শোভাবাজার রাজবাড়ির এই অংশটি বাঘওয়ালা বাড়ি নামেই পরিচিত

লোকে বলে বাঘওয়ালা বাড়ি। জনশ্রুতি মিলিয়ে বাঘের দেখা পাওয়া যায় না। শোভাবাজার রাজবাড়ির এই বিশেষ অংশের ঠিকানা ৩৫ রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট। মহারাজা নবকৃষ্ণের সিংহ দরজাশোভিত এই প্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অন্যরকম ইতিহাস। তেরো বিঘে ছ'কাঠা পাঁচ ছটাকের কিছু বেশি জমির ওপর তৈরী এই প্রাসাদ ইতিহাসের পান্ডুলিপি। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর নবকৃষ্ণ এই প্রাসাদটি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। এটি আসলে শোভারাম বসাকের তৈরি প্রাসাদ। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয় লাভের পর তাঁরা নবকৃষ্ণের প্রতি খুশি হয়ে এটি তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। নবকৃষ্ণ এর সঙ্গে যোগ করেন নহবতখানা, দেওয়ানখানা, নাচঘর, লাইব্রেরি তোশাখানা। নকশা দিয়ে এই প্রাসাদের প্রত্যেকটা ঘর, বারান্দা সাজানো হয়। এই বিশাল প্রাসাদের দরজায় ছিল সিংহের মূর্তি। এই সিংহের মূর্তি দুটি ক্ষতবিক্ষত। মাথার চুলে ঝরে পড়ার মতো সিংহের কেশর ঝরে গেছে। তাই লোকে এখন ভুল করে বলেন বাঘওয়ালা বাড়ি।

মহারাজ নবকৃষ্ণ এই প্রাসাদটি নবীকরণ করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ২৩৫ বছর আগে। প্রাসাদে সাজিয়ে তুলতে তিনি কোন অর্থকার্পণ‍্য করেন নি। দেওয়ান-ই-খাস এবং দেওয়ান-ই-আমের অনুসরণে দিল্লি থেকে কারিগর এনে তৈরি করিয়েছিলেন দেওয়ান খানা। জয়পুরের বিখ্যাত কাঠমিস্ত্রিরা এই প্রাসাদটির কাঠের কাজ করেছিলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির বিশাল অট্টালিকার সঙ্গে যুক্ত থাকা এই প্রাসাদটি এক অন্যরকম ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। এই প্রাসাদ এবং রাজা নবকৃষ্ণের উত্থানের ইতিহাস প্রায় একইসঙ্গে লেখা হয়েছে। রাজা নবকৃষ্ণের বাবা রামচরণ দেব মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে নবাব সেরেস্তার কাজ করতেন বলে শোনা যায়। রামচরণ দেবের কাজে খুশি হয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ তাকে কটকের দেওয়ান নিযুক্ত করেন। তিনি মেদিনীপুরের এক জঙ্গলে মারাঠা দস্যুদের হাতে নিহত হন।

রামচরণের তিন ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন নবকৃষ্ণ। ছোট থেকেই নবকৃষ্ণ উৎসাহী এবং মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মায়ের চেষ্টায় এবং অনুপ্রেরণায় তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা শিখেছিলেন। পরে ইংরেজি ভাষাও রপ্ত করেছিলেন। কলকাতার নতুন বাজারে সে সময় এক ধনকুবের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিদের টাকা ধার দিতেন। নবকৃষ্ণ এই ঋণ প্রদানকারী নকু ধর-এর কাছে চাকরির জন্য গিয়েছিলেন। সুযোগ এসে যায়। নবকৃষ্ণের বুদ্ধি, ভাষা জ্ঞান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। তাঁকে কোম্পানির মুনসি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে পলাশীর যুদ্ধের পর এই নবকৃষ্ণকে দেওয়া হয়েছিল এই বাঘওয়ালা বাড়ি অর্থাৎ নবকৃষ্ণের রাজবাড়ি। নবকৃষ্ণের কাজে খুশি হয়ে ইংরেজ সরকার তাঁকে রাজ বাহাদুর উপাধিও দিয়েছিলেন।

রাজা নবকৃষ্ণের এই প্রাসাদের গঠনরীতিতে এক আশ্চর্য ও চমৎকার গাম্ভীর্য লক্ষ করা যায়। রাজকীয় গাম্ভীর্য। সিংহ দরজা, সারি সারি থাম, দেউড়ি এসব কিছুর ভেতর ইতিহাস গমগম করেছে। নবকৃষ্ণ যে সময় এই প্রাসাদ টি পুনর্নির্মাণ করেন সেখানে পাশাপাশি ঘর থেকে অনুভূমিক স্থাপত্য কলার নিদর্শন পাওয়া যায়। বর্তমানে হাই রাইজ বা উল্লম্ব অর্থাৎ বিশাল অট্টালিকা তৈরীর রেওয়াজ সে সময় ছিল না। ঐতিহাসিকদের মতে দেওয়ান-ই আম এবং দেওয়ান-ই খাসের অনুকরণে এই প্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছিল।

রাজা নবকৃষ্ণের জীবনের ইতিহাসের সাক্ষী এই পুরো বাড়িটি। শোভাবাজার রাজবাড়ীর রক্ষনাবেক্ষণের সঙ্গে এই প্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

ঐতিহাসিক এই রাজপ্রাসাদের আরেকটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ নাম রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর। রাজা নবকৃষ্ণের বড়দাদা রামসুন্দরের ছেলে গোপীমোহন দেবের পুত্র রাধাকান্ত সংস্কৃত এনসাইক্লোপিডিয়া শব্দকল্পদ্রুম প্রণেতা। এই প্রাসাদের আলোয় তিনি লিখেছিলেন শব্দকল্পদ্রুম। জীবনের নীতিকথা। তাঁর এই বিশেষ প্রাসাদ ইতিহাসের পাতায় আজও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।

তথ‍্যসূত্রঃ-১.
২. বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি- দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...