কথায় বলে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। বাঙালির কাছে সুখী জীবনের ছবি ছিল ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’। কেমন সেই সুখ? ছিপ হাতে বসতে হবে পুকর, বিলের ধারে। দিনের শেষে কাঁধে ছিপ, হাতে ঝোলানো জ্যান্ত মাছ নিয়ে বুক ফুলিয়ে বাড়ি ফেরা। পাড়াপড়শির ঈর্ষা হবে। সেই মাছ রাতে ভাজা খেয়ে, পরদিন সকালে ঝোলে ঝালে খেয়ে বাঙালি গভীর আনন্দ পেত। আহ্! নিজের হাতে ধরা মাছ স্বাদে গন্ধে যে অতুলনীয়। শহরের মানুষ সপ্তাহান্তে নিয়ম করে চলে যেতেন। কখনও বাগানবাড়ির পুকুরের ধারে, কখনও টিকিট কেটে কোনও পাড়াগাঁয়ের বিলের ধারে বসে পড়তেন মাথার ওপর ছাতা বেঁধে। যাকে বলে ‘মৎস্য বিলাস’।
সেই বিলাস আজও রয়েছে। তবে আকারে ছোটো হয়ে এসেছে। সুযোগ, সময় দুটোই গিয়েছে কমে। তবে মাছের টান তো বাঙালির কমেনি এতটুকুও, তাই পুকুর-বিলের বদলে ছুটতে হয় মাছের বাজারে। মাছের বাজার বাঙালির জীবনের অঙ্গ বললেও কম বলা হবে। দিনে একবার ঢুঁ দিলে প্রাণ আইঢাই করে। এই বাজারের কান ভোঁ ভোঁ করা হাঁকাহাঁকি, দরাদরি দিনে একবার না শুনলে মন ভরে না। লেজা, মুন্ডু, কানকো ধরে টানাটানি না করলে দিনটাই মনে হয় বৃথা। নেড়েচেড়ে, টিপেটুপে, উলটেপালটে মাছ কেনবার মধ্যে যে কী তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে তা একমাত্র ‘মেছো বাঙালি’ই জানে।
কলকাতায় মানিকতলা, উল্টোডাঙা, গড়িয়াহাট, শিয়ালদা, যাদবপুর, বাঘাযতীন, বাঁশদ্রোণি, বেহালা, সরশুনা, একটু পাশের বাগুইআটির মাছের বাজার নিজ গুণে, বৈশিষ্ট্যে মহিমাণ্বিত। আরও অনেক রয়েছে। ছোটোখাটো, মেজো সেজো সব মাছের বাজার। স্টেশনের ধারে, বাস টার্মিনাসের গায়ে, পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে, ব্লকে ব্লকে। কেউ চিকন ইলিশে নাম করেছে, কেউ আবার বিখ্যাত ডিমভরা ইলিশে। কেউ আবার ইলিশের পেটি অথবা চিতলের পেটি আলাদা সাজিয়ে রেখেছে। জিভে জল এসে যায়। কোথাও বড় গলদা শুঁড় উঁচিয়ে, কোথা ট্যাংরা নড়ছে, কোথাও হাতের মুঠো থেকে ফসকে যাচ্ছে জ্যান্ত কই। ভোরের মতো সন্ধ্যেবেলাতে বহু জায়গায় সোনালি আলো জ্বেলে রূপোলি মাছের বাজার বসে। বড় রুই মাছের কানকো দপ্দপিয়ে যেন হাতছানি দেয়। এড়ানো কঠিন।
