তাঁকে নিয়ে বলার সময় পলিটিকালি কারেক্ট হওয়া যায় না। দুনিয়ার সেরা স্পিনার, বিস্ময়। যা ইচ্ছে তাই করেছেন। বেঁচেছেন চুটিয়ে। তাঁর প্রয়াণে সকলেই গ্যাটিং-এর মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। উইকেট ভেঙে গিয়েছে আর হয়তো আপনি এখনও উল্লাসরত। বল অফ দ্য সেঞ্চুরির মালিকের জীবন আচমকা শেষ হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়েই। তিনি শেন ওয়ার্ন।
কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের আকস্মিক প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ক্রিকেট বিশ্ব। মাত্র ৫২ বছর বয়সেই ওয়ার্নের এমন পরিণতি বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউই। নিজেও কী বুঝতে পেরেছিলেন আর কিছুক্ষন বাদেই তাঁর দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মৃত্যু দূত। কারণ আজই চলে গিয়েছেন রডনি মার্শ। তাঁর মৃত্যু নিয়ে টুইট করেছিলেন নিজে। লিখেছিলেন 'রড মার্শ চলে গিয়েছেন। সেই খবর শুনে খারাপ লাগছে। তিনি আমাদের দুর্দান্ত খেলার কিংবদন্তি এবং অনেক অল্পবয়সী ছেলে ও মেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিলেন। রড ক্রিকেটের প্রতি গভীরভাবে যত্নশীল এবং অনেক কিছু দিয়েছেন-বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের। রস এবং তাঁর পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল'।
জীবন যে কত বড় অনিশ্চয়তায় ভরা তার প্রমাণ দিয়ে গেল শেন ওয়ার্নের এই টুইট। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন টুইট। চলে গেলেন লেজেন্ড ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন।
তাঁর মৃত্যুতে একের পর এক টুইট করছেন ক্রিকেটাররা। ইরফান পাঠান লিখেছেন, 'শেন ওয়ার্ন ছিলেন জাদুকর। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের কিংবদন্তি। প্রথম আইপিএল জয়ী অধিনায়ক। তাকে মিস করা হবে, তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন'। ওয়াসিম আক্রম লিখেছেন, 'শেন ওয়ার্নের মৃত্যুর খবর শুনে মর্মাহত! তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা রিস্ট স্পিনার। তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং বিশ্বজুড়ে ভক্তদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা রইল।'শোয়েব আখতার লিখেছেন 'শেন ওয়ার্নের মৃত্যুর কথা শুনে হতবাক। আমার কেরিয়ারের শুরুর সময় তার সাথে কিছু চমৎকার বছর শেয়ার করেছি। শান্তিতে বিশ্রাম নাও কিংবদন্তি!'।
ওয়ার্ন এমন একজন ক্রিকেটার যিনি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ'-এর জন্য আর এতবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন যে তার ইয়ত্তা নেই। যৌন কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে ডোপিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ হওয়া, এমনকি বুকিকে পিচ নিয়ে তথ্য দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। অবসরের পরেও এসব কীর্তি কমেনি বরং বেড়েছে। গত অ্যাশেজে মাঠ কাঁপাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড। আর ধারাভাষ্যকার ওয়ার্ন চার বান্ধবীকে একসঙ্গে নিয়ে এমন রাসলীলা করলেন যে তা এলাকার মানুষকে অতিষ্ট করে তুলল এবং খবরের শিরোনামে আবার চলে আসেন 'হলিউড' (ডাক নাম)।
এই ঘটনা তিনি বারবার ঘটিয়েছেন এবং সেই সব ভিডিও সংবাদমাধ্যমের হাতেও এসেছে। ২০০৩ বিশ্বকাপ। ডোপ টেস্টে ধরা পড়লেন ওয়ার্ন। খেলা হল না বিশ্বকাপ। তাতে কী? ফিরে এসে মাঠ কাঁপিয়ে দিলেন। ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করে, এমন ওষুধ প্রস্তুতকারক এক কোম্পানির সঙ্গে বড় অঙ্কের অর্থের চুক্তি হয়েছিল—অন্তত এক বছর ধূমপান করবেন না, আর তাঁরা ওয়ার্নকে ব্যবহার করবেন বিজ্ঞাপনে। গোপনে করেছেন কি না কে জানে, তবে জনসমক্ষে অনেক দিন করেননি। চুক্তির শেষ পর্যায়ে গিয়ে আর পারলেন না, নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে মাঠেই সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন, আর এক কিশোর সেই ছবি তুলে ফেলল।
ওয়ার্ন তাঁর ক্যামেরা ট্যামেরা কেড়ে নিয়ে এমনই হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিলেন যে, চুক্তি গেলই, খবরও হয়ে গেলেন আরেকবার। স্টিভ ওয়া তো বলেইছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল ওয়ার্নের কিন্তু এত বিতর্কিত একজন কী করে ক্যাপ্টেন হবেন। তাই নিজেকে সংযত করতে পেরে পন্টিং হয়েছিলেন ওয়া-র উত্তরসূরি। তাতে কী এসে যায়? ওয়ার্ন তো আপন মাঠের অধিনায়ক। শেন দ্য সুপারস্টার।
এই যেমন বল অফ দ্য সেঞ্চুরি। ১৯৯৩ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে নিজের প্রথম অ্যাশেজ খেলতে নেমেছিলেন ওয়ার্ন। শুরুতেই ইতিহাস। ওয়ার্নের লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে পড়া বলটা এক হাতের মতো টার্ন করে ভেঙে দেয় গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্প। কী ঘটে গেল বুঝে উঠতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্যাটিং। অস্ট্রেলিয়ানদের উল্লাস দেখে বুঝে নিতে হয়েছিল বোল্ড তিনি! ঐতিহাসিক বলে লেগ স্পিনের পুনরুত্থান হয়েছিল।
২০০৩ সালে ডোপ কেলেঙ্কারির পর শেন ওয়ার্নের একদিনের ক্রিকেট কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়। বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়ার পর তাঁকে আর একদিনের ক্রিকেট দলে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। ১৪৫টি টেস্ট ম্যাচে তিনি ৭০৮টি উইকেট শিকার করেছেন। পাশাপাশি ১৯৪টি একদিনের ম্যাচে তিনি নিয়েছেন ২৯৩টি উইকেট শিকার করেন। কেলেঙ্কারি না করে বসলে ওই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারত। গোটা কেরিয়ার জুড়েই বিভিন্ন বিতর্ক তবু ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সুপারস্টার। সেই সুপারস্টার আজ হঠাৎ মাঠ থেকে বিদায় নিলেন।