ঈশ্বর আমাদের মতো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোন না। পৌরাণিক হিসেবে তাঁদের দিনরাতের সঙ্গে আমাদের দিনরাতের মিলও নেই। ঈশ্বর আমাদের মতো হা-ভাতে নন, তাঁদের খিদেতেষ্টা পায় না।
তবুও, আমরা গৃহ বা মন্দিরের দেবতাকে রাত্রে 'শয়ন' দিই, সকালে ঘুম থেকে তুলি; সকাল থেকে রাত্তির নৈবেদ্য দিয়ে পুজো করি।
আসলে, মুখে 'ভগবান' বললেও আচরণে ঈশ্বরকে আমরা মানুষের প্রতিরূপ ছাড়া আর কিছুই ভাবি না। পুরীর জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রের বেলাতেও উপরোক্ত ভাবনাটির অন্যথা হয় না।
আমরা জানি যে, জগন্নাথ উৎকলের রাজকুমার ও বিষ্ণুর মানবরূপ কৃষ্ণের রূপান্তর। কৃষ্ণ আবার স্বয়ং রাজাও। দ্বারকার অধীশ।
সুতরাং, মানুষ হলেও, জগন্নাথের নিত্যদিন যে সাদামাঠা আর পাঁচটা মানুষের মতো হবে না, এ তো বলাই বাহুল্য। তাই, সেই নিত্যদিনের নিত্য-কৃত্যের সঙ্গে তাঁর সাজপোশাকও ব্যবহারিক দিক থেকে বিভিন্ন হয়। সেই কারণেই আসুন, তদীয় বিবরণ দিবসের সূচনা অর্থাৎ কাকভোর থেকেই শুরু করি:
বৃষ্টি-বদলা-ঝঞ্ঝা-বিদ্যুৎ যাই হোক না কেন, এক্কেবারে কাকভোরে মন্দিরের ফটক খোলা নিত্যদিনের নিয়ম। এর কোন অন্যথা হয় না। সেই ফটক খোলার সময় পাঁচশ্রেণির সেবককে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হয়। এঁরা হলেন-ভিতরচা মহাপাত্র, প্রতিহারী, মুদুলি, অখণ্ড মেকপ এবং পালিয়া মেকপ।
আগের রাত্রে জগন্নাথ ও তাঁর ভাইবোনেরা শুয়ে পড়ার পর 'তালিচা মহাপাত্র' নামের একশ্রেণির সেবক অন্য সেবকদের সাক্ষী রেখে মন্দিরের দরজায় খিল-টিল লাগিয়ে ভালো করে বার বার পরীক্ষা করে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেটাই তাঁর নিত্যদিনের কাজ। কাকভোরে তৎকৃত সেই বন্ধ দরজাই খুলতে হয় ভিতরচা মহাপাত্রদের।
খুলতে হয় প্রতিহারী প্রভৃতি উপরোক্ত চারশ্রেণির সেবকের চোখের সামনে। কাজটা বেশ দায়িত্বের কাজ। দরজা বন্ধ ও খোলা--এর মধ্যিখানে কোন অঘটন ঘটে থাকলে অর্থাৎ অনুপ্রবেশ ঘটে থাকলে বা তার চিহ্ন থেকে থাকলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে; নইলে একবার দরজা খোলা হয়ে গেলে অঘটনের দায় তাঁর ওপরেও বর্তাবে। ভিতরচা মহাপাত্র তাই আগে ভালো করে আগের রাতে দেওয়া খিল-তালা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দরজা খোলেন।
মন্দিরের দরজা খোলার পর তিনি একইভাবে খোলেন গর্ভগৃহের দরজাও। এই দরজাকে উৎকল প্রাদেশিক ভাষায় বলা হয়, 'কালহাটদ্বার'। এই যে দুই দরজা খোলার অনুষ্ঠান, একে বলা হয়, 'দ্বারপিঠ' অনুষ্ঠান।
