কৃষ্ণের সঙ্গে পরকীয়া করে রাধা অমর হয়ে গেলেন। তাঁদের প্রেম আদর্শ হয়ে গেল, তাঁদের প্রেম থেকে তত্ত্ব তৈরি হল। তাঁদের প্রেমে পদাবলী রচিত হল, কীর্তন গান রচিত হল। কত কাব্য কত দর্শন তৈরি হল। অথচ রাধার সঙ্গে যাঁর বিয়ে হয়েছিল, সেই আয়ান ঘোষ, তাঁর কী হল? তিনি উপেক্ষিত হলেন। পুরুষ এবং নারীতন্ত্রে অক্ষমতা নিয়ে হাস্যকর হলেন। বোকা মানুষ হিসেবে বাতিল হয়ে গেলেন। অথচ, এর কোনোটাই হওয়ার কথা কিন্তু ছিল না।
আয়ান হলেন কোশল দেশের রাজা মাল্যক ও রানি জটিলার ছোট ছেলে। দেখতে সুন্দর, ভালো ব্যবহারের জন্য সবার পছন্দের লোক, সেইসঙ্গে দারুণ বীর। তাঁর তিন দাদা তিলক, দুর্মদ, দম এবং তিন দিদি কুটিলা, প্রভাকরী ও যশোদার বিয়ে হয়েছে বড় বড় রাজার ঘরে। বাকি কেবল তিনি। পাত্র হিসেবে তিনি যথেষ্ট যোগ্য। আর সেই যোগ্যতার কথা কানে গেল রাধার বাবা বৃষভানুর। তিনি মেয়ের জন্য এমন পাত্রের খোঁজই করছিলেন। ফলে তিনি গায়ে পড়ে আয়ানের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। রাজকন্যা রাধার সৌন্দর্যের কথা শুনে আয়ানও বিয়েতে রাজি হলেন। কিন্তু, তখন কে জানত যে, এই রাজি হওয়াটাই ক্রমে আয়ানের কাল হয়ে দাঁড়াবে!
আয়ান জানতেন না যে, পাত্র হিসেবে তাঁকে মোটেই পছন্দ করেননি রাধা, তিনি চান কৃষ্ণকে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে মুখ ফুটে বাবাকে কিছুতেই সে-কথা বললেন না রাধা। বাবামার একমাত্র মেয়ে হিসেবে তিনি যথেষ্ট আদরের। তাছাড়া বাবা জানেন যে, রাধা সাধারণ মেয়ে নন, তিনি দেবী। তাই বাবাকে একবার পছন্দ-অপছন্দের কথা বললে তিনি নিশ্চয়ই কৃষ্ণের সঙ্গেই বিয়ে দেবার কথা ভাবতেন। তখনই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু, রাধা তা না-করে তপস্যার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণকে ডাকলেন। তাঁকে সরাসরি বললেন যে, আয়ান তাঁর কাছে কুকুরের চেয়েও অসহ্য! যেভাবেই হোক কৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করুন, নইলে তিনি গলায় দড়ি দেবেন!
কৃষ্ণ এবার বুঝলেন যে, এসে কী ফ্যাসাদে তিনি পড়েছেন! তিনি ভালোই জানেন, মেয়েরা বিগড়ে গেলে তাদের বুঝিয়ে পথে আনাটা বেশ ঝঞ্ঝাটের! তবুও কাটানোর চেষ্টায় খানিক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, অভিশাপ আছে, তাই এ-জন্মে রাধাকে সাধারণ মানুষের বউ হতেই হবে। আর তাছাড়া, আয়ান তো একেবারেই সাধারণ নন, তিনি তো তাঁরই অংশ। ফলে, তার সঙ্গে বিয়ে হলে ক্ষতি কিছুই হবে না। আর তাছাড়া গোপনে গোপনে তাঁদের দু'জনের সম্পর্ক তো থাকবেই।
আয়ান কৃষ্ণের অংশ হলে সাধারণ মানুষ হন কী করে? তেমন হলে অভিশাপই বা সত্য হয় কী করে?--রাধা এসব প্রশ্ন তুললেন না। কৃষ্ণের অন্যসব ছেঁদো কথাতেও ভুললেন না। কেঁদেকেটে তাঁর একটাই গোঁ--কৃষ্ণকেই বিয়ে করতে হবে, নইলে তিনি গলায় দড়ি দেবেন!
