কালী কথা: মা হংসেশ্বরী মন্দির

গতদিনের কালী কথায় আমরা ছিলাম উত্তর ২৪ পরগনায়, এবার আমরা গঙ্গা অতিক্রম করে হুগলিতে চলে আসব। গঙ্গা তীরবর্তী জেলা হুগলি আর সেই জেলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ হল বাঁশবেড়িয়া। মোঘল আমলে এর নাম ছিল বংশবাটী। সেই দুর্গের শহর বংশবাটী আজ বাঁশবেড়িয়া।
দীনবন্ধু মিত্র লিখে গিয়েছেন,

"পরিপাট্য বংশবাটী স্থান মনোহর
যেদিকে তাকাই দেখি সকলই সুন্দর।"

বাঁশবেড়িয়া পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে গঙ্গা। দত্তরায়রাই এখানকার রাজা ছিল। যদিও বর্ধমানের পাটুলিতে দত্তরায়দের আদি নিবাস ছিল। দত্তরায়রা ছিল মোঘল সম্রাটদের বিশ্বাসভাজন, সম্রাট আকবর এই পরিবারকে রায় উপাধি প্রদান করেছিল।আকবরের পরে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর দত্তরায়দের মজুমদার উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৬৫৬ সালে শাহজাহানের থেকে দত্তরায় পরিবারের আদিপুরুষ রাঘব দত্তরায় তদানিন্তন সাতগাঁও অর্থাৎ বর্তমান সপ্তগ্রামের ২১ টি পরগণার জায়গীর লাভ করেন। এর কিছুকাল পরেই রাঘবপুত্র রামেশ্বর রায় পাটুলি ছেড়ে বংশবাটীতে চলে আসেন। তিনিই বাংলার নানান জায়গা থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্যসহ অন্যান্য প্রায় ৩৬০টি পরিবারকে নিয়ে এসে বংশবাটীতে বসতি স্থাপন করেন।

সেই সঙ্গেই জনপদের প্রতিরক্ষার জন্য, কিছু পাঠান যোদ্ধাদের এনে তাদের উপর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিলেন। সেই সময় বাংলার শাসন ব্যবস্থা ছিল বিশৃঙখলাময়। মোঘল সম্রাটের প্রাপ্য রাজস্ব পৌঁছে দিতে জমিদারেরা গাফিলতি করতেন। রামেশ্বর সঠিক রাজস্ব ব্যবস্থা প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সুনজরে চলে আসেন তিনি। ঔরঙ্গজেব খুশী হয়ে রামেশ্বরের পরিবারকে পঞ্জ-পর্চা খেলাৎ ও বংশানুক্রমিক রাজা-মহাশয় উপাধি প্রদান করেন।

বাংলা তখন বর্গী আক্রমণে বিপর্যস্ত, শোনা যায় মারাঠা শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাজা রামেশ্বর একটি বাঁশবন পরিষ্কার করে এক মাইল দীর্ঘ পরিখা বেষ্টিত এক দূর্গ বানিয়েছিলেন, যা থেকে এই অঞ্চলটির নাম হয় বাঁশবেড়িয়া। দূর্গটি লোকমুখে গড়বাটী নামে প্রসিদ্ধ ছিল। রামেশ্বরের বিশ্বস্ত পাঠান যোদ্ধারা এই দূর্গের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। এই পাঠানদের পরবর্তী বংশধরদের কারও কারও পরিবার এখনও বাঁশবেড়িয়াতেই বসবাস করেন।

 

Hongsewari1

 

