পুরীর জগন্নাথদেবের বেশভূষার ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও ঐতিহ্য : প্রথম পর্ব

লোকসাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে মানুষ ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে প্রথমে বেছে নিয়েছিল পাথর-গাছ-স্তূপ; তারপর সে দেবতা হিসেবে পুজো করতে শুরু করল নানান পাখি ও পশুদের; তারপর এক সময় এই সব পশু-পাখিদের অনেকেই বিভিন্ন দেবতার প্রতীক হয়ে গেল, অনেকেই হয়ে গেল দেবতার বাহন, আবার অনেকেই একই সঙ্গে দেবতার প্রতীক ও বাহন দুই-ই হয়ে রইল।

এই শেষের পর্বটিতে মানুষ প্রতীক ছেড়ে দেবতাকে স্বরূপে পেতে চাইল, নিরাকার ধারণা থেকে পূর্ণ-সাকারে পেতে চাইল, তার মূর্তি গড়তে চাইল। সেই মূর্তি নির্মাণের জন্য 'নিজেরা' ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন মডেল ছিল না মানুষের কাছে; যার মধ্যে প্রকৃতির সব ক'টি গুণ শাশ্বতরূপে প্রকাশিত হয়।

তাই সেই মূর্তি নির্মাণের লগ্নে দেব-দেবীরা হয়ে উঠলেন অবিকল মানুষের মতো দেখতে। মানুষের সঙ্গে বিভেদ ঘোচাতে, মানুষের চেয়ে অমিত শক্তিধর বোঝাতে সেই মূর্তিতে কালক্রমে কোথাও যোগ হল অতিরিক্ত মাথা, অতিরিক্ত হাত, সেই সঙ্গে অলৌকিক মহিমা।

Jagannath1

ঈশ্বর মানুষের আদল নিয়ে যেমন নির্মিত হলেন, তেমনি গেরস্ত-পরিবারের অচ্ছেদ্য সদস্যও হয়ে উঠলেন। এই পারিবারিক সংযোগ থেকেই তিনি আর পাঁচটা পারিবারিক সম্পর্কের গণ্ডিতেও ধরা দিলেন। কারও কাছে হয়ে উঠলেন পিতা-মাতা, কারও কাছে প্রেমিক বা প্রেমিকা, কারও কাছে হয়ে উঠলেন আদরের সন্তান।

ফারাকটা শুধু এখানেই যে, এই সম্পর্কগুলোর ভেতরেও আর একটা সম্পর্ক ফল্গুধারার মতো বইতে লাগল, তা হল, প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের জেরেই হস্ত ও পদবিহীন হয়েও দেবতা জগন্নাথ হয়ে উঠলেন, জগতের নাথ।

জগন্নাথ কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি যে, আদিতে 'জগন্নাথ' ছিলেন শবর দেবতা 'নীলমাধব'। শবরসর্দার বিশ্বাবসু ছিলেন তাঁর উপাসক, পূজারী। লোক-সাধারণের অগম্য ও অগোচর এক গুহা ছিল তাঁর মন্দির।

অপক্ক নৈবেদ্য ছিল তাঁর আহার। কিন্তু, এইভাবে নিছক শবরমণ্ডলের দেবতা হয়ে নারায়ণ নীলমাধবের আর জনশূন্যস্থানে নির্বান্ধব অবস্থায় থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নে জানালেন তাঁর জনসমক্ষে আসার বাসনা। 

তখন মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ছলে-বলে-কৌশলে নীলমাধবকে রাজা নিয়ে এলেন পুরুষোত্তমক্ষেত্রে। মন্দিরের রত্নবেদীতে সুভদ্রা, বলরাম আর প্রিয় সুদর্শনকে সঙ্গে নিয়ে 'জগন্নাথ' নাম ধারণ করে দারুব্রহ্ম নারায়ণ অধিষ্ঠিত হলেন। 

লক্ষণীয় যে, এখানে দেবতা একা কিংবা বামে হ্লাদিনীসহ অধিষ্ঠিত হলেন না। অধিষ্ঠিত হলেন ভাই আর বোনের সঙ্গে। জগতের নাথ এখানে এইভাবে পারিবারিক সৌভ্রাতৃত্বের উদাহরণ রেখে জগৎসংসারকে শিক্ষা দিলেন। একমাত্র মা দুর্গার আবাহনকাল ছাড়া পরিবারপ্রীতির মধ্য দিয়ে বিশ্বপ্রেমের এমন বার্তা আর কোন দেবতার পুজোয় আমরা পাই না।

