এপ্রিল ফুল-এর কিসসা

আজ পয়লা এপ্রিল, করোনার করাল গ্রাসে কেটে গেল দুটো বছর! এপ্রিল ফুল কাউকে করতে হল না, ওই তুচ্ছ অণুজীব আমাদের বোকা বানিয়ে ইতিমধ্যেই কিস্তি মাত করে দিয়েছে, নিজেদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব ভাবতে এখন মাঝে মাঝে হাসি পায়। কিন্তু জীবন তো তা বলে থেমে থাকবে না, The show must go on ! চলুন আজ আপনাদের এপ্রিলের প্রথম দিনের ইতিহাসটা বলি, একাধিক তত্ত্ব এবং কিংবদন্তির মিশেল হল পয়লা এপ্রিলের এপ্রিল ফুল!

সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনী, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্স তাদের ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করে। তার আগে বছর শুরু হত মার্চের শেষে বা এপ্রিলের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে। কিন্তু সেটি এগিয়ে নিয়ে আসা হয় এবং ১লা জানুয়ারি থেকে বছর শুরু করা হয়। কিন্তু, পরিবর্তন অনেকেই মানতে পারলেন না। তারা এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন যে, ২৫মার্চ থেকে ১এপ্রিল পর্যন্ত তারা আগের মতোই নববর্ষ পালন করবেন।

কিন্তু যারা এই পরিবর্তন গ্রহণ করেছিল তারা পুরাতনপন্থীদের সাথে মজা করতে চাইল। যারা পুরনো ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ১লা এপ্রিলকেই নববর্ষের ১ম দিন ধরে দিন গণনা করে আসছিল, তাদেরকে প্রতি বছর ১লা এপ্রিলে বোকা উপাধি দেওয়া হত। ফ্রান্সে পয়সন দ্য আভ্রিল (poisson d'avril) পালিত হয় এবং এর সাথে মাছের সম্পর্ক আছে। এপ্রিলের শুরুর দিকে ডিম ফুটে মাছের বাচ্চা বের হয়। এই শিশু মাছগুলোকে খুব সহজেই বোকা বানিয়ে ধরা যায়। সেজন্য তারা ১ এপ্রিল পয়সন দ্য এভ্রিল অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ উদযাপন করে। ওই দিন বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের পিঠে কাগজের মাছ ঝুলিয়ে দেয় তাদের অজান্তেই। যখন অন্যরা দেখে, তখন পয়সন দ্য আভ্রিল বলে চিৎকার করে ওঠে। কবি চসারের ক্যান্টারবারি টেইলস ১৩৯২ সালে বইয়ের নানস প্রিস্টস টেইলে এই দিনের কথা খুঁজে পাওয়া যায়। এই কাহিনী গ্রহণযোগ্য মনে হলেও ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই কাহিনীর ত্রুটি ধরা পরে।

একটি রোমান গপ্পোও বেশ চলে, রোমানদের মৃত্যুর দেবতা প্লুটো যখন তার 'স্ত্রী' পারসিফন-কে অপহরণ করে আনলেন, তখন পারসিফনের মা সেরেস মেয়েকে খুঁজতে চেষ্টা করলেন। বোকার মতো পৃথিবীতে অনেক খুঁজেও পেলেন না মেয়েকে; কারণ মেয়ে তখন আন্ডারওয়ার্ল্ডে, মাটির উপরে না। সেরেসের বোকামি স্মরণ করে ১ এপ্রিল বোকামি দিবসপালন করা হত বলেই অনেকে মনে করেন।

 

April1

আবার ব্রিটিশ লোককথা বলে, নটিংহ্যামশায়ারের 'গথাম' শহর ছিল বোকাদের শহর। ত্রয়োদশ শতকের ব্রিটেনে নিয়ম ছিল, ব্রিটেনের রাজা যেখানে যেখানে পা রাখবেন তা রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে যাবে। যখন গথামবাসীরা শুনল রাজা আসছেন শহরে, তারা বললেন, তাকে প্রবেশ করতে দেবেন না, তারা কিছুতেই গথামকে হারাবেন না। রাজা ক্ষেপে সৈন্য পাঠালেন। যখন সৈন্য এল শহরে, তারা দেখল সারা শহরে হুলস্থূল কাণ্ড। সব বাসিন্দা বোকার মতো কাজ করছে। তারা ফিরে গিয়ে এমন সংবাদ দিল যে, রাজা বললেন, এমন বোকাদের শাস্তি দেয়া যায় না। তাই তিনি মাফ করে দিলেন। গথাম স্বাধীন থাকল। গথামবাসীদের বুদ্ধিতে ঘায়েল হল রাজা, গথামবাসীদের এই সুচতুরবুদ্ধির কথা স্মরণ করা হয় এপ্রিলের পয়লা তারিখে।

জার্মানির একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৫৩০ সালের ১এপ্রিল, জার্মানির অগসবারগ শহরে একটা আইন বিষয়ক সভা হবার কথা ছিল। সভার ফলাফল নিয়ে অনেক মানুষ অনেক টাকা বাজিকরের কাছে জমা রাখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐদিন কোনো সভাই হয়নি। বাজিকর টাকা ফেরত দেয়নি, সব টাকা চলে যায়। তাই মনে করা হয়, এই বোকামি একটা উৎস হতে পারে এপ্রিল ফুলের।

হল্যান্ডের আবার অন্য কিংবদন্তি, ১৫৭২ সালের ১ এপ্রিল হল্যান্ডের ডেন ব্রি এল শহরটাকে লর্ড আল্ভার স্প্যানিশ শাসন থেকে মুক্ত করে ডাচ বিদ্রোহীরা। এইদিন তারা লর্ড আল্ভাকে পুরো বোকা বানিয়ে ছাড়ে। আল্ভার বোকামি স্মরণ করে এপ্রিল ফুল পালন করা হয়। মূলত এই ঘটনার পর অনেক জায়গায় বিদ্রোহ সোচ্চার হয় আর স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে হল্যান্ড।

মুসলিম বিশ্বে আবার অন্য একটি গল্প প্রচলিত আছে, কবুতরের ডাঙা খোঁজা নিয়ে এবং স্প্যানিশ খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধের দুটি তত্ত্ব এবং পাল্টা তত্ত্বের টানাপোড়েন আছে এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি নিয়ে যদিও এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

ইতিহাস তো জানা হল, পৃথিবী বড় সংকটে, কে কদিন থাকে কেউ জানে না। তাই আজকের দিনে বোকা বানিয়ে একটু নিছক মজা করতেই পারেন নিকট জনের সাথে। অনাবিল আনন্দ আর হাসিই তো পারে পৃথিবীর অসুখ সারাতে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...