রামেশ্বর রায় বাঁশবেড়িয়ায় একটি টেরাকোটার কারুকার্যখচিত বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করান, যা অনন্ত বাসদেব মন্দির নামে পরিচিত। বাঁশবেড়িয়ার গন্ধেশ্বরী ঘাটেও টেরাকোটার দুটি ছোট মন্দির তৈরি হয়েছিল। অনন্তবাসুদেব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১৬৭৯ সালে। পোড়ামাটির কাজে সজ্জিত এই মন্দিরের আদল অনেকটা বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মতো, সময়কাল দেখে অনুমান করা যায় যা বিষ্ণুপুরের মন্দিরের সমসাময়িক। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী নষ্ট হচ্ছে। আগেই অনন্তবাসুদেব মন্দিরে প্রাচীন কষ্টিপাথরের মূর্তি চুরি হয়ে যায়। এটি বর্তমানে হংসেশ্বরী মন্দিরের পূর্ব দিকে অবস্থান করছে।

আজ কালী কথায় এই হংসেশ্বরী মন্দিরের কাহিনীই বলব। পদ্মের কুঁড়ির আদলে তেরো চূড়ায় সুসজ্জিত অভিনব মন্দির এটি। হংসেশ্বরী মন্দিরের গঠনশৈলী আজও বিস্ময়। মন্দিরের সামনের ভাগের ছাদের রাজস্থানী চিত্রশিল্পীদের হাতে আঁকা চিত্রকারুকার্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যা দেখে মোঘল স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করে। ঐতিহাসিকদের মতে, তান্ত্রিক যোগসাধনার প্রত্যক্ষ স্থাপত্যরূপ হল হংসেশ্বরী মন্দির।

রাজা রামেশ্বর রায়ের প্রপৌত্র নৃসিংহদেব রায় হংসেশ্বরী মন্দিরটির নির্মান শুরু করেন। রামেশ্বরের পুত্র রঘুদেব, রঘুদেবের পুত্র গোবিন্দদেব, গোবিন্দদেব আর হংসেশ্বরী দেবীর পুত্র হলেন নৃসিংহদেব। এই হংসেশ্বরী দেবীর নামেই বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির। গোবিন্দদেব মারা যাবার তিন মাস পর জন্ম হয় নৃসিংহদেবের। ইংরেজদের করাল গ্রাস থেকে নিজ পিতৃসম্পত্তি উদ্ধারের জন্য রাজা নৃসিংহদেব তাঁর মা হংসেশ্বরী দেবীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। পিতৃসম্পত্তি উদ্ধারের জন্যে মামলা-মোকোদ্দমার অর্থ উপার্জনের জন্য নৃসিংহদেব কাশী যাত্রা করেন।

রাজ্য ত্যাগের সময় চার লক্ষ টাকা রেখে, তিনি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, ঐ গচ্ছিত অর্থ যেদিন সাত লক্ষ হবে, সেই দিনই তাকে খবর দিতে হবে তিনি ফিরবেন। রাজকোষে সাত লক্ষ টাকা জমানোর জন্যে নৃসিংহদেবের বড় রানি মহামায়া নিজের অলংকার পর্যন্ত শেষ করে দিয়েছিলেন। রাজা ফিরলেন, টাকা থাকা সত্ত্ববেও পিতৃসম্পত্তি আর উদ্ধার হল না। কারণ ততদিনে পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে নৃসিংহদেবের জীবনে, কাশীতে থাকাকালীন একদিন রাতে মাতৃরূপে তাঁর দৈব দর্শন হয়েছিল। তিনি তাঁর মা হংসেশ্বরী দেবীকে এক জগজ্জননী মাতৃরূপে দেখেছিললেন। পরেই তিনি স্থির করেন, রাজকোষে জমা টাকা দিয়ে তিনি আর কিছু না, বংশবাটীতে মাতৃমন্দির নির্মাণ করবেন, যা হবে মা হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির।

রাজা নৃসিংহদেব কাশী থাকাকালীন ১৭৯২ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত তন্ত্রচর্চা করেন ও 'উড্ডীশতন্ত্র' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সংসার ত্যাগ করে অনেক দিন আগেই, সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। ১৭৯৯-এ তিনি ফিরে আসেন এবং জমিদারির মালিকানা উদ্ধারের পরিবর্তে তাঁর লন্ডন যাওয়ার উদ্দেশ্যে জমানো অর্থ দিয়ে তন্ত্রমতে ঐ মাতৃ মন্দির স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রপিতামহের প্রতিষ্ঠিত অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটির ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থা দেখে, তিনি ঠিক করেন পোড়ামাটির মন্দির না বানিয়ে পাথরের মন্দির বানাবেন।

