স্মৃতির সাক্ষীবাহী মহাপ্রাচীর

পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মানব স্থাপত্যের নিদর্শন এবং একাধারে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম চীনের প্রাচীর। এই মহাপ্রাচীরের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য পৃথিবীর বিষুবরেখার দৈর্ঘ্যের বেশী। উত্তর চীনের প্রায় ১৫ টি অঞ্চল জুড়ে মহাপ্রাচীর অবস্থিত। যার সর্বপ্রাচীন অংশটি ২৭০০ বছরের পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৭৭০ -২৭৬ সালের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম অংশ নির্মিত হয় এবং সর্বশেষ অংশ নির্মাণ হয়েছে ১৮৭৮ সালে কিম রাজবংশের আমলে।

             কিন্তু এই মহাপ্রাচীরের আকস্মিক নির্মাণের পশ্চাতে গুজবের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট কিন্ -সি-হুয়াং খ্রীস্টপূর্ব ২২১ সালে সমগ্র মধ্যচীন একত্রিত করে কিন্ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। কিন্ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার আগে বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্য শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে নিজেদের মতো করে ছোট ছোট ভাবে প্রাচীর নির্মাণ করে। সম্রাট কিন্ রাজ্য জয়ের পর এক জাদুকর তাকে জানায় যে তিনি জাদুবলে জানতে পেরেছেন, উঃ যাযাবররা সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। সেই ভয়ে সম্রাট আশেপাশের ছোট ছোট রাজ্যের প্রাচীরগুলির মধ্যে সংযোগস্থাপনের আদেশ দেন। খ্রিস্টপূর্ব  ২২০-২০০ এর মধ্যেই সংযোগ স্থাপন করা হয়। আর তখনই ছোট প্রাচীর মহা প্রাচীরের আকার ধারণ করে। সেই প্রাচীরের বেশ কিছুটা অংশ প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাকি অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।

           বর্তমানে প্রাচীরের যে অংশ দেখা যায় তা মিং রাজবংশে নির্মিত। ১৩৮১ সালে মিং রাজবংশ প্রাচীর নির্মাণ শুরু করে এবং তারা ৮,৮৫১ কিলোমিটার প্রাচীর নির্মাণে সক্ষম হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তর চীনকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। কোনো কোনো স্থানে দুই বা তিন সারির দেওয়াল তুলে প্রাচীরকে আরো সুগঠিত করা হয়েছে।

           শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই প্রাচীর নির্মাণে ২০ টি রাজবংশ সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে। এদের সময় বিভিন্ন ভাবে প্রাচীরের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্প্রসারণ ও পুনর্নবীকরণ করা হয়েছে। এই মহাযজ্ঞে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ খানিকটা বলপূর্বক ভাবে নিযুক্ত ছিল। মূলত বন্দি ও সাজা প্রাপ্ত মানুষ এই কাজে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে এই দীর্ঘ কাজে ৪ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যান। তাদের ওই প্রাচীরগাত্রেই সমাধিস্থ করা হয়। এটি হয়তো অনেকেরই অজানা যে এটি একটি বৃহৎ মানব সমাধি হিসেবেও বিবেচিত হয়।

           এই প্রাচীর সাংহাই পাস থেকে শুরু হয়ে লুকনুরে শেষ হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা আছে যে, এই প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ২১,১৯৬ কিলোমিটার, যা বিষুবরেখার দৈর্ঘ্যের অর্ধেকের বেশি। বিষুবরেখার দৈর্ঘ্য ৪০,০০০ কিলোমিটার, গড় উচ্চতা ২০ ফুট ও সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ ফুট। এই প্রাচীরের সর্বোচ্চ অবস্থান , ৭২২ ফুট ও সর্বনিম্ন সমুদ্রের তটরেখা পর্যন্ত। উঁচু নিচু অঞ্চল জুড়ে এই মহাপ্রাচীরের অবস্থান হওয়াতে অবস্থানগত এই ভিন্নতা গড়ে ওঠে। এই প্রাচীরের গড় প্রস্থ ২১ ফুট এবং স্বাচ্ছন্দে ৫জন অশ্বারোহী পাশাপাশি একইসাথে যেতে পারে। এখানে একাধিক দুর্গ, সেনানিবাস, পর্যবেক্ষণ চৌকি, আভ্যন্তরীন পথ নানা স্থানের অবকাঠামো তৈরী হয়েছিল। প্রাচীরের উপরেও স্বাচ্ছন্দে সৈন্যরা চলাচল করতে পারতো। শত্রুর অবস্থান জানার জন্য ধোঁয়া সংকেত চৌকির ব্যবস্থা ছিল। মিং রাজবংশের আমলেই এই প্রাচীরের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে এবং উঁচু পর্যবেক্ষন চৌকি তাদের সময়ের অবদান।

         একদিকে তিব্বত ও অন্যদিকে চীন সাগরের মতো প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচ দীর্ঘদিন ধরে চীনকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এসেছে। কিন্তু চীনের উত্তরাংশ অরক্ষিত হওয়ায় হ্যান উপজাতিদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধক হিসেবে এই প্রাচীর নির্মাণ কার্যকরী ভূমিকা নেয়। 

       কথিত আছে চাঁদ থেকে খালি চোখে এই প্রাচীর দেখা যায়। কিন্তু এর মধ্যেই ভ্রান্তি আছে। বিশেষ দূরবীনের সাহায্যে তা দেখা অসম্ভব, যা উঁচুনিচু একটা দীর্ঘ রেখার মতো দেখায়। তবে বিদেশিদের আক্রমণ প্রতিহত করতে যে প্রাচীর সুপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত হয়েছিল তাই বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছে। প্রতিবছর ৫কোটির বেশি পর্যটক এখানে আসেন। তবে প্রাচীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় এলাকা বাডালিং, বেজিঙ থেকে ৭০ কিলোমিটার উঃ পঃ। এই প্রাচীরের অংশটি সর্বোচ্চভাবে সংরক্ষিত, ৪৫০ জন রাষ্ট্রপ্রধান এর পরিদর্শন করেছেন বিভিন্ন সময়ে, এই অঞ্চলটি ব্যস্ততম ও সংস্কারযোগ্য তদুপরি ভ্রমণযোগ্য। এই প্রাচীরের বেশ কিছু অংশ কালের নিয়মেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উঃ পঃ এর গানসু ও নিনজিয়া প্রদেশের অংশ। ৬০- ৭০ এর দশকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা অন্যায় ভাবে প্রাচীর গাত্রের পাথর খুলে নিয়েছে বলে তা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পর্যটকদের জন্য সীমিত অঞ্চলই উন্মুক্ত রয়েছে। তবে কালের রং লাগলেও ঐতিহাসিক এই মহাপ্রাচীরের গুরুত্ব কোনোভাবেই ক্ষুন্ন হয় নি কারণ তাতে লেগে আছে স্মৃতির গন্ধ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...