‘ এ যেন কবিগুরুর কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশে একটি পাথরের ঢিবি। কিন্তু সে পাথর এতই ঝকঝকে, তার ভিতর থেকে এমনি আলো ঠিকরোয় যে মন বলে হীরে নয় তো!’
এই উক্তি অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। ১৯৬৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় অবনীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন লীলা মজুমদার।
তাঁর কাছে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ আর সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ মিলেমিশে গিয়েছিলেন। দুই সত্ত্বা মিলিয়ে রূপকথার একক ঈশ্বর। তবে লীলার চোখে তিনি ঈশ্বর নন, তিনি এক জাদুকর। ছোট বেলার পরী মহলে যাকে দেখা যায়। হাতে জাদু কাঠি। ছোঁয়ালেই সব রঙিন। অবন জাদুকর এমন জাদুকর যিনি মুখটি খুললেই মনের নাড়ির ওপর জাদুকরী আঙুলটি এসে পড়ে। একেবারে মনের অন্দর মহলে। যেখানে সুখ-পরী আর দুখ-পরীদের বাস।
কথার সহজ ছন্দে, মায়ার বুননে অবন ঠাকুর এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কথা বলতে গিয়ে লীলা মজুমদার বলেন, 'যে কথা তাঁর রঙ তুলি বলে শেষ করতে পারেনি, কাগজের ওপর আঁচড়ে সেই কথাই ফুটে বেরিয়েছে।'
তিনি ছবি লিখতেন। কথা আঁকতেন। আশ্চর্য নেশা জাগায় তাঁর লেখা। ভাব যদিও তাঁর ছোটদের সঙ্গেই। তাই নিজের ‘লেখা খাতা’ তাদেরকেই দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
রবিকাকার জন্য তাঁর লেখার শুরু। বয়স তখন একুশ কি বাইশ। নিজের লেখা শুরুর গল্প বলেছেন ‘ জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে। রবিকাকা বলেছিলেন, ‘ তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে গল্প কর তেমনি করেই লেখো’
অথচ নিজে ভেবেছিলেন লেখা তাঁর দ্বারা কস্মিনকালেও হবে না। অভয় দিলেন রবি ঠাকুর। “তুমি লেখোই-না, ভাষার কিছু দোষ হলে আমিই তো আছি”
সেই জোরেই লিখে ফেললেন ‘ শকুন্তলা’। পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ হতে গেলেন কবির কাছে। আগাগোড়া ভালো করে পড়লেন তিনি। কোথাও থামতে হল না। শুধু একটি শব্দের কাছে থেমে গেলেন। ‘পল্বলের জল’। সংস্কৃত শব্দটি কাটতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কলম ফিরিয়ে নিলেন।
অবন ঠাকুরের লেখার শুরুটা এভাবেই। লেখার দীক্ষা রবিকা’র কাছে। কিন্তু তাঁর লেখায় একটা শব্দেও রবীন্দ্র প্রভাব পড়েনি কোনদিন।
তিনি রূপকথার রাজা। কল্পনার পক্ষীরাজ উড়ান দিয়েছে যেমন ইচ্ছে। তার গায়ের রঙটি মর্ত্য-মাটির রঙে রাঙানো তাই উড়াইল বন বা জোড়াসাঁকোর ধার কোথাও হারিয়ে যেতে মানা ছিল না। যেমন ইচ্ছে সে উড়ান দিয়েছে শব্দে লেখায়। প্রত্যেকটি ছবি আলাদা আলাদা শিল্প সৃষ্টি।
শিল্পের মর্ম কথা যে ভাবে সহজ ও সরস ভঙ্গিতে তিনি বলতেন, তেমন ভাবে আর কেউ পারেনি। দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে।
লীলা মজুমদারের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির মূল সুরটি কিন্তু অবন ঠাকুরের সহজ কথার সুরেই বাঁধা। জল হাওয়া বাতাস মেঘ আর সহজিয়া মানুষ নিয়ে। যা ছোটদের হয়েও ছেলেবেলা ভুলে যাওয়া বড়দের। ঘোর লাগায় একই টানে। সবই ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া গান।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধবলী’ অনুবাদ করেছিলেন লীলা মজুমদার। তাঁর লেখা ‘ ছোটদের অমনিবাস’ বইটির সম্পাদনাও তিনিই করেন। সম্পাদিকার নিপুণ যত্ন দেখা গিয়েছিল সংকলনে। রূপ কথার জাদুকরের প্রতি আজীবনের মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছিল এই সব কাজের মধ্যে দিয়েই।
এক সাক্ষাৎকারে লীলা মজুমদার একবার বলেছিলেন, ‘ আমার গোটা ছোটবেলাটা আমি ছোটদের উপহার দিতে চাই’
অগ্রজ আর অনুজা মিলে গিয়েছিলেন শিশুদের কাছে। এভাবেই।
(তথ্য ঋণ: জোড়াসাঁকোর ধারে: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী চন্দ
আপনকথা: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অবনীন্দ্রনাথ: লীলা মজুমদার)