মন্দির তো খোলা হল। এবার রাজকুমারদের ও রাজকুমারীকে ঘুম থেকে তুলতে হবে। নিজে নিজে ঘুম ভাঙলে এক, ভাঙালে মেজাজ হয় আর এক। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রায়শই মেজাজ যায় খিঁচড়ে।
তাই জগন্নাথদের এই ঘুম ভাঙানোর প্রক্রিয়াটির আয়োজন করা হয় শ্রুতিমধুর ধ্বনি, মধুর মন্ত্রপাঠ ও সুগন্ধীদাহের মাধ্যমে আরতি সহযোগে। ভিতরচা মহাপাত্র এবং দু'জন পুষ্পালক মিলে রত্নসিংহাসনের নীচে দাঁড়িয়ে এই আরতি সম্পন্ন করেন। এই আরতিকে বলা হয়, 'মঙ্গল আলটি'।
মঙ্গল আরতির এই মধুর পরিবেশে অত্যন্ত প্রসন্ন মনে জগন্নাথদের ঘুম ভাঙল। ভাটেরা এককালে সুমধুর স্বরে সঙ্গীতবাদ্যসহকারে গুণগানে প্রসন্ন করে রাজরাজড়ার যেভাবে ঘুম ভাঙাতেন, এখানেও যেন তেমনি করেই জগন্নাথদের ঘুম ভাঙানো হল। তাঁরা যেন আড়মোড়া ভেঙে নিদ্রার জড়িমা কাটালেন।
মঙ্গল আরতি শেষ হতেই কাউকে কিচ্ছুটি বলতে হল না, তাঁদের সামনে হাজির হয়ে গেলেন আরও একদল সেবক। যেন, সবাই জানেন তিন ভাইবোনের কখন কী চাই। আসলে, ভৃত্যজনোচিত সেবাকাজ চিরকালই নিয়মে বাঁধা।
জগন্নাথেরা এখন বাসি কাপড় ছাড়বেন। রাতের জমকালো পোশাক ও ফুলসজ্জা খুলে ফেলে হালকা সুতির পোশাক পরবেন। এই সময় পরার জন্য দুটি করে সুতিবস্ত্র আছে। 'তদপা' ও 'উত্তরীয়'।
'তদপা' হচ্ছে কটিবস্ত্র, কোমরে জড়ানোর জন্য। আর 'উত্তরীয়' কাঁধ ও বুক ঢাকার জন্য। শৃঙ্গারীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তিন ভাইবোনকে এই কাপড় দুটি পরিয়ে দিলেন। কাপড় পরিবর্তনের এই অনুষ্ঠান, তা যে-কোন সময়ই হোক-না-কেন, তাকে বলা হয়, 'মৈলম'।
রাতে জমকালো ও ভারি পোশাক পরানো হয়েছিল বলেই সকালে হালকা কাপড় পরানো হল। এতে বেশ একটা হালকা হালকা অনুভূতি আসে শরীরে। বড্ড আরাম লাগে। আর তাছাড়া এবার তো তিন ভাইবোনকে প্রাতঃকৃত্যাদির মধ্য দিয়ে ধোপদুরস্ত ও চনমনে করে তোলার পালা। মন্দিরে যাকে বলা হয়, 'অবকাশ'।
বস্ত্র পরিবর্তন সাঙ্গ হতেই রত্নসিংহাসনের সামনে হাজির হলেন ভিতরচা, পালিয়া পুষ্পালক, সুয়ারবাদু, পানিয়াপট, মুখপাখলা, প্রতিহারী, ঘাঁটুয়ারী, ভাণ্ডার মেকপ, মহাভৈ নামের সেবকেরা। সেই সঙ্গে এলেন খুরি নায়ক অর্থাৎ রাজজ্যোতিষীও।
ঝপাঝপ তিন-তিনখানা পিতলের দর্পণ পাতা হয়ে গেল। এক-একটি দর্পণে উদ্ভাসিত হল এক-এক দেব ও দেবীর মুখ। মন্ত্র পড়ে দূর থেকেই দাঁতন দিয়ে তিনজনের প্রতীকী দাঁত মাজানো হল, জিভ ছোলানো হল। এবারও সরাসরি মূর্তিকে নয়, দর্পণে প্রতিফলিত তাঁদের বিম্বকে স্নান করানো হল। স্নানের জলের সঙ্গে দেওয়া হল কর্পূর, দই, আমলা, চন্দন ও সুগন্ধী ফুল।
