সময়টা আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগে। আরামবাগের জমিদার বাবুরাম সরকার দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তাঁর ইচ্ছে সকল প্রজারা এই পুজোর প্রস্তুতিতে হাত লাগাবেন। সকলের মিলিত প্রয়াসেই সেজে উঠবে দুর্গাপুজো। এই ইচ্ছের কথা ঘোষিত হল। পুজোর দিন দেখা গেল পুরুত মশাই অনুপস্থিত। জমিদারমশাইয়ের কপালে ভাঁজ। কীভাবে হবে পুজো? কিন্তু হঠাৎ করে সকালবেলায় পুরুতমশাই এলেননাই বা কেন? রাজার দূত গেল পুরুতের বাড়ি।
জমিদার বাবুরাম সরকারের কথায় যাঁরা পুজোর জোগাড় করতে এসেছিলেন তাঁরা ততক্ষণে নিজেদের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু বাকি কাজ সঠিক সময়ে সম্পন্ন হলেও পুরুতমশাই আর আসেন না। জমিদার মশাইয়ের কথায় দূত গেলেও তিনি ফিরে এলেন খালি হাতে। যে পুজোর কাজ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষরা করেন, সেই পুজো করবেন না পুরুত মশাই। এই বার্তা নিয়েই ফিরে আসেন জমিদারমশাইয়ের দূত। আরামবাগ অঞ্চলের ওই জমিদারীর অধিকাংশ প্রজাই ছিলেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। তাঁরাই সেদিন পুজোর কাজ করেছিলেন। তাই জমিদারমশাইয়ের কথায় পুরোহিত আসেনি সেদিন। তবে পুজো থেমে থাকেনি। শাঁখের আওয়াজে নয়, নামাজের সুরে সেদিন শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো।
সেদিনের সেই শুরু হওয়া থেকে শুরু করে আজও নামাজের আওয়াজেই শুরু হয় হুগলীর আরামবাগের সরকারবাড়ির দুর্গাপুজো।
জমিদার বাবুরাম সরকারের তৈরী করা এই প্রথা মেনেই আজও পুজো হয় আরামবাগের সরকারবাড়িতে। সপ্তমীর দিন শুধু নয়, অষ্টমী, নবমীর পুজো হয় নামাজের সুরে। জমিদারমশাই চেয়েছিলেন শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী নয়, সকল ধর্মের মানুষের উদযাপনের কারণ হোক দুর্গোৎসব।তাই শুরু করেছিলেন ওই প্রথা।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ-চারশো বছর আগের ওই সময়ে সমাজের রক্ষণশীলতার, জাতিভেদপ্রথার গণ্ডি পেরিয়ে এগিয়ে এসেছিল সরকারবাড়ির এই পুজো। এই ভাবনার সুর আজও বিদ্যমান আরামবাগের প্রাচীনতম পুজোয়।
ক্ষয়িষ্নু সমাজের অস্থির সময়ে এই নিদর্শন অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। সম্প্রীতির বার্তাবহ।
আরামবাগে এখনও দুর্গাপুজোর সময় এলেই, কাশফুলের ভিড়ের মাঝে উৎসবের সুর জেগে ওঠা মানে নামাজের সুর আর শাঁখের আওয়াজ মিশে যাওয়া।