কিন্তু না এড়িয়েও যে উপায় নেই। বাঙালির আধুনিক জীবনে ব্যস্ততা যে আরও বেড়েছে। অনেকেরই থলি হাতে মাছের বাজারে যাবার সময় নেই। কানকো উলটে, পেট মেপে, লেজা নেড়ে মাছ কেনার সময় কই? তাই মাছের বাজার আজ চলে এসেছে অনলাইনেও। হাতে বড়শিও নয়, থলিও নয়। ঘরে বসে অ্যাপ নামিয়েই, লিঙ্কে গিয়ে, সাইটে পৌছে খপ্ করে ধরো। অনলাইনে মাছ বাজারের এখন রমারমা। ’www.jalangi.com’, ‘www.delybazar.com’, ‘www.fishpanna.com’ এর পাশে রয়েছে বিগবাসকেট, স্পেন্সারও। বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে তাজা মাছ। বাজারে গিয়ে পছন্দসই মাছ কেনার মজা না থাক সুযোগ এখানেও আছে। পছন্দের ওয়েবসাইটে ক্লিক করে কী কী মাছ সম্ভারে আছে দেখে নিলেই হবে। চোখের সামনে খুলে যাবে রুই কাতলা থেকে পারশে, পাবদা, ট্যাঙরা, বেলে, তেলাপিয়া, মৌরলা, শিঙ্গি, মাগুর, লটে থেকে সাতসাগর পাড়ের স্যামন, স্কুইডের জগৎ। আছে শুঁটকিও। কী ভাবছেন? দামে বনবে কী? ওজন ঠিক থাকে কী? জলকাদা মাড়িয়ে, অন্য লোকের গোঁত্তা খেয়ে মনের মতো মাছ কিনে বাড়িতে এনেও অনেক সময় দেখা যায় পচা। অনলাইনে এই ঝামেলা নেই। পচা, নষ্ট হলে ফেরত নিয়ে যাবে। দরাদরি নেই বটে, তবে ইলিশ কোথাকার? ওজনই বা কত, এক কেজিতে কটা পারশে হবে সেই বুঝে দাম। ছবি দেখে, সাইজ বুঝে পছন্দ। নো বাজার, নো ঝামেলা হাজার। যাদের বাজারের নেশা নেই, যাদের রাতে ঘুম দেরিতে, তাদের পক্ষী ডাকা সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে থলি নিয়ে ছোটার ঝক্কি পোহাতে হবে না। ওয়ার্ক ফ্রম হোমে দিনরাত এক হয়ে যাওয়া নওজওয়ানদের তাই অনলাইনে রুচি। এমনকি বিশ বছর আগে রিটায়ার করা শঙ্করবাবুও সাতসকালে চোখ রাখছেন মোবাইলের পর্দায়। বাজারে যাওয়া বন্ধ তাতে কী? হাতে মাছের আড়ত। থেকে থেকে বলে উঠছেন ভালো তপশে ছিল। ছেলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপ অন করতে করতে বলে উঠল, দেখো তো ওদের কাছে খয়রা আছে কিনা? ছোট্ট বুবু দাদুকে কানেকানে বলে গেল আমি কিন্তু বড় মাছ ভাজা খাব। দাদু কানেকানেই বললেন, খাবেই তো। জানো দাদু আমাদের দেশে কতরকমের যে মাছ পাওয়া যেত। মোবাইলের পর্দায় তখন কালবাউস থেকে ভাঙ্গন, গুরজালি, সাদা, কালো পমফ্রেট, কাঁকড়া, টুনা, ম্যাকারেলের বাজার। বাঙালির হেঁশেলে এখন দেশি বিদেশিতে মিলেমিশে একাকার। ভাজায়, ঝোলে, ঝালে পাশাপাশি।
বাজার কী হারিয়ে গেল? একেবারেই নয়। তিনিও থাকবেন, ইনিও থাকবেন। অফলাইনে আর অনলাইনে। যেমন একচিলতে ফ্ল্যাটের বারান্দাতেও থাকে টবের গাছ মাথা দোলায়। ও আরো একটা কথা। অনলাইনের মাছ বাজারে কোনো কোনো দিন থাকে ভালো ছাড় যা দেখলে টেনিদাও বলে উঠতো, ‘ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস’ আর পটল দিয়ে শিঙ্গি মাছের ঝোল খাওয়া প্যালা, হাবুল, ক্যাবলারা গলা মিলিয়ে বলে উঠতো, ‘ইয়াক, ইয়াক’।