নিরুপায় কৃষ্ণ তখন শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। রাধাকে কোলে বসালেন। চুম্বন করলেন। তারপর চোখের জল মুছিয়ে আর এক প্রস্থ তাঁর মন ভোলানোর চেষ্টা করলেন। বললেন যে, ভবিষ্যতের ভক্তেরা তাঁদের দুজনের নাম একসঙ্গে যখন উচ্চারণ করবে তখন রাধার নাম আগে উচ্চারিত হবে। ‘রাধাকৃষ্ণ’ না-বলে উল্টোটা বললেই তাদের মহাপাপ হবে। সুতরাং, যার সঙ্গেই বিয়ে হোক না কেন, তাঁরা যুগলেই থাকবেন। কিন্তু, এসব স্তোককথাতেও রাধা ভুললেন না। বললেন, 'ওসব কথা থাক, ঐ লোকটাকে বিয়ে করে এক বিছানায় শোবার কথা ভাবতেও আমার ঘেন্না করছে! তুমি আমায় বিয়ে করবে কিনা বল, নইলে...।' রাধার জেদের কাছে কৃষ্ণকে হার মানতেই হল শেষমেশ। বললেন, 'ঠিক আছে, তুমি যা চাইছ তাই হবে।' তখন শুরু হল দুজনের গোপন পরামর্শ, রচিত হল এক গভীর ষড়যন্ত্র।
যশোদা আয়ানের আপন দিদি। গোকুলের রাজা নন্দ যশোদার স্বামী। যেদিন দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হল, সেদিন একইসঙ্গে যশোদাও কৃষ্ণের আর এক অংশের এবং একটি মেয়ের জন্ম দিলেন। বসুদেব যখন যশোদার মেয়েটিকে নিয়ে নিজের ছেলেকে তাঁর কাছে রেখে গেলেন, তখন সবার অজান্তে দুই কৃষ্ণ এক শরীরে মিলে গিয়ে এক ‘কৃষ্ণ’ হলেন। তাই কৃষ্ণ যশোদার যতটা পালিত, ততটাই নিজেরও। সেই সূত্রেই সম্পর্কে আয়ান হলেন কৃষ্ণের আপন মামা।
এদিকে কৃষ্ণের কাছে সব দিক সামলে নেবার আশ্বাস পেয়ে রাধা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। ওদিকে আয়ান ভেতরের লণ্ডভন্ড ষড়যন্ত্রের কথা কিছুই জানলেন না। তিনি বেশ আনন্দেই গুষ্টিশুদ্ধ লোক নিয়ে বিয়ে করতে এলেন। বরযাত্রী হয়ে মায়ের সঙ্গে সেখানে কৃষ্ণও এলেন। ছাদনাতলায় সম্প্রদানের সময় ছল করে মামার কোলে বসলেন কৃষ্ণ। তারপর দৈবশক্তির সাহায্যে আয়ানের পুরুষত্ব নষ্ট করে ফেললেন। মুহূর্তেই আয়ান অনুভব করলেন তাঁর শরীর থেকে কেমন করে যেন পুরুষের কাম-উদ্দাম-উদ্দীপনা সব নষ্ট হয়ে গেল! তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এ তাঁর কী হল! বৃষভানু বরকনের হাতে হাত দিলেন, কন্যা সম্প্রদান করলেন—কিন্তু, কোন কিছুই আয়ান যেন টের পেলেন না। মায়ার ছলাকলায় কৃষ্ণই তাঁর আগে হাত বাড়িয়ে কনের হাত ধরলেন, সম্প্রদান স্বীকার করলেন। সবাই জানল আয়ানের সঙ্গে রাধার বিয়ে হল, আসলে কিন্তু হল না! একটা মস্তবড় মিথ্যের মাঝখানে বেকুব হয়ে আয়ান যেন দাবার চালের নিছক একটা ঘুঁটি হয়ে গেলেন। ভাগ্নে আজ তাঁকে একেবারে ‘মামা’ বানিয়ে ছাড়লেন!