Jagannath2

পারিবারিক বন্ধন নিয়ে 'জগন্নাথ' যেমন জনসমাজে পরিচিত হলেন, তেমনি অধিষ্ঠাতার সঙ্গেও পারিবারিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। ব্যাধ সমাজের কাছ থেকে হৃত হয়ে 'নীলমাধব' তথাকথিত মান্য-সমাজে যখন 'জগন্নাথ'-রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন; তখন তিনি অপুত্রক রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও রানি গুন্ডিচার হৃদয়ে একাধারে পরমেশ্বরের অবতার এবং আপন সন্তানরূপে গৃহিত হলেন।

অর্থাৎ, জগন্নাথ একই সঙ্গে ঈশ্বর এবং মানব-রাজার পুত্র, রাজপুত্র হয়ে উঠলেন। ফলে, তাঁর আহার-বিহারের আয়োজনে ঈশ্বরের প্রতি নিষ্ঠা ও নিবেদনের ঐকান্তিক ছাপ যেমন পড়ল, তেমনি রাজকীয় আড়ম্বরও যুক্ত হল।

ঈশ্বরের কাছে নিত্য ও নৈমিত্তিক বেশভূষার পরিবর্তন বাহুল্যমাত্রই শুধুই নয়, অভাবনীয়। কিন্তু, মূর্তিতে যেহেতু আমরা ঈশ্বরকে মানুষের ছাঁচে বেঁধে ফেলেছি, জগন্নাথকে উৎকলের রাজকুমার করে তুলেছি; তাই রাজপুত্রের যেমন দিন ও রাতের পোশাক ভিন্ন হয়, প্রসাধনের বৈচিত্র্য থাকে, বিশেষ বিশেষ পর্বে পোশাক ও প্রসাধন বিশিষ্ট হয়ে ওঠে, জগন্নাথের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। সেই প্রসাধন প্রস্তুত করার জন্য, প্রসাধিত করার জন্য, বস্ত্র পরিয়ে দেওয়ার জন্য, অলঙ্কার পরিয়ে দেওয়ার জন্য জগন্নাথের মন্দিরে নানান পদ তৈরি করা হল। বংশপরম্পরায় সেই পদ-ঐতিহ্য প্রশস্ত হল।

ঈশ্বর উপাসনায় 'তিন' সংখ্যাটি বিশিষ্ট। জগন্নাথের বেশভূষা-প্রসাধনেও এই 'তিন'-এর উপস্থিতি রয়েছে। সুতি ও সিল্কের কাপড়; রত্নখচিত ধাতুর অলঙ্কার এবং  ফুল-পাতা (তুলসি ও কাঁঠাল)-সুগন্ধী (চন্দন-কর্পূর-মৃগনাভি) দিয়ে সম্পন্ন হয় সেই বেশভূষা ও প্রসাধন। এই বেশভূষা ও প্রসাধন-রচনার অনুষ্ঠানকে বলা হয়, 'শৃঙ্গার'। 'শৃঙ্গার' তিন রকমের--'বস্ত্র শৃঙ্গার', 'পুষ্প শৃঙ্গার' ও 'অলঙ্কার শৃঙ্গার'। শৃঙ্গারকর্ম সম্পাদনের জন্য রয়েছে তিন ধরণের দেবভৃত্যের পদ--'পুষ্পালক', 'খুঁটিয়া' এবং 'চাঙ্গেদা'।

বার-তিথি-মাস-পার্বন উপলক্ষে উল্লিখিত তিন-শৃঙ্গারের মধ্যে যে পরিকল্পিত সূক্ষ্ম ও প্রকটবৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়, তা খুঁটিয়ে দেখার মতো ও অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে রয়েছে বিচিত্র সব নাম, বিচিত্র সব প্রথা, বিভিন্ন উদ্দেশ্য এবং অজানা সব গল্প। সেই সব গল্পগাথার সম্ভার থাকছে আগামিকালের পর্বে। আজ এই পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...