রাজকুমার বা কুমারীদের হাতে খুব বেশি নষ্ট করার মতো সময় থাকে না। তাই রাজজ্যোতিষী এই স্নানের সময়টাতেই এ-দিনের বার-তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ ও নক্ষত্রের অবস্থান ইত্যাদি পঞ্জিকাসিদ্ধ ব্যাপারগুলো আউড়ে যেতে লাগল। স্নান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কথনও শেষ হল। ব্যস।
আবার 'মৈলম' অর্থাৎ কাপড় ছাড়া ও নতুন কাপড় পরার অনুষ্ঠান। কাপড় বাস্তবে ভেজেনি। কিন্তু, প্রতীকীভাবে তো ভিজেছে। তাই পরিবর্তন। এবারের 'মৈলম'-এর একটি নাম আছে, একে বলা হয় 'বেশ লাগি'।
এই পর্বেও তিনজনই সাধারণ কাপড়ই পরলেন। তবে এবার সঙ্গে রইল ফুলের নানাবিধ অলঙ্কার এবং মালা। এই সাজসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন পুষ্পালক শৃঙ্গারী, চাঙ্গেদা মেকপ, সুয়ারবাদু, অখণ্ড মেকপ ও খুঁটিয়া শ্রেণির সেবকেরা।
বেশ-বাস সম্পূর্ণ হতেই এসে গেল সকালের হালকা জলখাবার। তিনজনের জন্যই। নারকোল নাড়ু, নারকোল চূর্ণ, খোয়া, গুড় মাখানো খই, অন্যান্য ফলের সঙ্গে পাকা কলা, দই এবং ডাব। এক্কেবারে হালকা-পুলকা খাবার। এই খাবারকে বলা হয়, 'অন্নসর পিন্ডি' বা 'বল্লভ পিন্ডি'।
সকালের জলখাবার সকাল শেষ হওয়ার মুখেই হজম হয়ে যাওয়ার কথা। ওসব খই-দই-ডাবের জল কতক্ষণই বা আর পেটে থাকে; নড়েচড়ে বসতে বসতেই হজম হয়ে যায়। হলও তাই। ফলে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এসে গেল সকালের ভারি ফলার।
ফলারের মধ্যে রয়েছে কান্তি, এন্দুরি, ঝিল্লি, মাঠাপুলি, হংসকেলি, আদা পাঁচেদি, শাক-ভাজা প্রভৃতি পদ এবং পিঠের সঙ্গে পরিমাণমতো খিচুড়ি ও কণিকা। এই খাবার অর্থাৎ নিবেদিত ভোগকে বলা হয়, 'সকাল ধুপ' বা 'রাজ ভোগ'।
খাবার নিবেদন মানেই পুজো। পুজো শেষ হতেই আবার কাপড় ছাড়ার পালা। অর্থাৎ, 'মৈলম'।
জগন্নাথ ও তাঁর ভাইবোনেরা এবার সিল্কের কাপড় পরবেন। সঙ্গে পরবেন রত্ন ও ফুলের অলঙ্কার। পরাবেন শৃঙ্গারী সম্প্রদায়ের সেবকেরা।
সিল্কের কাপড় পরার ক্ষেত্রে একটা বিশিষ্ট ব্যাপার আছে। ইচ্ছে মতন রঙের কাপড় পরিয়ে দিলে হবে না। বার হিসেবে রঙের বিভিন্নতা নির্দিষ্ট করা আছে, সেই হিসেবে পরাতে হবে, একেবারেই অন্যথা করা যাবে না। বার-অনুযায়ী সেই রঙের তালিকাটি হচ্ছে এরকম :
রবিবার : লাল কাপড়।
সোমবার : ঘোলাটে সাদা কাপড়ে কালো কালো ছোপ।
মঙ্গলবার : 'পঞ্চারঙ্গি' অর্থাৎ পাঁচ রঙের কাপড়।
বুধবার : আকাশি-নীল কাপড়।
বৃহস্পতিবার : হলুদ কাপড়।
শুক্রবার : সাদা কাপড়।
শনিবার : বেগুনি কাপড়।
তালিকাটির দিকে তাকালেই অন্তত দুটি প্রশ্ন সঙ্গে সঙ্গেই জাগে। যথা, বার-অনুযায়ী রঙ নির্দিষ্ট করা হল কেন? বারের রঙগুলোই বা ঠিক হল কীভাবে?
উত্তর দিতে গেলে ব্যাখ্যা আসে। সেই ব্যাখ্যা এবং দুপুর থেকে রাত্রি অব্দি জগন্নাথদের পোশাক বৈচিত্র্যের গল্প শোনাব আগামি পর্বে। আজ এই পর্যন্তই...