সময়টা প্রায় একশ বছর আগে। আলিপুরদুয়ার তখন আরো সবুজ ছিল। এই আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটা ময়রাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম যোগেন্দ্রপুরে আসেন এক ব্যক্তি। নাম মনোমোহন দাস। তিনি প্রথম বসতি গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে ওই অঞ্চলের জমির মালিক হয়ে ওঠেন। কিন্তু জমিদার মনোমোহন দাসের চিন্তা কিছুতেই মুক্ত হয় না। আলিপুরদুয়ারের যোগেন্দ্রপুর তখন পান্ডববর্জিত একটি জায়গা। এমন জায়গায় তিনি বাস করবেন কীভাবে! সেই চিন্তাই ওঁকে কুরে কুরে খেতে শুরু করে। জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি বাস করা শুরু করেছিলেন, তবে কিছুতেই রাতে ঘুম হয় না। কারণ বাঘের উপদ্রব। সরাসরি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তখনো পর্যন্ত মনমোহন বাবুর বাড়িতে আক্রমণ করেনি বাঘ। কিন্তু নিজের জমিদারি শুরু করার জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা। জমিদারিতে যারা থাকবেন তারা নিরাপদ জীবন যাপন আশা করবেন, নিরাপদ জীবনযাপন প্রদান করা জমিদারের কর্তব্য। শুধু বাঘ নয় অন্য হিংস্র জন্তু-জানোয়ার সাপের আক্রমণেরও চিন্তা হতে লাগলো মনমোহন দাসের। এমন সময় তিনি একদিন রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন। দুই নারী অবয়ব তাকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। একই রকম দেখতে দুই নারী। তফাৎ গায়ের রঙে। একজনের গায়ের রং সাদা, অন্যজনের গায়ের রং নীল। একজনের নাম চান্দেমা অন্যজনের নাম ফতেমা। এই দুই দেবী নিজের নাম বলেছিলেন মনোমোহন দাসকে। তারা জমিদার মনমোহন দাসকে বলেন যে তাদের মূর্তি তৈরি করে এই গ্রামে পুজো করলে গ্রামের শান্তি ফিরে আসবে। জন্তু-জানোয়ারের উপদ্রব কমবে। এমনকি গ্রামে কারোর রোগ ব্যাধিও হবে না। স্বপ্নে দেখা এই দুই দেবীর মূর্তি নিজের কল্পনা মতই তৈরি করিয়েছিলেন মনমোহন দাস। তখন থেকেই চান্দেমা ফাতেমা দেবীর স্থানে পুজোর শুরু। আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটার ময়রাডাঙ্গা গ্রামের পশ্চিম যোগেন্দ্রপুর অঞ্চলে পুজো হয় এই দুই দেবীর। দুই লৌকিক দেবী পূজিত হন হিন্দু নমঃশূদ্রদের দ্বারা।
ঐতিহাসিকরা বলেন চান্দেমা ও ফতেমা আসলে দুই বোন। একজন হিন্দু অন্যজন মুসলমান। এদের দেখতেও একরকম। এই দুই দেবী ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা। ফতেমা দেবীর মূর্তির রং নীল এবং চান্দেমা দেবীর মূর্তিটার গায়ের রং সাদা। দুই মূর্তিরই দুটো চোখের পাশাপাশি কপালেও রয়েছে তৃতীয় নয়ন। সিংহের উপর বসে থাকেন এই দুই দেবী। ঢেউ খেলানো খোলা চুল। দুজনেরই মাথায় মুকুট এবং গায়ে অলংকার। পরনে লাল রঙের শাড়ি। ফতেমা দেবীর এক হাতে রয়েছে কমলা আর হলুদ রঙের একটা ফুল। চান্দেমা দেবীর হাতে থাকে জবা ফুল।
এই দুই দেবীর স্থান বলতে একটি টিনের চালার ঘর। মাটির দাওয়া। আশেপাশে ফাঁকা মাঠের মধ্যেই এই দেবীর থান অবস্থিত। পাশে রয়েছে লম্বা বিল।
কথিত আছে মনোমোহন দাসের পর এই পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ক্ষিতীশ চক্রবর্তী। ক্ষিতীশ চক্রবর্তীর পর পুজোর দায়িত্ব পান চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী। স্থানীয় মানুষজনের কাছে উনি ত্রিপুরা ঠাকুর নামে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে এই দেবীর থানে পুজো করেন পূজারী সুধীর চক্রবর্তী।
প্রত্যেক বছর ভাদ্র মাসের প্রথমে যে অমাবস্যা পড়ে তারপরই যখন নতুন চাঁদ ওঠে সেই পূর্ণিমাতে পূজো হয় এই দুই দেবীর। বছরে একদিনই পুজো করা হয়। পুজোর আগে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয় উপচার। চাল, ফলমূল, সবজি টাকা-পয়সা যে যার মতো করে দেবীর কাছে নৈবেদ্য সাজায়। তবে গ্রামে আজও কোন অসুখ-বিসুখ প্রতিকূলতা বা কোন হিংস্র জীবজন্তুর খোঁজ পাওয়া গেলে এই দেবীর কাছে গ্রামবাসীরা মানত করেন। কেউ আবার প্রতিমা বানিয়ে দেওয়ারও মানত করেন। কোন দুর্যোগের সময় অনেকেই এই দেবীর কাছে মানত করেন। দুর্যোগ কেটে গেলে বা রোগ সেরে গেলে দেবীর থানে এসে পুজো দেন। প্রত্যেক বছর নতুন প্রতিমা গড়েই পুজো করা হয়। মূর্তি তৈরি করেন ফালাকাটা ব্লকের ৫ মাইল দূরে সাতপুকুরিয়ার বাসিন্দা কার্তিক পাল। মূর্তি তৈরি করে আনার পর দুই ঠাকুরের সামনে চারটি করে খুঁটি দিয়ে তার ওপর লাল শানু কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার নীচে ঘট স্থাপন করা হয়। পুজোর অন্যান্য উপচার খুবই সামান্য। উপকরণ বলতে আতপ চাল, ছোলা, আপেল, আনারস, কলা, নারকেল, অন্যান্য ফলমূল। এছাড়াও গাঁজা এবং দেশি মদ ঈশ্বরের কাছে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। পূজোর শেষে খিচুড়ি ভোগ রান্না করে ভক্তদের দেওয়া হয়। এই পুজোর মন্ত্র লৌকিক মন্ত্র। বর্তমান পূজারী সুধীর চক্রবর্তী চান্দেমা ও ফাতেমা দেবীর পুজার মন্ত্র পেয়েছেন ওঁর বাবা চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীর কাছ থেকে। অনুমান করে নেওয়া হয় চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী সম্ভবত এই মন্ত্র পেয়েছিলেন ক্ষিতীশ চক্রবর্তী এর কাছ থেকে। তবে ক্ষিতিশ চক্রবর্তী কিভাবে মন্ত্রটা পান সেটা জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এই মন্ত্রগুলো আসলে স্বপ্নাদেশে পাওয়া। এভাবেই সরল লৌকিক বিশ্বাসে বেঁচে থাকে এই সব দেবদেবীরা।