পুরীর জগন্নাথদেবের বেশভূষার ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও ঐতিহ্য: দ্বিতীয় পর্ব

'জগন্নাথ' অর্থে তো 'জগতের নাথ', তাই তাঁকে শ্রেষ্ঠ বলে নির্দিষ্ট করতে, সমস্ত দেবতাদের 'কর্তা' বোঝাতে শ্রীক্ষেত্রে তাঁকে 'বড় ঠাকুর' বলে সম্বোধন করা হয়। তাঁর মন্দিরকে বলা হয়, 'বড় দেউল'। মন্দিরের প্রধান রাস্তাকে বলা হয়, 'বড় দণ্ডা' বা 'বড় রাস্তা'। তাঁর প্রসাদকে বলা হয়, 'মহাপ্রসাদ'।

জগন্নাথকে যেমন পরমেশ্বর ভাবা হয়, উৎকলের রাজকুমার ভাবা হয়, তেমনি বিষ্ণুর অন্যতম অবতার, শ্রীকৃষ্ণের রূপান্তর বলেও মনে করা হয়।

জগন্নাথ কাহিনি থেকে জানা যায় যে, শবররাজ বিশ্বাবসুর পূর্বপুরুষ হলেন 'জরা' নামের এক ব্যাধ। এই ব্যাধের তিরের আঘাতেই শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়েছিল। এই অপঘাত-মৃত্যু শ্রীকৃষ্ণের পূর্ব অবতার রামজন্মে বানররাজ বালীর পত্নী তারার অভিশাপের ফল। 

পৌরাণিক ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র শত্রুতা ছাড়াই বালীকে আড়াল থেকে তির ছুঁড়ে হত্যা করেছিলেন। বালীর পত্নী তারা এই অন্যায় সহ্য করতে পারেননি। অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই অভিশাপের ফলেই বালী পরজন্মে জরা ব্যাধ হয়ে জন্মালেন। সত্যের পুনরাবৃত্তি ঘটল। বিনা প্ররোচনায় আড়াল থেকে জরার ছোঁড়া তিরে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হল। জন্মান্তরের ঋণ শোধ হল। রক্তঋণ। 

জরা অবশ্য ইচ্ছে করে শ্রীকৃষ্ণের দিকে তির ছোঁড়েনি। গাছের ডালে বসা শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন্ত পায়ের শুধু রাঙা পাতা দুটি ঝোপের আড়াল থেকে দেখে তার হরিণ ছানা বা চঞ্চল পাখিজোড়া বলে ভ্রম হয়েছিল। তাই তিরের আঘাতে আহত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে পড়ে যেতে দেখে সে ত্রস্ত হয়ে ছুটে এসেছিল, অনুতাপ করেছিল, বার বার শ্রীকৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল।

শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন যে, জরা ও তাঁর সম্পর্ক ক্ষমা-তিতিক্ষার ঊর্ধে, জন্মান্তরের সম্পর্ক। সেখানে খেদ নয়, কর্তব্য রয়েছে, নিয়তির বিধান রয়েছে। সেই বিধান বলছে, শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর না-পোড়া নাভিমণ্ডল জরা যেন দেবতারূপে প্রতিষ্ঠা করে, 'নীলমাধব' নাম দেয়; সেই নীলমাধবের মাধ্যমেই একদিন সমস্ত জগতের মঙ্গল হবে।

Jagannathpuri1

নিয়তির নির্দেশেই জরা দ্বারকা থেকে পালিয়ে আসে নীলগিরি পর্বতে। বংশপরম্পরায় গোপনে নীলমাধবের পুজো করতে থাকে। 

তারপর একদিন ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে নীলমাধবকে ছলে-বলে-কৌশলে উদ্ধার করে এনে 'জগন্নাথ' নামে দারুমূর্তিতে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে লাগলেন। এই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ-জগন্নাথ যোগসূত্রের প্রথম গল্প।

এবার বলি এই যোগসূত্রের দ্বিতীয় গল্প: 

পৌরাণিক দ্বাপরযুগে ইন্দ্র শুধু দেবরাজই ছিলেন না, ছিলেন বৃষ্টির দেবতাও। তাই কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বৃষ্টিকামনায় বৃন্দাবনবাসীরা প্রতি বছর মহা-আড়ম্বরে ইন্দ্রের পুজো করতেন। 

স্বাভাবিকভাবেই পুজো পেতে পেতে ইন্দ্রের অহংকার খুব বেড়ে গিয়েছিল। তাই একদিন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অহং নাশ করতে মনস্থির করলেন। তিনি বৃন্দাবনবাসীদের সটান সে-বছর ইন্দ্রের পুজো করতে বারণ করে দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই খুব প্রিয়, তার উপর গোষ্ঠিপতির ছেলে; সুতরাং তাঁর কথা কেউ অমান্য করতে পারল না।

ওদিকে পুজো হচ্ছে না দেখে ইন্দ্র তো খুব রেগে গেলেন। তার ওপর শ্রীকৃষ্ণের কলকাঠিতে পুজো হচ্ছে না জেনে তো একেবারেই টং হয়ে ক্ষেপে উঠলেন। বৃন্দাবনবাসীদের উচিত শিক্ষে দিতে টানা সাত দিন ধরে বজ্র-বিদ্যুৎ-বৃষ্টির এমন বিধ্বংসী উৎপাত চালাতে শুরু করলেন, যাতে প্রান বাঁচানো দায় হয়ে ওঠে।

