১৯৬২ সাল, নারায়ণ দেবনাথ ছবি এবং কথায় এঁকে এবং লিখে ফেললেন 'হাঁদা ভোঁদার জয়!'। প্রকাশিত হল শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা 'শুকতারা'য়। তখন কে জানত, হাঁদা-ভোঁদা শিশুমন এমনভাবে জয় করে নেবে যে, সে জয়যাত্রা সনাতন হয়ে উঠবে! এই জয়যাত্রা শুধু হাঁদা-ভোঁদার নয়, তাদের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের, বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের নবতম ধারা কমিকসেরও। হাঁদা-ভোঁদার সেই জনপ্রিয়তার সরণি বেয়ে বিভিন্ন সময়ে স্রষ্টার হাতে জন্ম হল নন্টে, ফন্টে, বাঁটুলের। তৈরি হল দুটি নতুন সিরিজ। "শুকতারা" পত্রিকার জন্য ১৯৬৫ সালে 'বাঁটুল দি গ্রেট' এবং "কিশোর ভারতী" পত্রিকার জন্য ১৯৬৯ সালে 'নন্টে আর ফন্টে'। তারাও ধীরে ধীরে অত্যন্ত অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। গড়ে উঠল বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের নতুন ইতিহাস। এই ইতিহাসের শুরুটা যেভাবে হল, এবার সে-কথাটাই বলি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় হয়, এমন পরিস্থিতিতে হাওড়ার শিবপুরের বছর পনেরোর ছেলে নারায়ণ ভর্তি হলেন ধর্মতলার বেসরকারি এক আর্ট স্কুলে। ছবি আঁকিয়ে বলতে যা বোঝায়, তেমন কেউ তাঁর তিন কুলে ছিলেন না। ছিল পারিবারিক গয়নার দোকান। বাড়ির পাশেই। বাবা বসতেন গদিতে, কাকা গয়নাগাঁটির নকশা আঁকতেন। শিল্পকর্মের সঙ্গে পারিবারিক যোগ এইটুকুই। বাকি আঁকাআঁকির প্রতি যে টানটুকু নারায়ণ পেয়েছিলেন, তা ছিল তাঁর স্বভাবগত। যে-কোন মনের মতো ছবি, তা সে বই হোক বা পত্রিকার, ছোট থেকেই নকল করে আঁকার দিকে খুব ঝোঁক ছিল তাঁর। তারপর বালকবয়সে যখন ইছেমতন ছবি আঁকাটা নেশার মতো হয়ে উঠল, তখন আত্মীয়স্বজনেরা সব একযোগে বাবা হেমচন্দ্রকে বললেন যে, দাও ছেলেকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করে। দ্বিতীয়বার বলতে হল না, হেমচন্দ্র ছেলের মতিগতি বুঝে তাঁদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে একে-ওকে ধরে ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন আর্ট স্কুলে। সেখানকার পাঠ চুকলে নারায়ণ ভর্তি হলেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। তখন চাদ্দিকে ধাঁই ধাঁই করে যুদ্ধের দামামা বাজছে, কলকাতার রাস্তা ব্ল্যাক আউট হচ্ছে প্রতি রাতে, গ্রামের দুর্ভিক্ষ শহরে এসে হানা দিচ্ছে, ভাত নয় একটু ফ্যান পাবার আশায় গ্রামের মানুষ শহরে ছুটে আসছে। এই পরিস্থিতিতে কলেজের পাঠ আর শেষ হল না। পেটের চিন্তা আর কাজের সন্ধানে নারায়ণকেও পথে নামতে হল। টুকটাক কাজও জুটতে লাগল। সিনেমার স্লাইড-বিজ্ঞাপন আঁকার, বিভিন্ন কোম্পানির লোগো আঁকার, আলতা-সিঁদুরের প্যাকেটের ডিজাইন তৈরির। কোন কাজকেই সামান্য মনে করেননি তিনি; কাজ যেমনই হোক, তাকে মাথায় তুলে নিয়েছেন ভালবেসে।
প্রুফ-রিডার এক বন্ধুর সহায়তায় ইতোমধ্যে বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা 'দেব সাহিত্য কুটীর'-থেকে পেতে শুরু করলেন বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণের কাজ। ১৯৪৮ সাল থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল এই সংস্থার শিশু ও কিশোরদের জন্য পত্রিকা, 'শুকতারা'। পত্রিকার সঙ্গে শুরু থেকেই অলংকরণের কাজে যুক্ত হলেন নারায়ণ। পত্রিকার সম্পাদক ক্ষীরোদচন্দ্র মজুমদার একদিন নারায়ণকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, বিদেশি পত্রিকায় যেমন ছোট্ট কমিক ছবির সাথে গল্পও থাকে, তেমন করে তিনি ছোটদের জন্য লিখতে পারবেন কি না? নারায়ণ সেই প্রশ্নমূলক প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। এবং, এভাবেই হয়ে গেল তাঁর রেখক-লেখক জীবনের সূচনা।
প্রথমে জন্ম হল, কমিক চরিত্র ভোঁদা-র। চার-ছবির কমিকসে। সেটি প্রকাশিত হল 'শুকতারা'-র বাংলা ১৩৫৮ সালের কার্তিক সংখ্যায়, 'ভোঁদার মাছধরা'-নামে। প্রধান এই এক চরিত্র নিয়েই ছোট্ট ছোট্ট কমিকস চলল কয়েক বছর। তারপর খুদে পাঠকদের চাহিদায় এবং সম্পাদক মশাইয়ের ইচ্ছেয় কমিকসটির কপালে পাতার বরাদ্দ বাড়ল। গল্পের আয়তন বাড়ল। জুটল ভোঁদার দোসর। 'হাঁদা' চরিত্রটি এসে জুটল গল্পে। বাংলা ১৩৬৯ (ইংরেজি, ১৯৬২) সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হল 'হাঁদা ভোঁদার জয়!'। প্রথম গল্পেই কিস্তিমাত, পাঠকমহলে ঘোষিত হল হাঁদা-ভোঁদা জুটির জয়জয়কার!
