প্রথম কমার্শিয়াল থিয়েটারের পত্তন হয়েছিল রবীন্দ্র সরণির এই ‘ঘড়িওয়ালা’ বাড়িতে

উত্তর কলকাতার লাল রঙের একটা পুরনো বাড়ি। সময় বয়ে গেছে জলের থেকেও দ্রুতগতিতে। এই বাড়ি যেন সময় ধরে রাখার আধার। মাঝে মাঝেই বাড়িটাতে বেজে ওঠে টুংটাং ঘড়ির শব্দ। কোন ঘড়িরই বয়স সমসাময়িক নয়। তাই ঘড়ির নামগুলো ভারী অদ্ভুত। গ্র্যান্ডফাদার ক্লক থেকে তিনি, মিনি অ্যান্টিক নানা নাম নিয়ে তারা আগলে রাখছে রবীন্দ্র সরণির এই পুরনো বনেদি বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে এটি পরিচিত ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ নামে।

ঘড়িওয়ালা বাড়ি
বাড়িটির পুরনো ঠিকানা ৩৬৫ নম্বর আপার চিৎপুর রোড। বর্তমান ঠিকানা ২৭৯ নম্বর রবীন্দ্র সরণি। এই বাড়ির বর্তমান মালিক মল্লিক পরিবার। স্থানীয় লোকেরা আগে বলতেন মল্লিক বাড়ি। ঘড়ির এমন সম্ভার দেখে এই বাড়ির নাম পরিবর্তন করেন তাঁরা। নাম হয় ‘ঘড়িওয়ালা মল্লিকবাড়ি’। বাড়িটির ছাদে রাস্তার ধার ঘেঁষে বসানো কুক এন্ড কেলভির পুরনো আমলের বড় গোল ঘড়িটি বাড়িটির নামের জন্য দায়ী।

Read Also :  ওজন বাড়ছে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার


প্রকৃতপক্ষে এই বাড়ির মালিক ছিলেন মধুসূদন সান্যাল। এই বাড়ির বাইরের মহলের উঠোনে মাসিক ৪0 টাকা ভাড়া দিয়ে কলিকাতা ন্যাশনাল থিয়েটার সোসাইটি টিকিট বিক্রি করে এই শহরে প্রথম কমার্শিয়াল থিয়েটারের পতন করেছিলেন। ১৮৭৬-৭৭ সাল নাগাদ মধুসূদন সান্যাল এর কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন আশুতোষ মল্লিক। মালিক মল্লিক পরিবার হলেও লোকেদের কাছে এটি সান্যাল বাড়ি নামে পরিচিত ছিল বহুদিন। মালিক বদলালেও পুরনো প্রচলিত নাম বাড়িটির গা থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিলেন না মল্লিক পরিবার। তাই বাড়ির রূপ বদল করেন। একটি বড় গোল ঘড়ি বসিয়ে দেন। তা থেকেই নাম হয়ে যায় ঘড়িওয়ালা বাড়ি। কালের প্রহরী সেই ঘড়ি আজও চলছে। সকলকে আশ্চর্য করে দিয়ে খারাপ হয়নি এখনও।

Ghoriwala mallick bari
মধুসূদন সান্যাল-এর পিতা শিবরাম সান্যাল ছিলেন কলকাতা শহরের এক বস্ত্র ব্যবসায়ী। আন্দুলের রাজা, রামচন্দ্র রায়ের বাড়ির উল্টো দিকে তিনি এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। রামচন্দ্র রায়ের বাড়িটি কেনেন হীরেন শীল। তাঁর কাছ থেকে পরে বাড়িটি কেনেন প্রদ্যুম্ন মল্লিক। এখন সেখানে লোহিয়া মাতৃসদন। শিবরাম মারা যাওয়ার সময় বহু নীলকুঠি, জমিদারি ও বাড়িঘর ছেলে মধুসূদনকে দিয়ে যান। জোড়াসাঁকোর এই বাড়িটিতেই প্রথম টিকিট বিক্রি করে বাংলার প্রথম নাট্যশালা গড়ে ওঠে।


কলিকাতা ন্যাশনাল থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটির কথা বলার আগে অ্যামেচার থিয়েটারের কথা জানা দরকার।


১৮৭৩-এর ৮ মার্চ এই বাড়িতে ন্যাশনাল থিয়েটারের শেষ অভিনয়ের আসর বসেছিল। অভিনীত হয় দুটি নাটক। 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', 'যেমন কর্ম তেমনি ফল' এবং 'কিছু প্যানটোমাইম'। ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রথমে শুধু শনিবারেই অভিনয় হত। পরে বুধবারেও। বাংলা পেশাদার থিয়েটার এর ক্ষেত্রে এই ঘড়িওয়ালা বাড়ি একটি রেকর্ড সৃষ্টিতে সাহায্য করে।


আশুতোষ মল্লিক বাড়িটি কেনার পর ম্যকিংডস বার্ণ কোম্পানিকে দিয়ে বাড়ির চেহারা ফেরান। এই বাড়ির ঠাকুরদালানে প্রথম অভিনীত হয়েছিল নীলদর্পণ নাটকটি। আশুতোষ মল্লিক-এর আদি বাড়ি দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট। আশুতোষ এর চার ভাই গোবিন্দ লাল বনমালী ও মতিলাল। তাঁরা প্রত্যেকেই শিল্পের কদর করতেন। মতিলাল মল্লিক নানা শিল্পদ্রব্য ঘড়ি সংগ্রহ করে জমা করেছিলেন এই বাড়িতে।


অন্যান্য বনেদি বাড়ির মত রবীন্দ্রসরণির ঘড়িওয়ালা বাড়ি ও নানার শরিকের মধ্যে বিভক্ত। একটি অংশে থাকেন গোরাচাঁদ মল্লিক। তিনি মতিলালের নাতি। এই বাড়িতে চেহারা বদল শুরু হলেও তা শেষ করা সম্ভব হয়নি আর। কিছু নবীকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল। কলকাতার ধনী সুবর্ন বনিক পরিবার
গুলির মধ্যে এই পরিবার অন্যতম। নীলদর্পণ নাটকের প্রথম পেশাদারী অভিনয় বা প্রথমবার কমার্শিয়াল থিয়েটার শুরু হওয়ার নিরিখে এই বনেদি বাড়ির গুরুত্ব ও ইতিহাসের পাতায় অপরিসীম।


তথ্যসূত্র:- বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি-দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
ক্যালকাটা থেকে কলকাতা-গৌতম বসু মল্লিক

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...