ফাঁসির মঞ্চে নির্ভয়ে, নির্বিকার চিত্তে রবীন্দ্রনাথের কবিতা উচ্চারণ করেছিলেন এই বিপ্লবী

স্বদেশী দ্রব্য আপন করে নেওয়ার আন্দোলন চলছে তখন। যে কোনও বিদেশি দ্রব্যই বর্জনীয়। এই মন্ত্রেই দেশবাসীকে দীক্ষিত করছেন বিপ্লবীরা।

একটি বিদেশী দ্রব্যের দোকানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন স্বদেশীরা। ইংরেজ পুলিশরা চেয়েও তাদের বাগে আনতে পারছেন না। অসম লড়াই চলছিল স্বদেশী ও ব্রিটিশ পুলিশদের। পুলিশ সুপার হাডসন সাহেব ছিলেন ওখানে। একটি কম বয়সী ছেলেকে বেধড়ক মারছিলেন পুলিশ সুপার। অপরাধ-স্বদেশীদের সমর্থন করা। সাইকেলে করে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক যুবক। একটি কিশোরকে নির্দয় ভাবে বেত দিয়ে মারছে পুলিশ। সাইকেল থামিয়ে পুলিশের কাছে ছুটে যায় সেই যুবক।

হাডসন সাহেবের উদ্দেশে চিৎকার করতে থাকে সেই যুবক। ‘স্টপ ইট! স্টপ ইট! ডু ইউ হিয়ার মি? ইউ হ্যাভ নো রাইট টু বিট হিম’, চমকে ওঠেন হাডসন সাহেব। ইংরেজ পুলিশকে এমন ধমক দেওয়ার সাহস হয় কী করে এই যুবকের!

সেই যুবকের হুমকি শুনে নিজেকে সামলাতে পারেননি পুলিশ সুপার হাডসন। পিস্তল বার করে চিৎকার করে ওঠেন ''গেট লস্ট ইউ ফুল! আদারওয়াইজ আই উইল শুট ইউ ডাউন।''

পুলিশ সুপার জানতেন না ওপাশের যুবকটি নির্ভীক দেশপ্রেমী। অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করে না সে। ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়ানোই তার জীবনের মূল মন্ত্র। পুলিশ সুপারের পিস্তল তাকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে আরও একটু। ছেলেটি তখন নিজের শার্টের বোতাম খুলে এগিয়ে আসে পুলিশ সুপারের কাছে। ''শ্যুট মি! শ্যুট মি হিয়ার! ইফ ইউ আর নট অ্যা কাওয়ার্ড।''

আরও একবার চমকে উঠলেন পুলিশ সুপার। এবার আর এগোনোর সাহস করেননি। কাঁপা হাতে নিজের পিস্তলটা খাপের মধ্যে ভরতে হয়েছিল সেদিন সেই দুঁদে পুলিশ সুপার হাডসনকে। তারপর ওই চত্ত্বর ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন সেদিন।

আর সেই সাহসী যুবক! তার ভেতরে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল, তা আরও অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল।

বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স-এর দীনেশ গুপ্ত এমনই একজন সাহসী, নির্ভীক দেশপ্রেমী ছিলেন।

ঢাকার বিক্রমপুরের যশোলঙ্গ গ্রামে ১৯১১ সালের ৬ই ডিসেম্বর জন্ম দীনেশ গুপ্তর। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল। তবে বিশেষ অনুরাগ ছিল সাহিত্যের প্রতি। দর্শনও ভাল লাগত।  পড়াশোনা করতে করতেই বিপ্লবী দলে নাম লেখায় দীনেশ। আসলে ছোট থেকেই তাঁর মনে হয়েছে, এই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে শুভ হওয়ার জন্য দরকার‌ শুভ শক্তির উত্থান, যার জন্য ইংরেজ সরকারকে এই দেশ থেকে বিতাড়ন প্রয়োজন।

মূলত ঢাকা থেকেই দীনেশ গুপ্ত বিপ্লবী কার্যকলাপ করতেন প্রথমদিকে। কিন্তু তাতে মন ভরত না এই বিপ্লবীর। সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। মেদনীপুরে আসেন তিনি। গড়ে তোলেন সংগঠন। অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন সারাদেশে। দীনেশ গুপ্ত নেতৃত্বের কাছে বারবার অনুরোধ করতেন তাঁকে কোন সশস্ত্র সংগ্রামে পাঠাতে। এমনই আশ্চর্য মানুষ ছিলেন এই দীনেশ গুপ্ত।

বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স-এর রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান খুবই উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের পাতায়। বিনয় বসুর নেতৃত্বে সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন দীনেশ গুপ্ত। এই অভিযানের যোদ্ধা।

রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের পর বাদল গুপ্ত আত্মহত্যা করেন ওখানেই। বিনয় বসু মারা যান হাসপাতালে। সেও একপ্রকার আত্মহত্যাই ছিল। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন দীনেশ গুপ্ত। নিজের চোখে মরতে দেখেছিলেন শ্রদ্ধেয় বিনয়দাকে। আটকানোর চেষ্টা করেননি। তিনি জানতেন বিনয়দা কিছুতেই ইংরেজের কাছে সমর্পণ করবেন না। দীনেশ গুপ্ত নিজেরও ইচ্ছে ছিল না সমর্পণ করার। তবে শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। জেলে বসেও মেদিনীপুরে নিজের সংগঠনের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। তখন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে কোর্টে। হাজিরায় একটা প্রশ্নের উত্তর দেননি। নিজের কর্মযজ্ঞ জেল থেকে বসেই পরিচালনা করতেন তিনি।

চিঠি লিখতে ভালোবাসতেন দীনেশ গুপ্ত। দিদি, বৌদিকে নিয়মিত চিঠি পাঠাতেন। দার্শনিক চিন্তাভাবনা ছিল তাঁর। প্রিয় খুকুদিকে লেখা একটি চিঠিতে ভালোবাসা সম্পর্কে তাঁর অন্তরের কথা তুলে ধরা যায় এ প্রসঙ্গে।

''আমাদের সবচেয়ে মুশকিল হলো কী জানো? আমাদের ভালোবাসার গণ্ডি বড় সংকীর্ণ, বড়ই অল্প পরিসর। একে বড় করতে হবে। পারবে না?

ভালোবাসার সাধনা করতে হয়। স্বার্থ আমাদের বড় জড়িয়ে ধরে। তাই আমরা কিছু পারিনা।''

দীনেশ গুপ্তের বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল রাজদ্রোহের, ষড়যন্ত্রের, হত্যার। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন তিনি। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয় তাঁর।

শুনানির সময় ভাবলেশহীনভাবে দীনেশ দাঁড়িয়ে থাকতেন ‘আসামি’র নির্দিষ্ট কাঠগড়ায়। স্বাক্ষর, সাবুদ সওয়াল-জবাবের পর স্পেশাল ট্রাইবুনালের রায়ে দীনেশ গুপ্তের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। এই রায়ে সারা বাংলার মানুষ সেদিন কেঁদেছিলেন। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে বের হয়েছিল দীনেশের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল।

তবে দীনেশ গুপ্ত মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন মৃত্যুর জন্য। প্রিভি কাউন্সিল থেকে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার জন্য সম্মতিপত্র এসে গিয়েছিল কয়েকদিনের মধ্যেই। ফাঁসির দিন স্থির হয়েছিল ১৯৩১-এর ৭ জুলাই।

ওই দিনে সকালের দিকে দীনেশ স্নান করে সূর্য মন্ত্র পাঠ করে নেন। 'চয়নিকা' ও 'গীতাঞ্জলি' দীনেশ গুপ্তের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। রোজ গীতা পাঠ করতেন তিনি। শান্ত, সমাহিত জীবন যাপন করতেন জেলেও। ধীর, অচঞ্চল ছিলেন মৃত্যুদন্ডের দিনেও। নির্বিকার চিত্তে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত চলে যান। ফাঁসির মঞ্চে উঠে দড়িতে গলা দেওয়ার আগে অনেকদিন পর চিৎকার করে ওঠেন, ‘’বন্দেমাতরম! বন্দেমাতরম!”

 জেলের বাইরেও অগণিত মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তবে নির্বিকার ছিলেন দীনেশ গুপ্ত। একটু একটু করে মৃত্যুর পথে ঢলে পড়বেন তিনি। তার আগে উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

 

''ওই যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি,

বুকের মাঝে শুনছো কি সেই ধ্বনি।

রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ,

গাইছে না মন মরণজয়ী গান?''

 

হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার। একটা আগুনের শিখা দপ করে নিভে গেল যেন। তবুও কোথাও যেন ভেসে চলেছিল শেষের সুর। স্বাধীনতার জয়গাথায় যে সুর মিশে রয়েছে আজও, একইরকমভাবে...

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...