জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির ব্যাঙকান্দি গ্রাম। গ্রামের ভেতরের অলিগলি, কাঁচা-পাকা রাস্তা মিলিয়ে এক দিগন্ত পথের দিকে যাত্রা করেছে। দু’পাশে ধান খেতের মাঝখান দিয়ে ক্ষেতের বুক চিরে বয়ে গিয়েছে মাটির রাস্তা। একটা কালভার্ট পার করলেই কিছুটা এগিয়ে রাস্তাটা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। এই রাস্তার মোড়েই শিব আর শনিদেবের থান। সামনে দু’পাশে চা বাগান। তার ওপাশে একটা সরু নদী। নদীটির নাম কলাখাওয়া। এই নদীটা ব্যাঙকান্দির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জর্দা নদীর সঙ্গে মিশেছে। রাস্তা যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিলে একটা বটগাছ রয়েছে। ব্যতিক্রমী লৌকিক থান। এখানে একজন নয় অনেক দেব দেবীর মূর্তি বসানো রয়েছে। প্রত্যেকটি দেবদেবী মানুষের মতো। সব থেকে বড় কথা তারা সকলেই বিয়ের সাজ পোশাকে রয়েছেন। বর আর কনেকে আলাদা করে চিনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না। এছাড়া আরও নারী পুরুষ রয়েছেন।
দেবদেবীর মূর্তিগুলি দেখলে বোঝা যাচ্ছে এঁরা সকলেই বরপক্ষ বা কন্যাপক্ষের মানুষ। এই থানটির নাম হল কইন্যা বরের ঢ্যাম। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে আসল কথাটা হল ঘ্যান অর্থাৎ কইন্যা বরের ঘ্যান। ঘ্যান আসলে রাজবংশী ভাষা। এই শব্দটির অপভ্রংশে কথাটি ঘ্যান রূপে প্রচলিত।
কথিত আছে প্রায় দেড়শ বছর আগে গ্রামের এক জোতদার-এর ছেলের সঙ্গে অন্য একটি জোরদারের মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যাঙকান্দি গ্রামে তখন কাজী সাহেব বলে এক জোতদার ছিল। তাঁর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল পাশের গ্রামের জোতদার বড়ুয়া ঠাকুরের মেয়ের। এই বড়ুয়া ঠাকুরের নাম থেকেই বোধ হয় পরবর্তীকালে ওই গ্রামের নাম হয়েছিল বড়ুয়াটারি।
এই দুই গ্রামের ছেলে মেয়ের বিয়ের সময় নিমন্ত্রিত ছিলেন দুই গ্রামেরই গ্রামবাসী। বিয়ের পর মেয়েকে নিয়ে নৌকো করে যাওয়ার কথা ছিল। নৌকো কলাখাওয়া নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। একটি দুর্ঘটনা ঘটে ওইদিন। এই নদীর স্রোতে ডুবে যায় বরযাত্রী সমেত বর কনে।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর স্থানীয় ফতুয়া ধনী বলে এক ব্যক্তি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখেন জোতদার কাজী সাহেবের মৃত ছেলে, মৃতা ছেলের বউসহ বরযাত্রীরা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁরা রীতিমতো রেগে কাজী সাহেবকে আদেশ দিয়েছিলেন এই কলাখাওয়া নদীর পারে তাদের থান বানিয়ে যেন পুজো করা হয় যাতে গ্রামের লোকেরা কেউ তাদের ভুলতে না পারে। এরপর থেকেই এখানে পুজোর শুরু হয়। তবে শোনা যায় প্রথমে কাজী সাহেব এই স্বপ্নে বিশ্বাস করেননি। এই স্বপ্নটি দেখার পর থেকেই তার সন্তান মারা যেতে আরম্ভ করে। পাঁচ সন্তান হারান তিনি। তারপর তিনি এই থানটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই পুজো হয়ে আসছে।
প্রতিবছর অঘ্রাণ কিংবা মাঘ মাসে ধান কাটার পর একটা শুভ দিন দেখে কইন্যা বরের ঢ্যাম ঠাকুরের পুজো করা হয়। পুজোর উপকরণ বলতে ধানের খই, বাতাসা, সন্দেশ, মিষ্টি এবং ফল লাগে। এছাড়া চাঁদনী-কুন্নাও লাগে। এই পুজোয় পূজারী বর আর কনের মূর্তি দুটোকে দিয়ে দেন। বিয়ের মন্ত্র পড়েন। এভাবেই পুজোর সম্পন্ন করা হয়।
পরবর্তীকালে এই ঠাকুরের থানে আরো ঠাকুর যুক্ত করা হয়েছে। যেমন কাওলি ঠাকুর, কলা খাওয়া ঠাকুর, হরি ঠাকুর, মহাদেব শিব, বুড়াবুড়ি, সন্ন্যাসী ঠাকুর, মহাকাল আর পশ্চিমবির। আলাদা আলাদা টিনের চাল করে থানগুলো তৈরি করা হয়েছে। কইন্যা বরের সঙ্গে পুজো করা হয় এই সব দেবতাদেরও। এই প্রত্যেকটি দেবতাই লৌকিক দেবতা, কোন গল্পেই এদের জন্ম। এভাবেই মানুষের দেবতায়ন বাঁচিয়ে রেখেছে লৌকিক বিশ্বাস।