 

Hongsewari2

১৭৯৯ সালে রাজা নৃসিংহদেব রায় হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু এই মন্দিরের নির্মাণ শেষ করার আগেই ১৮০২ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। নৃসিংহদেবের প্রথম স্ত্রী সহমরণে যান। হংসেশ্বরী মন্দিরটি তৈরিতে নৃসিংহদেবের থেকে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল তাঁর ছোটরানি শঙ্করী দেবীর। বহু প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই করেন তিনি স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। এমনকি নৃসিংহদেবের এক পালিত পুত্র কৈলাসদেবের সঙ্গেও ছোটরানি জমি সংক্রান্ত মামলায় পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে রাজার দ্বিতীয় স্ত্রী রানি শঙ্করী দেবীর আমলে ১৮১৪ সালে মন্দির নির্মাণ শেষ হয়।

মন্দিরের ফলকে লেখা রয়েছে-

"শাকাব্দে রস বহ্ণি মৈত্র গণিতে শ্রীমন্দিরং মন্দিরং।
মোক্ষদ্বার চতুর্দ্দশেশ্বর সমং হংসেশ্বরী রাজিতং।।
ভূপালেন নৃসিংহদেব কৃতিনারব্ধং তদাজ্ঞানুগা।
তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্ম্মমে।।"
                                       (শকাব্দ ১৭৩৬)

অর্থাৎ, চতুর্দ্দশ মোক্ষদ্বার রূপী শিবের সহিত হংসেশ্বরী কর্ত্তৃক বিরাজিত গৃহ এই শ্রীমন্দির যাহা কৃতী নৃসিংহদেব ভূপাল কর্ত্তৃক আরব্ধ হয় তাহা ১৭৩৬ শকাব্দে তাঁহার আজ্ঞানুগা পত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্ম্মান করিয়াছেন। (শকাব্দ অর্থাৎ শশাঙ্কের রাজত্বকাল, এখানে তদানিন্তন সময়ের বানান বিধি ধরা হয়েছে)

শোনা যায়, মন্দির তৈরির জন্য উত্তর প্রদেশের চুনার থেকে সাত নৌকা বোঝাই করে পাথর এনেছিলেন রাজা। মন্দির নির্মাণের জন্য রাজস্থানের জয়পুর থেকে মিস্ত্রী-কারিগরদের আনা হয়েছিল, আর উত্তরখণ্ড থেকে আনা হয়েছিল প্রস্তর শিল্পী। মন্দিরটির স্থাপত্য-কারুকার্যে উত্তর রাজস্থানের শেখাওয়াতি হাভেলি নির্মান শৈলীর নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল মোট ৫ লক্ষ টাকা। মন্দিরের ২১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট মিনারে রূপ যেন একটি ফোটা পদ্মফুল। মন্দিরের মূল চূড়ার শীর্ষে সহস্রদ্বারে রয়েছেন পরম পুরুষ শ্বেতবর্মধারী মহাদেব আর সভাগৃহের মূলধারে কুলকুন্ডলিনী শক্তিরূপ হংসেশ্বরী।

তন্ত্র সাধনার ষটচক্রভেদের তত্ত্বকে অনুসারণ করে হংসেশ্বরী মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। তান্ত্রিক যোগাচার মতে সুষুম্নাকান্ডকে কেন্দ্র করে মানুষের দেহে মোট পাঁচটি প্রধান নাড়ী রয়েছে, সেগুলি হল ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না ও চিত্রিণী। এই সুষুম্নাকান্ড বরাবর বিভিন্ন স্থানে এই চক্রগুলি রয়েছে। এই চক্রগুলির একদম নীচে অবস্থানকারী চক্রটির নাম মূলাধার চক্র, যেখানে রয়েছে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনী। কুলকুণ্ডলিনীর একদম উপরে সহস্রারে রয়েছেন শিব অর্থাৎ ঈশ্বর।

