সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আড়িয়াদহ থেকে সুতানুটিতে এসেছিলেন এক ব্যবসায়ী জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। কীভাবে তিনি প্রথম সুতোর ব্যবসা এখানে শুরু করেন তা নিয়ে কোন নির্দিষ্ট তথ্য ইতিহাসে নেই। তবে তিনি ব্যবসায়ী পরিবারের একজন সদস্য ছিলেন এবং তার উত্তরসুরিরাও পরবর্তীকালে ব্যবসায়ী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। যেমন দুর্গাচরণ মিত্র। জগন্নাথপ্রসাদের বড় ছেলে কৃষ্ণকিংকরের তৃতীয় পুত্র দুর্গাচরণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনা আবগারি মহলে একচেটিয়া ব্যবসা করতেন। তমলুকে তিনি নুনের দেওয়ানের কাজও করতেন। নবাব সিরাজদৌল্লার কোর্ট জুয়েলের হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯ নম্বর নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের এই অট্টালিকা, ঠাকুরদালান দেখে কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে, কতটা অর্থবান ছিলেন এই মিত্র বাড়ি।
এই দুর্গাচরণের আরেকটি বাড়ি ছিল গরানহাটায়। এখানে এক মুহুরী থাকতেন। দুর্গাচরণের সেরেস্তার খাতায় অনেক গান লিখে তিনি ভক্ত কবি হিসেবে পরবর্তীকালে স্বনামধন্য হয়ে ওঠেন। ১৭৫২ বা ১৭৫৩ সালে হিসেবের পাকা খাতায় ওই ভক্তকবি যে গান লিখেছিলেন তা পরবর্তীকালে বাঙালির অন্যতম সম্পদ হয়ে ওঠে।
"আমায় দাও মা তবিলদারি
আমি নিমকহারাম নই মা শংকরী।"
ভক্ত কবি রামপ্রসাদকে এভাবেই দুর্গাচরণের সেরেস্তায় প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন দুর্গাচরণ নিজে। হিসেবের খাতায় এমন গান লিখেছিলেন বলে যখন সেরেস্তার বাকি কর্মীরা রামপ্রসাদের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে, দুর্গাচরণ নিজে তাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন।
মিত্র বাড়ির বর্তমান ঠিকানা উনিশ নম্বর নীলমণি মিত্র স্ট্রিট। এই নীলমণি মিত্র স্ট্রিটেই ছিল দর্জি পাড়া লেন। ‘দর্জিপাড়া’ নামটি এসেছে অনেক পরে। শহর কলকাতার ইতিহাসের গোড়ার দিকে এই অঞ্চলটিকে ‘শিমুলিয়া’ বলা হত। বর্তমানে এই ‘শিমুলিয়া’ নামটি আর পরিচিত নেই। একসময় এখানে বহু দর্জি বসবাস করতেন বলে পরে এর নাম হয় ‘শিমুলিয়া দর্জিপাড়া’। এই শিমুলিয়া দর্জি পাড়ার দক্ষিণ পশ্চিম অংশটি ‘গরানহাটা’ নামে পরিচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিমুলিয়া দর্জি পাড়া থেকে শিমুলিয়া বাদ গিয়ে পড়ে থাকে শুধুমাত্র দর্জিপাড়া। যদিও ওখানে দর্জিরা এখন আর বাস করে না। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে দর্জিপাড়ার দু একটি রাস্তার নাম দেখলেই বোঝা যায় এটি একসময় কলকাতার বিখ্যাত দর্জিদের অঞ্চল ছিল। যেমন একটি রাস্তার নাম ‘গুলু ওস্তাগর লেন’। সেখানে থাকতেন জনৈক লাল ওস্তাগর। এই নামটি পরে বদলে রাখা হয় ‘অবিনাশ মিত্র লেন’।
দুর্গাচরণের পঞ্চম পুত্র তারিণীচরণকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দুস্তানি বিভাগের প্রধান মুনসি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখার জন্যই প্রধানত লর্ড ওয়েলেসলির চেষ্টায় এই বিভাগটি তৈরি করা হয়েছিল। এই বিভাগের অফিস ছিল রাইটার্স বিল্ডিং-এ। স্কুল বুক সোসাইটির সঙ্গেও তারিণীচরণ যুক্ত ছিলেন। তারিণীচরণের বংশধর ছিলেন স্যার ব্রজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি ছিলেন বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল বড়লাটের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের আইন সদস্য ও ভারতের অ্যাডভোকেট জেনারেল। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বরোদার দেওয়ান হয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য যে গণপরিষদ করা হয়েছিল তিনি সেখানে বরোদা রাজ্যের প্রতিনিধি ছিলেন।
দর্জি পাড়ার মিত্র পরিবারে এমন অজস্র গুণী মানুষের জন্ম হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা সূত্রে যুক্ত থেকেও যখনই দরকার হয়েছে তখনই তারা কোম্পানির বিরোধিতা করেছেন। এভাবেই কলকাতার ইতিহাসে এই পরিবার একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় রয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি- দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়