কীভাবে গড়ে উঠল আজকের ঝামা পুকুর রাজবাড়ি?

কোন্নগরের বিখ্যাত মন্দির-বাটি মিত্র পরিবারে ১৮১৮ সালে (মতান্তরে ১৮১৭ সাল) দিগম্বর মিত্রের জন্ম। জন্মসূত্রে ব্যবসায়ী পরিবারের একজন সদস্য হলেও প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন শিক্ষক। পরবর্তীকালে যদিও কেরানি, তহশীলদার এবং এস্টেট ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কিন্তু পরিবারের ব্যবসার রীতি তাঁর মধ্যেও ছিল প্রবল। ধীরে ধীরে ব্যবসার দিকেই পা বাড়ান তিনি। নিষ্ঠা এবং অধ্যাবসায় থাকলে প্রতিষ্ঠা অর্জনে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এ কথাই প্রমাণ করেছিলেন দিগম্বর মিত্র। চাকরি নয় এই ব্যবসাই তাঁকে এনে দিয়েছিল প্রতিপত্তি। ঝামাপুকুর রাজবাড়ি তাঁরই প্রতিষ্ঠা করা কলকাতার অন্যতম বনেদি বাড়ি।

 

দিগম্বর মিত্রের পিতামহ রামচন্দ্র মিত্র ছিলেন একটি সদাগরী প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার। মারা যাওয়ার সময় পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন তার তিন ছেলে শিবচন্দ্র, শম্ভু চন্দ্র ও রাজ কৃষ্ণের নামে। এই শিবচন্দ্রের ছেলেই ছিলেন দিগম্বর মিত্র।

 

দিগম্বর ও রামতনু লাহিড়ী ১৮২৭ সালের একই দিনে ভর্তি হয়েছিলেন হেয়ার স্কুলে। তারপর তারা দুজনেই ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। সেখানে তারা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ডিরোজিওকে। ডিরোজিওর ভাবনা তাঁর শিক্ষকতার জীবনে প্রভাব ফেললেও দিগম্বর মিত্রের উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা করা।

 

১৮৮৪ সালে তিনি কলকাতা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে যান। সেখানে স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার চাকরি নেন। পরে তিনি রাজশাহীর জেলাশাসক ও সমাহর্তার হেডক্লার্ক হিসেবে নিযুক্ত হন। ক্রমে সরকারি খাস মহলের তহশীলদার, আমিন প্রভৃতির নানা ধরনের চাকরি তিনি করেছেন। শেষে কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথের সেরেস্তায় মাসিক ১০০ টাকা বেতনের চাকরি করেছিলেন তিনি। পরে তিনি কাশিমবাজার এস্টেটের ম্যানেজার হয়েছিলেন। নাবালক কৃষ্ণনাথের যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি তিনি দেখাশোনা করতেন। তার কাজে খুশি হয়ে কৃষ্ণনাথ তাকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। বিশ্বনাথের কাজ ছেড়ে তিনি নীল ও রেশম ব্যবসা শুরু করেন পরে।

 

নিজের চেষ্টায় এবং বুদ্ধিমত্তায় মুর্শিদাবাদের চারটি জায়গায় গড়ে তুলেছিলেন রেশম কুঠি। ১৮৪৭ সালে এই ব্যবসায় তাঁকে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। এরপর দিগম্বর মিত্র কলকাতায় ফিরে এসে ‘স্টক ডিলিং’-এর কাজ শুরু করেন। আগের ব্যবসার ক্ষতি থেকে শিক্ষা নেন তিনি। জমিদার হয়েছিলেন। তিনি তৈরি করেছিলেন এক নম্বর ঝামাপুকুর লেনের জমিদার বাড়ি। পরবর্তীকালে এই বাড়িটিকে রাজবাড়ী হিসেবেই সকলে চিনতে শুরু করে। এই বাড়ির যতটুকু অংশ বেঁচে রয়েছে তাকে লোকে ঝামাপুকুর রাজবাড়ি হিসেবেই চেনে। এই বাড়ির অনেকটা অংশই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ফলে বাড়ির চেহারাও গেছে পাল্টে। রাধাকৃষ্ণের ঠাকুরদালানটি একমাত্র এই বাড়ির অটুট অংশ হিসেবে টিকে রয়েছে। রিলিফের কাজে অলংকৃত ঠাকুর দালানটি অতীত সমৃদ্ধির কিছুটা পরিচয় দেয়।

 

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে দিগম্বর মিত্রের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ব্যবসা করে দিগম্বর মিত্রের যে আর্থিক প্রতিপত্তি সমাজে তৈরি হয়েছিল তার ফলে তৈরি হয়েছিল তাঁর সামাজিক প্রতিপত্তি।

 

পরবর্তীকালে তিনি ভারত সভার সহ-সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে সভাপতি। ইংরেজ শাসকদের কাজ যে সময় তার মনঃপূত হয়নি তখনই তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। ব্রিটিশ শাসক উডের শাসন পরিকল্পনার বিরোধিতাও করেছেন। ১৮৭৪ সালে তিনি কলকাতার প্রথম বাঙালি শেরিফ হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তার আগে যদিও বিভিন্ন সভা ও কমিশনে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

 

ব্যবসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিপত্তি থাকলেও তিনি মানুষ হিসেবে রক্ষণশীল ছিলেন। বহুবিবাহ প্রথা রদ এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন -এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ১৮৭৯ সালের ২০ এপ্রিল দিগম্বর মিত্র মারা যান। তাঁর ছেলে গিরিশচন্দ্র আগেই মারা গিয়েছিলেন। গিরিশচন্দ্রের দুই ছেলে। মন্মথনাথ ও নরেন্দ্রনাথ। পিতার স্মৃতি রক্ষায় তাঁরা গিরিশচন্দ্র মিত্র দাতব্য ঔষধালয় খুলেছিলেন। বেতন দিয়ে কবিরাজও রেখেছিলেন সেখানে। পরবর্তীকালে মিত্র পরিবার ঝামা পুকুর ছেড়ে চলে আসেন শ্যাম পুকুরে। এখানে এক ব্যারিস্টারের একটি বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। কিন্তু কলকাতার ঝামা

পুকুর রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস আজও মানুষ ভোলেনি।

 

তথ্যসূত্র:-

বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি-দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

ক্যালকাটা থেকে কলকাতা- গৌতম বসু মল্লিক

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...