এই কুলকুণ্ডলিনীকে গুরুর দেখানো পথে যোগ-সাধনার মাধ্যমে জাগ্রত করে, মূলাধার থেকে সহস্রারে পৌঁছে শিবের সঙ্গে মিলিত হতে পারাই একজন তন্ত্র সাধকের পরম লক্ষ্য বলে গণ্য করা হয়। তান্ত্রিক নৃসিংহদেব মানবদেহের এই কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্বকেই মন্দিরের স্থাপত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে অর্থাৎ 'মূলাধারে' সহস্রদল পদ্মের উপরে কুণ্ডলিনী শক্তিরূপ দেবী হংসেশ্বরী বিরাজমান। মন্দিরে বিভিন্ন স্থান দিয়ে পাঁচটি প্রধান নাড়ীর রূপক হিসাবে পাঁচটি সিঁড়ি উঠে গেছে। এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে রয়েছে একটি বিচিত্র গোলকধাঁধা যার মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে পথপ্রদর্শকের সাহায্য ছাড়া বেরিয়ে আসা সত্যিই মুশকিল।

এই গোলকধাঁধারই একস্থানে একটি নিভৃত প্রকোষ্ঠে বিরাজ করছেন শ্বেতপাথরের সদাশিব। যার অর্থ হল, প্রকৃত গুরুর দেখানো পথ ধরেই মূলাধারের শক্তিকে নাড়ীর মাধ্যমে চালিত করে হৃদিপদ্মে অবস্থিত শিবের সঙ্গে মিলিত করা সম্ভব। এরই তান্ত্রিক পরিভাষার নাম 'ষটচক্রভেদ'। ষটচক্রভেদ প্রণালীতে তৈরি ত্রয়োদশ পদ্মকারক শোভিত চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরের মধ্যে কুলকুণ্ডলিনী শক্তিরূপী মহামায়া, আদ্যাস্বরূপিণী হংসেশ্বরীর স্থাপনা করা। হংসেশ্বরী শব্দটিরও আছে একাধিক আধ্যাত্মিক ব্যাখা।

যেমন আত্মা হংসস্বরূপ। হংস যেমন ক্ষীর-নীর আলাদা করে নীরভাগ ছেড়ে ক্ষীরটুকু গ্রহণ করতে সক্ষম, আত্মাও তেমনি সংসারের অসার বস্তু ছেড়ে পরমাত্মার দিকে ধাবিত হতে পারে। আবার তন্ত্রমতে, মানবদেহে নিঃশ্বাসের সঙ্গে হং শব্দ এবং প্রশ্বাসের সময় সঃ শব্দটি অবিরত উচ্চারিত হচ্ছে। একেই হংস মন্ত্র বা অজপা মন্ত্র বলা হয়। জপ না করলেও, প্রতি মুহূর্তে প্রাণবায়ুর আসা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে চলেছে। তন্ত্রমতে হংস হচ্ছেন স্বয়ং ভগবতী, মহাশক্তি কুলকুণ্ডলিনী। শিব ও শক্তি অভিন্ন। হংসমন্ত্রে এই সম্বন্ধই প্রকাশ পেয়েছে। তাই শব্দরূপিনী দেবী সর্বদাই মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত।