উৎপাত শুরু হতেই বৃন্দাবনবাসীরা তো একেবারে হাহাকার করে উঠল। তখন শ্রীকৃষ্ণ এগিয়ে এলেন ত্রাতা হয়ে। সকলকে খুব উঁচু জায়গায় নিয়ে গিয়ে গোবর্ধন পর্বতকে কড়ে আঙুলে ছাতার মতো তুলে ধরলেন। টানা সাত দিন নিজে অভুক্ত থেকে সকলকে রক্ষা করলেন, ইন্দ্রের অহং নাশ করলেন, ইন্দ্র এসে ক্ষমা চাইতে তবে গিয়ে নিরস্ত্র হলেন।

সব কিছু মিটতেই বৃন্দাবনবাসীদের হঠাৎ টনক নড়ল--এ...হে..., শ্রীকৃষ্ণ যে সাত দিন ধরে কুটোটি কাটেননি দাঁতে! আগেই আহারের আয়োজন করা উচিত ছিল... ছিঃ ছিঃ...বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে গো...

টনক নড়তেই অমনি শুরু হল তুমুল তোড়জোড়।

শ্রীকৃষ্ণ দিনে আট বার খেতেন। সেই হিসেবে সাত দিনের খাবার এক সঙ্গে অর্থাৎ আট-সাতের গুণফলে ছাপ্পান্ন রকমের ভোগ নিবেদন করলেন বৃন্দাবনবাসীরা। নিবেদন করলেন শ্রীকৃষ্ণের উপোষভঙ্গ করাতে, পরম উপকারের কৃতজ্ঞতা জানাতে। 

Jagannathpuri2

এভাবে ইষ্টকে ছাপ্পান্ন ভোগ নিবেদন করার প্রথা এখান থেকেই শুরু হল। তারপর জগন্নাথ-যুগে এসে সেই প্রথার অনুর্বর্তন ঘটল। বলা বাহুল্য, সেটা ঘটল জগন্নাথকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে নির্দিষ্ট করার কারণেই।

শুধু ভোগ নিবেদনের ক্ষেত্রেই নয়, বেশভূষা ও কৃতসজ্জায় জগন্নাথকে কিন্তু নিত্যই শ্রীকৃষ্ণ সাজানো হয়। এক্ষেত্রে পরিধান হিসেবে ব্যবহৃত হয় সুতো ও সিল্কের কাপড়। সে-সব কাপড়ের আবার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। যেমন--তদপা, উত্তরীয়, প্রহরণ, ফুটা, শ্রীকাপড়, বরলাগিপট, শ্রীমুখবালা, চাদর, গীতগোবিন্দপট।

জগন্নাথকে সাজানোর জন্য ফুল-পাতা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামের অলঙ্কার নির্মিত হয়। তাদের নাম যথাক্রমে--অধরমালা, চন্দ্রিকা, গাভা, অলকা, করপল্লভ, হৃৎ-পদক, কৌস্তুভ-পদক, গুণ, মকরকুণ্ডল, ঝুম্পা, তিলক, কুণ্ডল-তদগি, নাকুয়াসি, শ্রীপায়রা।

জগন্নাথের বেশভূষা ও অঙ্গরাগের আচারকে বলা হয়, 'শৃঙ্গার' (বা, 'বেশ')। যাঁরা এই আচার-ক্রিয়া সম্পন্ন করেন, তাঁদের বলা হয়, 'শৃঙ্গারী'। পদটির পুরো নাম, 'শৃঙ্গারী নিয়োগ'। এঁদের 'পুষ্পালক'-ও বলা হয়। এঁদের সরাসরি সাহায্যের জন্য রয়েছেন 'পালিয়া পুষ্পালক' নামের সেবক। 

শৃঙ্গারীদের পরোক্ষে সাহায্য করার জন্য রয়েছেন আরও দুই ধরণের 'নিয়োগ'-নামক সেবক। যথা-- 'খুঁটিয়া নিয়োগ' ও 'চাঙ্গেদা মেকপ নিয়োগ'।

মন্দিরে মালাকার ও ভক্তদের দেওয়া ফুল-সুগন্ধী শৃঙ্গারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হল খুঁটিয়া নিয়োগদের কাজ। আর চাঙ্গেদা মেকপ নিয়োগদের কাজ হল প্রয়োজনের সময় সঠিক পোশাক ও অলঙ্কার শৃঙ্গারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই সব সেবকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যেই গর্ভগৃহে রত্নবেদীর দুই দেবতা, এক দেবী অর্থাৎ জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রকে ফুল-পোশাক-অলঙ্কারে সাজিয়ে তোলেন শৃঙ্গারীরা।

শৃঙ্গারীরা প্রতিদিন কীভাবে সকাল থেকে রাত্তির অব্দি দফায় দফায় জগন্নাথদের সুবেশিত, সুবাসিত ও সুসজ্জিত করেন, সেই সকল অজানা ও কৌতূহলজনক গল্পগাছা নিয়ে হাজির হব আগামি পর্বে। আজ তাহলে রইল এই পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...