি আভা আছে। তাই শনিবারের কাপড়ের রঙ নীলচে বেগুনি।

গ্রহের রঙ ও তার ভিত্তিতে পোশাকের রঙে কেউ বিজ্ঞান খুঁজতে যাবেন না, প্লিজ! কারণ, বৈজ্ঞানিক বিদ্যায় সূর্য গ্রহ নয়, নক্ষত্র। চন্দ্র গ্রহ নয়, উপগ্রহ। তাছাড়া পোশাক বা রত্ন দিয়ে কোন গ্রহ বা নক্ষত্রকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মানুষের উপর সরাসরি তাদের কোন প্রভাব নেই, কোনদিন ছিলও না।

দৈনন্দিন পোশাকে রঙের বৈচিত্র্যের একটাই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; তা হল, রঙের বৈচিত্র্য রুচি ও মনের একঘেয়েমি কাটাতে সাহায্য করে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দেখলে, আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটায়। তার বেশি কিছু না। 

আর্থ-সামাজিক কারণটা জগন্নাথদেব ও তাঁর ভাইবোনদের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। রাজকুমার ও রাজকুমারী হিসেবে, অবতার হিসেবে। 

এই জায়গায় এসে মনে হয়, ভক্তমানসে জগন্নাথেরা বুঝি সত্যিই ঈশ্বর নন। কেননা, ঈশ্বরের আবার ভাগ্য কী, শুভাশুভ কী, গ্রহ নিয়ন্ত্রণে তাঁর টোটকার প্রয়োজন কী? যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক ও বিধাতা তাঁকে সামান্য ক'টা গ্রহ নিয়ন্ত্রণ করবে, এও কী সম্ভব? 

সম্ভব বৈকি জ্যোতিষীর ইচ্ছেয় সবই সম্ভব। তাঁরা পণ্ডিতদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে, মন্ত্রের ছত্রে ছত্রে জগন্নাথকে 'বিশ্ববিধাতা' ও 'ভগবান' বলে গুণগান করে ঈশ্বর সাব্যস্ত করে দিলেন। কেন করলেন?

JagannathOutfits3

আসলে ঈশ্বরকে শাস্ত্রে বেঁধে বোঝাতে চাইলেন যে, ঈশ্বর যদি গ্রহের বশীভূত হন, তাকে স্ববশ করতে যদি টোটকা অবলম্বন করেন, যদি জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন, যদি জ্যোতিষীর বশ্য হন; তাহলে হে সামান্য মানব, তোমরা জ্যোতিষীর বশ্য হবে না কেন! সুতরাং, জগন্নাথের পোশাকে বার-বদলে রঙ-বদলের মূলে এই রাজনীতিটিকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না।

জেনে হোক বা না-জেনে হোক, রাজা এই রাজনীতিতে সিলমোহর দিলেন। কারণ, পুজোয় তাঁর আড়ম্বরের প্রয়োজন ছিল। নিতান্ত সাদামাঠা পুজো মন্দিরের আভিজাত্য বাড়ায় না, দর্শনার্থীদের কৌতূহল বাড়ায় না। তার জন্য বিশেষ আয়োজনের প্রয়োজন।আটবারের আহার, বার বার পোশাক পরিবর্তন, প্রতিদিনের পোশাকে রঙের পরিবর্তন, কতশত সেবায়েত, বিশাল হেঁশেলে বিরাট ভোগরান্নার আয়োজন তাঁকে সেই কাঙ্ক্ষিত সমারোহের জোগান দিল। নিজের সৃষ্টিকে, নিজের কীর্তিকে জনপ্রিয় ও চিরস্থায়ী করার জন্য এটা রাজা অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সহজ রাজনীতি।

রাজনীতির হাত ধরেই জন্ম নেয় কিংবদন্তি। তাকে জন্ম দেয় সময়, আর সময়ের ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাওয়া মন্দিরকেন্দ্রিক-দেবকেন্দ্রিক মানুষেরা; যেমনটা যুগ যুগ ধরে চেনা পাঁচটা সুবিখ্যাত তীর্থের ক্ষেত্রে হতে আমরা দেখেছি, তেমন ভাবেই সম্ভব হয়েছে আমাদের জগন্নাথের ক্ষেত্রেও...

সেই কিংবদন্তিগুলোর কথা তো আমরা বলবই। আর সেগুলো বলব জগন্নাথের বিশেষ বিশেষ বেশভূষা প্রসঙ্গে। তার আগে দুপুর থেকে রাত্রি অব্দি জগন্নাথদের দৈনন্দিন আহার ও পরার বিবরণটুকু লিপিবদ্ধ করব। কিন্তু, লেখাটা অহেতুক অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে সেটুকু আগামি পর্বের জন্য তুলে রাখতে বাধ্য হচ্ছি। সুতরাং, আজ এ-পর্যন্তই রইল...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...