১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হল। সেই সময় নারায়ণ সম্পাদকমশাইয়ের আগ্রহে সৃষ্টি করলেন মজার চরিত্র 'বাঁটুল'-কে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান কমিকসের জগতে যেমন প্রচুর সুপারহিরোর আবির্ভাব ঘটেছিল, এবং তারা অপ্রতিরোধ্য আমেরিকানসত্তাকে উপস্থাপিত করেছিল; ঠিক সেরকমই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অপ্রতিরোধ্য ভারতীয়র প্রতিনিধি হয়ে বাঙালি সুপারহিরো বাঁটুলের আবির্ভাব ঘটল। অদ্ভুত চেহারায় তার কিম্ভুত কাণ্ডকারখানাময় বীরত্বগাথা শিশু-কিশোরদের অচিরেই চিত্তহরণ করল।
১৯৬৮ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হল ছোটদের পত্রিকা, 'কিশোর ভারতী'। ক'দিন যেতেই খুদে পাঠকের দল আবদার করল পত্রিকার পাতায় নারায়ণ দেবনাথের কমিকস চাই। ভায়া সম্পাদক মূলত তাদেরই আবদারে নারায়ণ সৃষ্টি করলেন আর এক নতুন চরিত্র, 'পটলচাঁদ'। তাকে নিয়ে লেখা শুরু করলেন, 'পটলচাঁদ দি ম্যাজিশিয়ান'। পটলচাঁদকে পাঠকের ভালো লাগলেও ১৯৬৯-এ যখন 'নন্টে আর ফন্টে' প্রকাশিত হল; তখন এই দুই বিচ্ছুই হয়ে উঠল খুদেদের নয়নের মণি। ব্যস, পত্রিকার পাতায় সেই যে শুরু হল এই দুই জুটির দস্যিপনা, তা আর থামল না।
নারায়ণ দেবনাথ এই যে নিরন্তর একের পর এক চরিত্র সৃষ্টি করলেন, এদের পেলেন কোথায়? কেন, পাড়ায়। পাড়ায় পিলেমার্কা ছেলের অভাব তখনও ছিল না, এখনও নেই। বাবার গয়নার দোকানে মাঝে মাঝে এসে যখন বসতেন বালক নারায়ণ, তখন পাড়ার বিচ্ছু ছেলেরা উল্টোদিকের একটি মিষ্টির দোকানে আড্ডা জমাত। আর ঘটিয়ে ফেলত নানারকমের কাণ্ডকারখানা। সে-সব দেখে মজা তো পেতেনই, তাছাড়া তাঁর নিজেরও বিচ্ছু বন্ধুবান্ধব কিছু কম ছিল না। কর্মকাণ্ডে তারাও কম যেত না। ফলে, তারাই চরিত্র হয়ে, তাদের কর্ম ও কাণ্ড গল্প হয়ে একদিন উঠে এসেছিল কমিকসের পাতায়।
পাতা পেরিয়ে হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুলদা, নন্টে-ফন্টের সঙ্গী হয়ে জেনারেশনের পর জেনারেশন বড় হয়ে গেল, পেরিয়ে গেল অর্ধশতাব্দী কাল। রেখা এবং লেখা দিয়ে নারায়ণ দেবনাথ সেই 'কাল'-কে অতিক্রম করতে পেরেছেন, হয়ে উঠেছেন একালের শিশুপাঠকের কাছে আরও বেশি প্রিয়, হয়ে উঠেছেন বাংলা শিশুসাহিত্যের কমিকসধারার একেশ্বর-সম্রাট।