হংসেশ্বরী মন্দিরটি দক্ষিণমুখী, উচ্চতায় প্রায় ৭০ ফুট। এই মন্দিরের চারপাশে পরিখা রয়েছে। প্রবেশ পথে রয়েছে সুবিশাল নহবতখানা। নহবতখানা থেকে কয়েক পা এগোলেই হংসেশ্বরী মায়ের মন্দির। এর চারিদিকে বারান্দা ও সামনে উন্মুক্ত। তন্ত্রমতে তৈরি এই পাঁচচালা মন্দিরটিতে আটকোণে ৮টি, মধ্যস্থলে ৪টি ও কেন্দ্রস্থলে ১টি মিলে মোট ১৩টি মিনার বা চূড়া রয়েছে। প্রতিটি মিনারের শীর্ষভাগ মোচাকৃতি পদ্মকোরকের আদলে নির্মিত।

এই মধ্যস্থলের মিনারটির নীচের তলার প্রকোষ্ঠে একটি সাদা রঙের শিবলিঙ্গ রয়েছে। হংসেশ্বরী মন্দিরের গর্ভগৃহে পঞ্চমুণ্ডির আসন বিরাজ করছে। পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপরে প্রথমে রয়েছে সহস্রদল নীলপদ্ম। তার উপরে অষ্টদল পদ্ম। তার উপরে ত্রিকোণ বেদীর উপরে শায়িত রয়েছেন মহাকাল। মহাকালের হৃদয় থেকে উত্থিত দ্বাদশদল পদ্মের উপরে এক পা মুড়ে অবস্থান করছেন হংসেশ্বরী দেবী। বেদী এবং মহাকাল মুর্তিটি পাথরের তৈরি, দেবীমুর্তি নিম কাঠের।

হংসোপনিষদ অনুসারে, "অহমিতি বীজম্‌। স ইতি শক্তিঃ। সোহহমিতি কীলকম্‌"। অর্থাৎ 'হং' বীজস্বরূপ, 'সঃ' শক্তিস্বরূপ, এবং 'সোহং' কীলক বা উপায়। এই মন্ত্রের সাহায্যেই হৃদয়ের অষ্টদল পদ্মের মধ্যস্থিত হংসাত্মাকে দেখা যায়। বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মূর্তিতে এই ভাবনারই প্রত্যক্ষ রূপ লক্ষ্য করা যায়। মায়ের বর্ণ নীল, মাথায় ঘোমটা। দেবীর বামহাতে খড়গ ও নরমুন্ড এবং ডানহাতে অভয়মুদ্রা ও শঙ্খ। প্রতি অমাবস্যায় ও জগন্নাথ স্নানযাত্রার দিন দেবীর বিশেষ পুজো হয়। দেবীর নিত্যপুজো ও অন্নভোগের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি ১২ বছর বা এক যুগ অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ করা হয়।

দেবীর প্রধান বাৎসরিক পুজো হয় কার্ত্তিক অমাবাস্যায় দীপান্বিতা তিথিতে। বছরে ৩৬৪ দিন দেবীর শান্তমূর্তি, কিন্তু দীপান্বিতা অমাবস্যার একটি রাতের জন্য দেবী এলোকেশী রূপ ধারণ করে। সেদিন সন্ধ্যারতির পর দেবীর মুখে রূপোর মুখোশ ও সোনার জিভ পরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও পুজোর পরের দিন সেই মুখোশ খুলে নেওয়া হয়। পুজোর দিন দেবী গায়ে কেবল ফুল-অলঙ্কার পরিয়ে, মাকে রাজবেশে সাজানো হয়। বছরের অন্যদিনগুলিতে দক্ষিনা কালিকা মতে পুজো হলেও বছরের এই একটি দিন তান্ত্রিক মতে পুজো হয়। সারাবছর মায়ের শান্ত রূপ বিরাজমান কিন্তু কার্তিক মাসের কালীপুজোর রাতে একরাতের জন্য মায়ের রূপ হয় এলোকেশী। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়ম মায়ের পুজো হয়ে আসছে, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আজ ২০৭ বছর অতিক্রম করেও কালিকা তন্ত্রের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়েছে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঁশবেড়িয়ার ঐতিহ্য হংসেশ্বরী মন্দির।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...