৭৮ নম্বর নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের বাড়ি। পুরনো দিনের বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। এই বাড়িতে আজও রয়েছে একটা ঢেঁকি। শহর কলকাতার বুকে এমন একটা ঢেঁকি পর্যটকদের অবাক করে। কিন্তু হাটখোলার বিখ্যাত দত্ত বাড়ির কাছে এই ঢেঁকি আসলে ঐতিহ্য। কারণ কলকাতার অন্যতম বনেদি এই পরিবার এখনো বৈশাখ মাসে তিথি, নক্ষত্র এড়িয়ে ঢেঁকি পুজো করেন।, তারপর সেখানে মশলা কোটা হয় এবং কাসুন্দিও কোটা হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনার ওয়্যারহাউসের আমদানি-রপ্তানি বিভাগের দেওয়ান ছিলেন জগত রাম দত্ত। নিজের কাজের কারণে ব্রিটিশদের যথেষ্ট সুনজরে থাকতেন। জগৎ রাম দত্তের দাদু রামচন্দ্র দত্তও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমদানি-রপ্তানি বিভাগে কাজ করতেন।। তিনি ছিলেন মুতসুদ্দি। সেই সঙ্গে জমিদার। রাজনৈতিক কারণে রামচন্দ্র গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছিলেন। যদিও এই পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল কিন্তু এরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য কখনো ব্রিটিশ তোষণ করেননি।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতার কিছু ব্যক্তি ব্রিটিশদের খুশি করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। হাটখোলার দত্ত বাড়ি এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অথচ এই পরিবারেই জন্ম নেন অনেক দেওয়ান ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাঁরা ব্রিটিশ ভারতবর্ষে পেয়েছিলেন বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা। যেমন দুর্গারাম দত্ত এবং মদনমোহন দত্ত। সিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দিতে মীরজাফরের দেওয়া টাকা কাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে তা ঠিক করার জন্য ১৩ জন কমিশনার নিযুক্ত করা হয়েছিল ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে। এদেরই একজন ছিলেন দুর্গারাম দত্ত। মদনমোহন দত্ত নিজে ছিলেন ফার্গুশন সাহেবের দেওয়ান, বেনিয়ান ও ব্যবসায়ী। সরকারি আনুকূল্য পেতে তাদের কিন্তু সাহেবসুবোদের সঙ্গে সেই ভাবে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হয়নি।
এই পরিবারে আজও দুর্গাপুজো ও কালীপুজো পুরনো প্রথা মেনেই হয়।। দুর্গাপূজো ২০০ বছরের পুরনো। প্রতিমা সিংহাসনে বসার পর ব্রাহ্মণ ছাড়া কারো তা ছোঁয়ার নিয়ম নেই। বিসর্জনের দিন প্রতিমা সিংহাসন থেকে নামার পর তবেই বাড়ির কোনও স্ত্রীরা তাকে বরণ করেন। কুমারী মেয়েরা বরণ করেন দেবী কালিকে। দুর্গা প্রতিমা ভাসানের সময় এরা এখনো নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়ার প্রথাটিকে ধরে রেখেছেন।
প্রায় সাত বিঘা জমির ওপর জগৎরাম দত্তের দক্ষিণমুখী চকমিলানের বাড়ির একটা অংশ ভূমিকম্পে নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন নানা সরিকের মধ্যে বিভক্ত। নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের ৭৮ নম্বরের গায়ে যুক্ত হয়েছে এ কয়েকটি বাই নম্বর। দুশো বছর আগের ঠাকুরদালানের ওপরে উঠেছে কয়েকটা ঘর। আগে এই বাড়ির রথের খুব জাঁকজমক ছিল। রথযাত্রার দিন আশপাশের বহু মানুষ এখানে সমবেত হতেন। এখন যদি ও রথের সেই প্রচলন নেই।
কিছুদিন আগেও লোকেরা এই বাড়িটিকে পাখিওলা বাড়ি বলে ডাকতেন। এই বাড়িতে রয়েছে প্রচুর পাখি। এই বাড়ীর এক পূর্বপুরুষ রমানাথ দত্ত ছিলেন পাখির চিকিৎসক। বিশেষ করে পায়রা ও বুলবুল দস্তার। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান এক পাখোয়াজ বাজিয়ে।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই দত্ত বাড়ির নাতি। জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবী গঙ্গা নারায়ন দত্তের মেয়ে। জানকীনাথ প্রভাবতীর ছেলে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কাশিনাথ দত্ত রোডে গঙ্গা নারায়ণের বাড়ি রয়েছে।। কাশিনাথ দত্ত হলেন গঙ্গা নারায়ণের বাবা। রাজনারায়ণ বসুর স্ত্রী নিস্তারিণী হাটখোলার দত্ত বাড়ির মেয়ে। রাজনারায়ণের তিন ছেলে, চার মেয়ে। বড় মেয়ের স্বর্ণলতার স্বামী ডাক্তার কৃষ্ণধন ঘোষ। কৃষ্ণধন ও স্বর্ণলতা চার ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের বিনয় ভূষণ মদনমোহন অরবিন্দ ও বারিন্দ্র। এই অরবিন্দই আসলে ঋষি অরবিন্দ।
দত্ত বাড়ির সংস্পর্শে এসে বহু মানুষের জীবন বদলে গিয়েছে। দত্ত বাড়ির লোকেদের নামে কলকাতায় এখনো বহু রাস্তা রয়েছে। মদনমোহন দত্ত লেন, কাশীনাথ দত্ত রোড, দত্তদের কীর্তিকথারই পরিচয় দেয়। দত্ত বাড়ির ছেলে প্রাণনাথ দত্ত। ১৮৭৬ সালের ৩১শে মার্চ কলকাতা পুরসভার প্রথম নির্বাচনে প্রথম নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে প্রাণনাথ দত্ত ছিলেন একজন। বাংলার প্রথম কার্টুন পত্রিকা বসন্তকের সম্পাদক ছিলেন তিনি।
মদনমোহন দত্ত লেন ও মোহাম্মদ রমজান লেনের মোড়ের বিরাট শিবলিঙ্গ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মদনমোহনের ছেলে রশিদ লাল ও হরলাল দত্ত। এই দুর্গেশ্বরে মন্দিরের শিবলিঙ্গ বনেদি কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য বিষয়। এই শিবের মাথায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে জল ঢালতে হয়। কলকাতা শহরের বুকে অন্যরকম ঐতিহ্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে এই দত্ত বাড়ির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্রঃ-বনেদি কলকাতার ঘরবাড়িঃ- দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়