দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে জন্ম হয়েছিল সিপাহী বিদ্রোহের

ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে, যা পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। পলাশীর যুদ্ধকে মহাবিদ্রোহ বলা যায় না। পলাশীর যুদ্ধেও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন মিশে ছিল। সেই আন্দোলনও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে  ছিল। যদিও এছাড়াও বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলন বা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ভারতবর্ষে। তবে সেই সব আন্দোলন হয় নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল নইলে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি সহজে দমন করতে পেরেছিল। তবে যে মহাবিদ্রোহের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ব্রিটিশ শক্তিকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল তা হল সিপাহী বিদ্রোহ। অনেক ঐতিহাসিকই এই সিপাহী বিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহ হিসেবে আখ্যা দেন।

১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে সূচনা হয়েছিল এই বিদ্রোহের। ‌ প্রথম সূচনাস্থল ছিল ব্যারাকপুর, তারপর মিরাট। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের এই মহাবিদ্রোহের ফলে।

প্রাথমিকভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুঃশাসন ও নির্যাতনের শিকার দেশীয় সিপাহীরা এই বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। সেখান থেকেই এই বিদ্রোহের নাম হয় সিপাহী বিদ্রোহ। পরবর্তীকালে তা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক বছর কাল স্থায়ী হয়েছিল এই বিদ্রোহ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচার চলতো নিত্যদিন। নানান ক্ষেত্রে মানুষরা নিপীড়িত হতো। বঞ্চনার শিকার হতে হতে দেয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছিল তাদের। এর ফলস্বরূপ সংঘটিত হয়েছিল এই বিদ্রোহ।

বিপ্লবী জনতা ব্রিটিশ শাসনকে অগ্রাহ্য করে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতবর্ষের প্রধান শাসক হিসেবে চিহ্নিত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আঁতে ঘা লেগেছিল। তাই ছোট্টভাবে শুরু হওয়া সিপাহী বিদ্রোহ মহাবিদ্রোহের আকার নিয়েছিল।

তবে এই বিদ্রোহ বহু বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-এর ফলেই জন্ম নিয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে শাসন শুরু করার পর থেকেই নানা অত্যাচার শুরু হয়েছিল। যেমন নীল চাষের ক্ষেত্রে কৃষকদের বাধ্য করা, এছাড়াও দেশীয় রাজকর্মচারীদের নির্বিচারে ছাঁটাই এবং বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করা চলতে থাকে।

 ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্যদের চাকরি দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। প্রথম দিকে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী এই বিষয়টা বুঝতে না পারলেও পরে তারা ধীরে ধীরে ব্রিটিশদের বৈষম্যমূলক আচরণ বুঝতে পারে। সেই সময় ব্রিটিশ নিয়ম অনুসারে কোন ইংরেজ অফিসার হেঁটে গেলে হাতের রাইফেল উঁচু করে ধরে তাদের সম্মান জানানোর নিয়ম ছিল সিপাহীদের। সেখানেও ছিল বৈষম্য। ভারতীয় কোন অফিসার হেঁটে গেলে ব্রিটিশ সৈন্যরা কোন ধরনের সম্মান প্রদর্শন করত না কিন্তু উল্টোটা হলে ভারতীয় সৈন্যরা সম্মান প্রদর্শন করতে বাধ্য থাকত।

ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের বেতনের তফাৎ ছিল। সেই সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের যুবকেরাই একসঙ্গে বহাল হত।

সমস্যাটা শুরু হয় ১৮৫৩ সালে। ব্রিটিশ সরকার ক্যালিবার এনফিল্ড ৫৫৭ নামে একটি রাইফেল আমদানি করেছিল। এই রাইফেলের কার্তুজ লোড করতে হলে তা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিতে হতো। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তৈরি করার জন্য এই কার্তুজগুলো তৈরি করা হতো গরু ও শুকরের চামড়া দিয়ে। ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরি এর বিরোধিতা করে এবং এই বন্দুক ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানায়। চাপের মুখে পড়ে যায় ব্রিটিশ সরকার। এই বন্দুক প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কিন্তু করতে বিলম্ব করে ব্রিটিশ সরকার। ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে সিপাহীদের মধ্যে।

এরপরের ঘটনাটি একটি তরুণ সিপাহীকে নিয়ে, যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথমবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা করেছিল।

১৮৫৭ সালের মার্চ মাস। ছুটির দিন। ব্রিটিশরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন নিজেদের রেজিমেন্টে। ব্রিটিশদের  অত্যাচার তখন চরমে। ব্রিটিশ রেজিমেন্টের এক সৈনিক মঙ্গল পান্ডে তখন ব্যারাকপুর ব্যাটেলিয়ানের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ব্রিটিশদের নানা কটুক্তি, হাসাহাসি তার কানে আসছে। ভেতরে ভেতরে প্রতিবাদের আগুন জমেছিল অনেক দিন ধরে।

হঠাৎ সব জড়তা ভেঙে সামনে এগিয়ে যান মঙ্গল পান্ডে। দেশ স্বাধীন করার আহ্বান জানান সকলকে। তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে উৎসাহ দিতে শুরু করেন বাকি সিপাহিদের।

এদিকে ব্রিটিশদের কাছে ততক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে যে এক সিপাহী হঠাৎ করেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তাদের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা আক্রমণ করে মঙ্গল পান্ডেকে। লেফটেন্যান্ট বর্গে মঙ্গল পান্ডেকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি মঙ্গল পান্ডের হাতে প্রাণ হারান। পরবর্তীতে আর এক সার্জেন্ট পাণ্ডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে মঙ্গল পান্ডে তাকেও তাঁর ধারালো খড়্গ দিয়ে ধরাশায়ী করেন। সমস্ত সৈন্যরা ততক্ষণে মঙ্গল পান্ডেকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। যুদ্ধ চলতে থাকে। ব্যারাকপুর সেনানিবাসে ব্রিটিশরা হামলা করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের হাতে নিজের জীবন সমর্পণ করবেন না, এই পণ করেছিলেন মঙ্গল পান্ডে। তিনি আত্মমর্যাদার সঙ্গে আত্মাহুতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারপর তিনি এতে ব্যর্থ হন এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন।তবে সাহসী, বীর মঙ্গল পান্ডে সূচনা করে দিয়ে যান এক বিদ্রোহের।

এই বিদ্রোহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের মিরাট, দিল্লীর মত অঞ্চলে। বাংলাতেও চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকায় এই বিদ্রোহের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ নাগরিকদের হত্যা করে। এরপর বিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল তা ধীরে ধীরে মহা আন্দোলনের রূপ নেয়। এভাবেই সূচনা হয়েছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের। এই সূচনা আসলে ভারতের পরবর্তী আন্দোলনগুলোর উৎসমুখ খুলে দিয়েছিল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...