বাসরটাসর মাথায় উঠল। সারা রাত্তির আয়ানের চোখে ঘুম এলো না। কিছুতেই শরীর আর জাগল না। এত বড় বীর তিনি, বউ নিয়ে, সংসার নিয়ে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে, তাঁরও ছিল--অথচ তারই মাঝে হঠাত করে তাঁর এ-অবস্থা হল কী করে! হাজার ভেবেও বুঝতে পারলেন না এর কারণ। শুধু বুঝলেন, জীবনটা শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল। কাউকে বলতে পারলেন না সেকথা। কিন্তু, লুকোতে চাইলেও ঘোষ বন্ধুদের কাছে ধরা পড়ে গেল তাঁর শরীরের বিপরীত ভাব। তাদের চাপাচাপিতে স্বীকারও করতে হল তার সত্যতা। শুরু হল হাসাহাসি কানাকানি। কান বেয়ে সে-খবর ঘর-পরিবারের কানেও উঠল। শুনে সবাই একেবারে হতভম্ব স্তম্ভিত হয়ে গেল, চলল কান্নাকাটির পালা।
যথারীতি দিকে বিয়ের পরদিন থেকেই বাড়ি থেকে কাত্যায়নী পুজোর ছুতোয় বেরিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার গোপনে দেখাসাক্ষাৎ শুরু তো হলই, চলতে লাগল শরীর দেওয়া-নেওয়ার পালা। ছেলে অক্ষম, তবু বউমার শরীরে বিয়ের পরের পরিবর্তন দেখে শাশুড়ি ও ননদের কেমন যেন সন্দেহ হল।
পরদিন রাধা বেরিয়ে যেতেই ছেলেকে গুচ্ছের কথা শুনিয়ে সন্দেহের কথা বললেন জটিলা। সেকথা শুনেই আয়ানের মাথা গরম হয়ে গেল। শারীরিক অক্ষম মানুষ এমনিতেই সংসারে ব্যক্তিত্বের জোর হারায়, মনে অসম্ভব জ্বালা নিয়ে বাঁচে। তার ওপর অবৈধ সম্পর্কের সন্দেহ এসে পড়লে মাথায় খুন চেপে যায়। আয়ানেরও তাই হল। তিনি হুড়কো নিয়ে ছুটলেন রাধার খোঁজে, হাতেনাতে ধরতে পারলে একেবারে মেরেই ফেলবেন! কিন্তু, ভালোমানুষকে বোকা বানানো তো কৃষ্ণের কাছে নস্যি। ধরা পড়ার মুহূর্তে তিনি কালীর সাজে দাঁড়িয়ে পড়লেন, রাধা অভিনয় করলেন পুজোর। বউকে দেবীর পুজো করতে দেখেই আয়ানের সব রাগ গলে জল। পুজো করতে বেরিয়ে রাধা তো পুজোই করছেন, কই সন্দেহের কিছু তো করছেন না! আয়ান বেজায় খুশি হয়ে মহানন্দে মা ও দিদিকে ডেকে এনে যেমন দেখালেন জ্যান্ত কালীকে, তেমনি দেখালেন রাধার ভক্তি! তখন ধোঁকার টাঁটিতে সক্কলে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।
এখানেই শেষ হল না। রাধাকৃষ্ণের গোপন প্রেম একদিন গোপন রইল না। কানাঘুষোয় ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল রাধার কলঙ্ক কাহিনি। তাই নিয়ে ঘরেবাইরে অশান্তি শুরু হল রাধার। সেটা চাপা দিতেই প্রয়োজন হল নাটকের। কৃষ্ণ অসুখের ভান করলেন। সাজানো বৈদ্য এসে জানালো যে, সতী নারীকে দিয়ে শতছিদ্র কলসিতে যমুনার জল আনাতে হবে, তাই দিয়েই তৈরি হবে ওষুধ। সেই ওষুধ খেয়ে ভালো হবেন কৃষ্ণ। কেউ যখন পারল না আনতে, সতীত্বের পরীক্ষায় ডাহা ফেল করল, তখনই কৃষ্ণের মায়ায় ছেঁদা কলসিতে জল এনে তাক লাগিয়ে দিলেন রাধা। সতীত্বের পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে পাশ করলেন। তখনই সবার মুখে কানাঘুষোর কুলুপ পড়ল, আয়ান-জটিলারা হলেন বেজায় খুশ।
এভাবেই নিশ্চয় অক্ষমতা-সন্দেহ আর বেকুবের সান্ত্বনা নিয়ে সারাটা জীবন কেটেছিল আয়ানের। লোকটার সত্যিকারের বিয়ে হল না, সত্যিকারের বউ জুটল না--জুটল শুধু একরাশ ভ্রম! রাধাকৃষ্ণের প্রেমের জৌলুসের মাঝে তাঁর মতো উপেক্ষিত চরিত্রের কথা শেষ অব্দি কে-ই বা আর বলে! কিন্তু, এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না। রাধার না-হয় অভিশাপ ছিল, আয়ানের তো ছিল না। তিনি তো পৌরুষ নিয়েই জন্মেছিলেন। রাধা তথাকথিত বিয়েতে অসম্মতি জানালেই তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করে তাঁর বীরত্ব নিয়ে সুখী হতে পারতেন, অন্তত সুখী হওয়ার চেষ্টা করতেন। আচ্ছা, এক বিছানায় না হোক, লোকলজ্জার খাতিরে এক ঘরে নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে খানিকটা করে জীবনের কিছুটা সময় এই বোকাহদ্দ লোকটার সঙ্গে রাধা কাটিয়েছেন; তাতে ভালোবাসা না হোক, সামান্য মায়াও কি রাধার মনে জন্মেনি? কে জানে! আসলে, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কাব্যে আয়ান এমন একটি হতভাগ্য একটি চরিত্র, যার কোন উত্তরণ নেই, একালেও...
কাহিনি ও প্রসঙ্গসূত্র সমস্তই ব্যাসদেবের লেখা ‘ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ’-এর উত্তর খন্ড অবলম্বণে লেখা।